OPONNASH

  khair 
অঙ্কন : আওলাদ হোসেন
গাহে অচিন পাখি
গাহে অচিন পাখি   ইমদাদুল হক মিলন
গাহে অচিন পাখিইমদাদুল হক মিলন
হাওয়ায় কী একটা ভাজা-পোড়ার গন্ধ ওঠে। ভারি মনোহর। সেই গন্ধে মাছচালার ধুলোবালি থেকে মুখ তোলে বাজারের নেড়িকুত্তাটা। তারপর প্রথমেই তার প্রভু পবন ঠাকুরকে খোঁজে। নেই। গন্ধ আর প্রভুর টানে কুত্তাটা তারপর ওঠে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে পুরনোকালের রোঁয়া ওঠা মদ্দা শরীরখান টানা দেয়। তখন দেখে দূরে খাদ্যি খাওয়ার দোকানটার সামনে প্রভু বসে আছে। গন্ধটাও সেদিক থেকেই আসছে।
কুত্তাটা তারপর কিছু না ভেবে গন্ধের দিকে, প্রভুর দিকে ছুটে যায়।
আমার বাপে আছিল ডাকাইত। বিকরামপুরের বুড়া মাইনষের মুখে হোনবেন কেষ্ট ঠাকুরের নামডাক। মাইনষে কইত কেষ্টা ডাকাইত। যাগ বয়েস পাঁচ কুড়ি-ছয় কুড়ি। আমার বাপের নামে হেই আমলে গেরস্তরা রাইত্রে গুমাইত না। রাইত্রে বিছানায় হুইয়া পোলাপান কানলে বউ-ঝিরা কইত, কেষ্টা আইল। কেষ্টার নামে পোলাপানেও ডরাইত। কান্দন থামাইত, গুমাইয়া পড়ত। গেরামে গেরামে মাইনষে চকি দিত। দল বাইন্দা। কেষ্টারে ঠেকাও। অইলে অইব কী, কাম অইত না। বাপে আমার ঠিকই মাইনষের মাতায় বাড়ি মারত। সব্বস্বান্ত করত। দিবেননি কত্তা একখান আমিত্তি? লতিফ ময়রা খুব মনোযোগ দিয়ে রসে ডোবা আমৃতি তুলে মাটির ঝাঁজরে রাখছিল। ঝাঁজরের নিচে বসানো একখান বালতি। আমৃতির রস চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে তাতে।
লতিফ বসে আছে মাটি থেকে হাতখানেক উঁচু একটা চৌকির ওপর। তার ডান দিকে দোকানের ভেতর মিষ্টির আলমারি। ওপরের দুটো রেকে সাজানো চমচম, বালুসাই, কালোজাম, সন্দেশ, আমৃতি ও গজা। আর নিচের রেকে পেতলের বিশাল গামলায় রসে ডোবা রসগোল্লা, লালমোহন ছানার আমৃতি। সারা দিনে সতেরো বার আলমারির কাচ মোছে লতিফ। পদ্মার জলের মতো ঘোলা কাচ। একটার এক কোনা ভাঙা। আর দুটোতে হিজিবিজি ফাটল। হলে হবে কী, কাচ পাল্টায় না লতিফ। অযথা পেচ্ছাব-পায়খানার মতো কিছু পয়সা বেরিয়ে যাবে। দরকার কী! ভাঙা আলমারি কি কম দেয়! লতিফের বাম দিকে দোকানের বাইরে পরপর সাজানো আঠালো মাটির তিনখান আলগা চুলা। একখান দু'মুখী আর একখান একমুখী। দু'মুখীটায় বিয়ানরাতে এসে তুলে দেয় পুরনোকালের বিশাল একটা কেটলি। হ্যান্ডেলে ছেঁড়াখোড়া কাপড় জড়ানো। তাপে তাপে পোড়া মাটির রং ধরেছে।
কেটলির মুখে পাতলা কাপড় দোপাল্লা করে বাঁধা। ছাঁকনি। রাত একপ্রহর অব্দি চায়ের জল ফোটে কেটলিতে। বিয়ানরাতে একবার মাত্র পদ্মার জল আর চা পাতা ছেড়ে চুলায় ওঠায়। তাতেই রাত একপ্রহর অব্দি চলে।
গাঁও-গ্রামের লোকে আর কত চা খায়। তবুও পুরো এক কেটলি চা শেষ হয় লতিফ ময়রার। আর তিন-চার সের দুধ।
দুধের কড়াইটা থাকে কেটলির পাশেই। দু'মুখী চুলার অন্যটায়। চায়ের গেলাস, চিনির টোফা থাকে লতিফের পায়ের কাছে। চুলার সঙ্গে। গাহাকরা চাওয়ামাত্রই কেটলিটা গেলাসের ওপর একটুখানি কাত করে লতিফ। তারপর গোল চামচে একচামচ দুধ, ছোট্ট চামচে দেড় চামচ চিনি। হাতের মাপ বটে লতিফের। একফোঁটা দুধ এদিক-ওদিক হয় না, এক রোঁয়া চিনি। এসবই অভ্যেস। বহুকালের।
লতিফের দোকানটা ছোট। দোকানের ভেতর মিষ্টির আলমারিটা, কিছু হাঁড়ি-পাতিল, বস্তা আর চৌকিটা ছাড়া অন্য কিছু থোয়ার জায়গা নেই লতিফের। গাহাকরা বসে সব বাইরে। বাইরে, লতিফের দোকানের সামনেটা খোলামেলা। একদিকে লতিফের চুলাচাক্কি আর অন্যদিকে লম্বা একখান টেবিল। পায়া নড়বড় করে তার। টেবিলের দু'পাশে লম্বা দুখানা বেঞ্চি। বেঞ্চির গা ঘেঁষে লতিফের দোকানের দুনম্বর ঝাঁপ ঠিকনা দেয়ার বাঁশটা খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে। অন্যটা চুলার কাছে।
সবই অনেককালের পুরনো জিনিসপত্র। কিছুই বদলানো হয়নি লতিফের। পাই পাই হিসেব করে এই অব্দি এসেছে। সংসারটা ভারী লতিফের। সাতখানা পোলাপান। আর একখান আছে বউর পেটে। মাসদুয়েক বাদে নাজেল হবে। বুড়ি মা আছে। আর একটা ঢ্যাংগা বোন। কুড়ির ওপর বয়েস। বিয়ে দেওয়া হয়নি। টাকা-পয়সার অভাব। ভোর থেকে রাত দশটা অব্দি দোকান চালায় লতিফ। তারপর ক্যাশবাঙ্ খালি করে টাকা-কড়ি বাঁধে তফিলে। দোকানে ভারী চারখান তালা লাগায়। তারপর দেড় মাইল বিল পাড়ি দিয়ে বাড়ি যায়।
জশিলদিয়া থেকে মেদিনীমণ্ডল যেতে মাঝে একবিল। পাক্কা দেড় মাইল। চাঁদনি রাতে সেই বিল পাড়ি দিতে দিতে লতিফ কেবল একটা কথাই ভাবে, এইদিন থাকব না। দোকানের আয়-উন্নতি বাড়ব। টেকা-পয়সার অভাব মাইনষের চিরদিন থাকে না।
এই কথাটা লতিফ ভেবে আসছে, আজ সতেরো-আঠারো বছর। কিন্তু দিন বদলায়নি। আয়-উন্নতি বাড়েনি লতিফের। যেমন ছিল তেমনি রয়ে গেছে সব। দোকানটা আর লতিফ নিজে। আসলে লতিফ তার জীবনের ঘোরপ্যাঁচটা বোঝে না। আয়-উন্নতি বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খরচটাও যে বেড়েছে লতিফ তা বোঝে না। এই দোকান দেওয়ার পরই বিয়ে করেছে লতিফ। মা-বোন ছাড়া আর একটা নতুন মানুষ এসেছে। তাই খাইখরচা। সাধ-আহ্লাদ। তারপর বছর পর বছর আর একজন করে। সাকল্যে মানুষ এখন এগারোজন। আর একজন নাজেল হওয়ার ফিকির করছে।
টাকা-পয়সার মারটা যে এইখানে তা লতিফ বোঝে না। এখনো আশায় আছে এইদিন থাকব না। আয়-উন্নতি বাড়ব। জীবন অন্য রকম অইয়া যাইব।
দু'একখানা বড় গাহাক পেলে ধারণাটা জোর পায় লতিফের। এই যেমন, আজ সকাল বেলা কান্দিপাড়ার মাজেদ খাঁ আধমণ আমৃতির অর্ডার দিয়ে গেছে। কাল সকালে নেবে বাপের চলি্লশার মেজবানি। গরু মারবে একখান। আর আগল আগল ভাত। পয়সা দিয়েছে আল্লায়। আত্মাটাও বড় মাজেদ খাঁর। মাংস ভাতের পর খাওয়াবে আমৃতি। আর অন্যদিকে, সত্তর-আশি টাকার কাজ হয়ে যাবে লতিফের। সেই সুখে বিভোর হয়েছিল লতিফ।
সকালবেলা পঞ্চাশ টাকা দিয়ে গেছে মাজেদ খাঁ। আগাম। টাকাটা হাতে পেয়েই জিনিসপত্র জোগাড় করেছে লতিফ। বাড়িতে খবর পাঠিয়ে দিয়েছে রাতে ফিরবে না। একলা মানুষ পুষ্যি অনেক। সেই ভয়ে দোকানে কর্মচারী রাখে না লতিফ। একলাই আধমণ আমৃতি বানাতে হবে। আধমণ আমৃতি কি যা-তা কথা! রাত কাবার হয়ে যাবে। জিনিসপত্র জোগাড় করতেই দুপুর পার হয়ে গেছে লতিফের। তারপর একমুখী চুলো দুটো সাজিয়ে, একটায় চিনির সিরা তুলেছে। অন্যটায় তেলের কড়াই। পায়ের কাছে, ক্যাশবাঙ্রে সঙ্গে বড় একটা অ্যালুমিনিয়ামের ব্যাঁকা-ত্যাড়া গামলায় ময়দার পানি আর কলাই মিশিয়ে হাতে যখন নারকেলের তলা ফুটো আইচা নিয়ে বসেছে, তখন দুপুর পার। বাজার ভেঙে গেছে।
বাজারটা চালু থাকে দুপুর অব্দি। মানুষের হল্লাচিল্লা, দোকানিদের হাঁকডাক, আনাজপাতি, পেঁয়াজ, রসুনের গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে থাকে। আর পচা মাছের বোঁটকা একটা গন্ধ আসে মাছচালার দিক থেকে। এসবের ওপর আছে বাজারের সম্পূর্ণ আলাদা চিরকালীন গন্ধটা।
সকালের দিকে আজার পায় না লতিফ। বাজার করতে এসে গেরামের গণ্যমান্য লোকেরা লতিফের দোকানে আসে_চা খেতে। বরাত ভালো থাকলে মিষ্টিও খায়। এক-আধসের কিনেও নেয় কেউ কেউ। সেই আয়ে জীবন চলে যাচ্ছে লতিফের। আজ সতেরো-আঠারো বছর।
তারপর দুপুরবেলাটা সব ফাঁকা, নিটাল। জনাসাতেক স্থায়ী দোকানদার ছাড়া বাজারের নেড়িকুত্তাটা আর পবনা পাগলা, সারা জশিলদিয়া বাজারে কেবল এ ক'জনই। জেলেরা যে যার ঝাঁকা মাথায় ফিরে যায়। চারপাশের গেরাম থেকে যেসব গেরস্ত ক্ষেতের আনাজপাতি নিয়ে আসে, গোয়ালারা আসে দুধ নিয়ে, বিক্রি হলে ভালো, না হলে যে যার বস্তু নিয়ে দুপুরের মুখে মুখে ফিরে যায়। বাজারের খোলা চত্বরে তখন পবনা পাগলা, নেড়িকুত্তাটা আর দোকানের ভেতরে আজার দোকানিরা।
বাজারখোলার পাশেই বড় গাঙ, পদ্মা। দুপুরের পর পদ্মার হু হু হাওয়া এসে বাজারের ধুলোবালির সঙ্গে খেলা করে। বাজারখোলার চিরকালীন গন্ধটা একটুখানি উসকে দেয়। তখন বাড়ি থেকে আনা ভাত-পানি খায় লতিফ। তারপর খালি গায়ে, বাবুরহাটের লুঙ্গি পরা, মাজায় বাঁধা একটা লাল গামছা, ক্যাশবাঙ্রে সঙ্গে আয়েশ করে বসে বিড়ি টানে। আজ সেই আজারটা পায়নি লতিফ। ভাতটা এক ফাঁকে খেয়ে নিয়েছে। তারপর বিড়ি টানতে টানতে আধমণ আমৃতির মালসামান ঠিকঠাক করে যখন বসেছে তখন বিকাল হয় হয়।
চার-পাঁচ খোলা আমৃতি তুলে ঝাঁজরের ওপর রেখেছে লতিফ, তখন দু'তিনজন গাহাক এলো। গেরামের যুবক পোলাপান। তাই দেখে এক হাতে আমৃতি আর অন্য হাতে চা বানিয়ে ফেলে লতিফ। তারপর গাহাকদের টেবিলে দিয়ে যখন আবার এসে চুলার পাড়ে বসে তখন টের পায় আমৃতি ভাজার গন্ধে বাজারের হাজার বছরের পুরনো গন্ধটা বেপাত্তা। হু হু হাওয়া বাজারময় বয়ে বেড়াচ্ছে আমৃতি ভাজার মনোহর গন্ধ। সেই গন্ধে সতেরো-আঠারো বছরে যা হয়নি লতিফের আজ তাই হয়। পেটের ভেতরটা চনমন করে ওঠে। একখান আমৃতি খাওয়ার সাধ জাগে।
কিন্তু কাজটা করে না লতিফ। একখান আমৃতির দাম পড়ে এক সিকি। একদিন খেলে যদি লোভটা বেড়ে যায়। লোকসান। লোকসান হলে পুষ্যিরা খাবে কী!
এসব ভাবতে ভাবতে আরেক খোলা আমৃতি তোলে লতিফ। তখন দেখে চুলার ওপারে এসে দাঁড়িয়েছে পবন ঠাকুর। লোকে বলে পবনা পাগলা। চেহারা-সুরত কী_শালার! ধড়খান মরা গয়া গাছের মতো। মাথাভর্তি বাবরি চুল। মুখে কাঁচাপাকা দাড়িগোঁফ। চোখ দুটো গর্তে। তবুও ভাটার মতো দেখতে। হাত-পা মরা ডালপালার মতো পবনার। বুকের পাসলি গোনা যায়। পেটখান দেখলে মনে হয়, ফেন গালার মাইট্টা খাদা উল্টো করে বসানো। তার তলায় টুটাফাঁটা একখান ধুতি। জন্মের পর থেকেই যেন পরে আছে।
মাছচালার মাটিতে শোয় পবনা, মাটিতে বসে। ফলে ধুতিটার রং হয়েছে বাজারে বাইলা মাটির মতো। আর পবনার গায়ের গন্ধটা বটে, বাজারের হাজার বছরের পুরনো গন্ধটাও বাইসানরে বলে পালায়। পবনা হেঁটে গেলে মনে হয়, গেরস্তর আনাজপাতির ক্ষেত থেকে খড় আর বাঁশের মাথায় পোড়া মাটির মালসা বসানো তাড়ুয়াটা হেঁটে যাচ্ছে। গেরস্তর ক্ষেতখোলা পাহারা দেয়। ইঁদুর-বাঁদুড় তাড়ায়।
পবনাকে দেখলে বাজারের লোকজন যায় খেপে। কুত্তা-বেড়াল খেদানোর মতো দূর দূর করে। কিন্তু পবনাও, চিজ একখান। কারো দোকানের সামনে গেলে কিছু না কিছু আদায় করবেই। ঘেঙটি পাড়ার ওস্তাদ! দিনরাত বড়পেট খিদে নিয়ে ঘোরে। দোকানিদের কাছে যায়। এটা নেয়, ওটা নেয়। তারপর মাছচালার ওদিকে নিরালায় বসে আয়েশ করে খায়। সঙ্গে থাকে বাজারের নেড়িকুত্তাটা। জগৎ-সংসারে এই একটাই জীব পবনার বড় বাধুক। পবনা নিজে খাবে যা তার একটু-আধটু কুত্তাটাকেও দেয়। রাতের বেলা পবনা যখন ধুলোবালি গায়ে দিয়ে মাছচালায় শোয়, কুত্তাটাও থাকে পাশে। পাশাপাশি দুটো জীবকে একরকমই দেখায়। খোলাবাজারে যেসব গেরস্ত আনাজপাতি নিয়ে বসে, ভালো বেচাবিক্রি হলে খুশিমনে এক-আধ পয়সা দেয় পবনাকে, পবনা তখন অন্য দোকানিদের কাছ থেকে দু'পয়সায় দু'আনার জিনিস আদায় করে। কতকাল ধরে যে এটা চলে আসছে কেউ জানে না। লতিফও না।
লতিফ এই বাজারে আছে সতেরো-আঠারো বছর। তখন থেকে পবনাকে দেখে। একই রকম। ওই একখান ধুতি পরা, একরকমই চেহারা-সুরত। দিন এলো গেল, কাল বদলাল। পবন ঠাকুর বদলায়নি। আরো কতকাল যে এই সুরত আর ধুতিখান নিয়ে টিকে থাকবে, কে জানে!
পবনাকে দেখে এখন এই কথাটা মনে হলো লতিফের। তারপর একটু মায়া হয়। দূর দূর করে না তাড়িয়ে লতিফ বলল, কিরে পবনা কই আছিলি হারাদিন? আইজ দিহি তরে দেকলাম না?
এই কথায় পবনা খুব খুশি। কেউ নরম গলায় কথা বললে সেখানে লেগে যায় সে। এখনো তাই করে। লতিফের চুলার ওপারে ঝাঁপ ঠিকনা দেওয়ার ত্যাড়া হয়ে দাঁড়ানো বাঁশটার সঙ্গে মাটিতে আসন পিঁড়ি করে বসে। তারপর দাঁত কেলিয়ে হাসে। আপনারে তো হারাদিনঐ দেখলাম কত্তা। বহুৎ কাম করতাছেন।
হ। ম্যালা কাম পইরা গেছে আইজ। হারা রাইতঐ দোকানে থাকতে অইব।
ক্যা?
মাজেদ খাঁর বাপের চলি্লশা কাইল। আদামোণ আমিত্তি বানাইয়া দিতে অইব।
লোকের ভালো খবর শুনলে পবনা খুব খুশি হয়। যেন নিজেরই বিরাট একটা কিছু হয়ে যাচ্ছে এমন গলায় বলল, আ হা হা হা হা। ভালা কতা, বহুৎ ভালা কতা। ভগবান দেউক, আরো দেউক আপনেরে। ঠিক তখনি মাছচালার দিক থেকে ছুটে আসে নেড়িকুত্তাটা। পবনার দোসর।
লতিফের গাহাকরা ওঠে এসবের একটু পরে। পয়সা দিয়ে চলে যাওয়ার পর লতিফ দেখে গেলাসগুলো টেবিলের ওপর পড়ে আছে। তার হাত আজার না। একহাতে আমৃতি পেঁচিয়ে ছাড়ছে তেলের কড়াইয়ে আর অন্য হাতে রসের সিরা থেকে তুলে ঝাঁজরে রাখছে। টেবিল থেকে চায়ের গেলাস আনে কে?
লতিফ বলল, ওই পবনা, গেলাসটা আন।
কেউ কোনো কাজের কথা বললে পবনা খুব খুশি হয়। ছুটে গিয়ে গেলাস এনে দেয়। দুইয়া দিমু? লতিফ ভাবে, পবনার হাতে চা'গেলাস দোয়াইতে দেকলে বদনাম অইয়া যাইব। গেরামের গইণ্যমাইন্য মাইনষে তাইলে আর আমার দোকানে চা খাইতে আইব না। এগারোজন পুষ্যি লইয়া আমি কি তাইলে না খাইয়া মরুম! ইট্টুহানি আয়াশের লাইগা দোকানের বদনাম করুম! লতিফ ব্যবসায়ী মানুষ। মুখে এসব কথা বলে না। পবনা পাগল-ছাগল মানুষ। বাজারের নেড়িকুত্তা। তবুও।
লতিফ কায়দা করে বলল, না থাউক। থুইয়া দে। আইজ আর গাহাক আইব না। আজাইর পাইলে আমিঐ ধুমুনে!
গেলাস কটা লতিফের পায়ের কাছে রেখে দেয় পবনা। তারপর আবার মাটিতে আসন পিঁড়ি করে বসে। একখান আমিত্তি দিবেন কি কত্তা?
শুনে লতিফ একটু বিরক্ত হয়। নারকেলের আইচায় আমৃতির মসলা তেলের কড়াইয়ের ওপর পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ছাড়ে। তুই হারাদিন খালি খাওনের প্যাঁচাইল পারচ ক্যা?
এ কথায় পবনা খিকখিক করে একটু হাসে। কী করুম কত্তা, পোড়া পেটখান খালি খাই খাই করে। আর আইজ আপনে যেই আমিত্তি ভাজতাছেন, ঘেরানে গাঙের মাছও উপরে উইট্টা যাইব! আমি তো মানুষঐ। গাঙপার বইয়া আছিলাম। তহন বাজার থনে একখান বাতাস গেল। হায় হায় বাতাসে খালি আমিত্তির ঘেরান, হেই ঘেরান পাইয়া আমি পাগলের লাহান দৌড়াইয়া আইলাম।
লতিফ কোনো কথা বলে না। হাসে। আর মনোযোগ দিয়ে তেলের কড়াইয়ে আমৃতি ছাড়ে, আমৃতি তোলে। পবনা বলল, দেন একখান আমিত্তি। ভগমান আপনের কিরপা করব।
শুনে লতিফ কেন যে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর উদাস গলায় বলে, পবনারে আইজ হারা রাইত আমার আমিত্তি ভাজন লাগব। তুই এই চুলার পারেঐ বইয়া থাকিচ। হারারাইত। বোজচ না, একলা মানুষ হারারাইত বইয়া আমিত্তি ভাজুম। আমার ডর করে। বাজানে কইত আমিত্তি ভাজনের ঘেরানে বলে পরিস্তান থনে জিন-পরিও আইয়া পড়ে।
পবনা বলল, এই যে আপনের এহেনে বইলাম কত্তা, আর উডুম না। তয় একখান কতা কই আপনেরে, আইজ এই বাজারে জিন-পরি আইবই। যেই ঘেরান বাইরাইছে। তামান দুনিয়াঐ এই ঘেরান পাইব!
লতিফ কোনো কথা বলে না। এক কড়াই আমৃতি ছেড়ে ওঠে। তারপর দোকানের ভেতর থেকে দুটো করে আটখান মাটির পাতিল এনে চৌকির কাছে মাটিতে সার করে রাখে। আড়াই সেরি পাতিল একেকখান। নবকুমারের দোকান থেকে দুপুরবেলাই এনে রেখেছে। দেখে পবনা বলল, কয় সেইরা পাইল্লা?
আড়াই সেইরা।
কয়খান?
আষ্টখান। তুই কি নিকাস বুজচ না বেডা? আড়াই সেইরা আষ্টখান পাইল্লা না অইলে আদমোণ আমৃত্তি আডেনি?
পবনা খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসে। হ। তয় একখান কতা কই আপনেরে কত্তা, আমি কইলাম পুরা আড়াই সের আমিত্তি এক বহায় খাইতে পারুম। এক ঢোকও পানি খামু না। ইট্টু উডুম না।
শুনে ধমকে ওঠে লতিফ। বড়ো প্যাঁচাইল পারচ তুই। তর বাপেনি খাইছে কুনোদিন এক বহায় আড়াই সের আমিত্তি?
মাছচালার দিক থেকে হেঁটে আসছিল আউয়াল। মুদি মনোহারির দোকান চালায়। সারা দিন দোকানে থাকে না আউয়াল। আগে থাকত। নতুন বিয়ে করছে, রাতেরবেলা বউর কাছে না থাকলেনি হয়!
বাড়ি যাওয়ার সময় লতিফের দোকানে একবার আসে আউয়াল। খানিকক্ষণ বসে যায়। গল্পগুজব করে। বেচাবিক্রির আলাপ। হাসি, বিড়ি খাওয়া।
আজ হাসতে হাসতেই আসে আউয়াল। তারপর লতিফের দিকে তাকিয়ে বলে, কী কয়, পাগলায়? লতিফও হাসে। কয় ও বলে এক বহায় আড়াই সের আমিত্তি খাইতে পারব। এক ঢোকও পানি খাইব না, ইট্টু উডব না।
হালায় একটা পাগলঐ। বলে ট্যাঁক থেকে বিড়ি বের করে আউয়াল। লতিফকে দেয় একখান। নিজে নেয়। তারপর বিড়ি ধরিয়ে বেঞ্চে বসে। ওই পাগলার পো, তর বাপেনি খাইছে কুনোদিন এক বহায় আড়াই সের আমিত্তি!
তারপর আবার হাসে।
আউয়াল মানুষটা মন্দ না। ঠাট্টামশকরা পছন্দ করে। আর হাসতে। এ জন্যে দোকানে গাহাক পড়ে বেশি আউয়ালের। দেখে অন্য দোকানিদের পোদ জ্বলে। হলে হবে কী, কেউ কিছু বলে না।
পবনা বলল, আমার বাপে পারত পাঁচ সের খাইতে। এক বহায়। আমি হেই বাপের পোলা, আড়াই সের পারুম না। দিয়া দেহেন কত্তা কেমনে খাই।
লতিফ বিরক্ত হয়ে বলল, আজাইরা প্যাঁচাইল পারিচ না পবনা। বয়। অন্য কথাবার্তা ক, আমার কাম আউগগাইব।
একথায় পবনা একটু উদাস হয়। ফাঁকা শূন্য চোখে আকাশের দিকে তাকায়। তাকিয়ে থাকে। তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে বলে, আমার বাপে আছিল ডাকাইত। বিকরামপুরের বুড়া মাইনষের মুখে হোনবেন কেষ্ট ঠাকুরের নামডাক। মাইনষে কইত কেষ্টা ডাকাইত। যাগ বয়েস পাঁচ কুড়ি ছয় কুড়ি। আমার বাপের নামে হেই আমলে গেরস্তরা রাইত্রে গুমাইত না। রাইত্রে বিচনায় হুইয়া পোলাপান কানলে বউ-ঝিরা কইত, কেষ্টা আইল। কেষ্টার নামে পোলাপানেও ডরাইত। কান্দন থামাইত, গুমাইয়া পড়ত। গেরামে গেরামে মাইনষে চকি দিত। দল বাইন্দা। কেষ্টারে ঠেকাও। অইলে অইব কী, কাম অইত না। বাপে আমার ঠিকই মাইনষের মাতায় বাড়ি মারত। সব্বস্বান্ত করত। দিবেননি কত্তা একখান আমিত্তি?
পবনার শেষ কথাটা কেউ গায়ে মাখে না। লতিফ মনোযোগ দিয়ে ঝাঁজরের ওপর আমৃতি তোলে। আউয়াল বিড়ি টানতে টানতে বলে, তর বাপে আছিল ডাকাইত। মাইনষের মাতায় বাড়ি মাইরা টেকা-পয়সা, মাল-সামান লইত আর তুই নেচ বিক্কা কইরা। বলে আবার সেই গাহাক ভোলানো হাসিটা হাসে।
পবনা বলল, এইডা অইল গিয়া কত্তা বরাতের খেইল। ডাকের কথা আছে না, চোর-ডাকাতের গুষ্টির অন্ন জোডে না। আমার অইছে হেই দশা।
তারপর ফুরুক করে মুখের ভেতর লালা টানে পবনা। কত্তা, দিবেন নি একখান! পেট্টা পুইরা গেল!
লতিফ কথা বলে না। বলে আউয়াল, ওই পবনা পারবি তুই আড়াই সের আমিত্তি খাইতে? এক বহায়?
কন কী কত্তা? পারুম, হাচাঐ পারুম। দিয়া দেহেন না!
যুদি না পারচ?
না পারলে আপনেরা বিচার করবেন?
কী বিচার করুম?
যা আপনেগ মনে লয়।
আউয়াল মানুষটা আমুদে। পবনার কথায় হঠাৎ ভারি ফুর্তি হয় তার! যুদি তুই এক বহায় আড়াই সের আমিত্তি খাইতে পারচ, আমিত্তির দাম তো আমি দিমুঐ আবার কাইল থনে আমার দোকানে তর খাওন-থাকন ফিরি। যতদিন তুই বাঁচবি। আর যুদি না পারচ তাইলে এই বাজারে থনে আইজঐ তরে বাইর কইরা দিমু। কুনুদিন এহেনে আর আইতে পারবি না। ক রাজি আছচ নি?
পবনা ফুর্তিতে গর্দান কাত হয়। ফুরুক করে মুখের ভেতর লালা টেনে নেয় আবার। এক বহায় তো খামুঐ। এক ঢোকও পানি খামু না। উডুমও না।
লতিফ এসব কথা খেয়াল করছিল না। আধমণ মিষ্টির অর্ডার, ষাট-সত্তর টাকার কাজ। ওই একটা চিন্তায়ই সে মগ্ন। দিন বুঝি তার বদলায়।
আউয়াল বলল, হুনছনি লতিফ?
লতিফ আনমনে বলল, কী? পবনা যদি এক বহায় আড়াই সের আমিত্তি খাইতে পারে তয় আমিত্তির দাম তো আমি দিমুঐ। আবার কাইল থনে আমার দোকানে অর থাকন-খাওনও ফিরি।
আউয়াল মৃদু হেসে বলল, কী কচ পবনা?
হাচাঐ কই কত্তা। দিয়া দেহেন না।
আউয়ালের কেন যে এত উৎসাহ। বলল, খাড়া মানুষজন ডাক দেই। বলেই চেঁচিয়ে আশপাশের দোকানিদের ডাকে। ও মিয়ারা, আহেন ইদিকে। কাম আছে।
শুনে লতিফ হাসে। আর ভেতরে ভেতরে খুশি হয়। আরো আড়াই সের আমৃত্তি বুঝি বিক্রি হয়ে গেল তার। আরো দশ-বারো টাকার বুঝি কাজ হয়।
আউয়ালের হাঁকডাকে দু'তিনজন আজার দোকানদার এসে জোটে। কী অইল আউয়াল মিয়া? আউয়াল মহা ফুর্তিতে ঘটনাটা বলে, শুনে কাশেম বলল, কী কচ পবনা? হাচাঐ পারবি? নাইলে বুজিচ বাজার ছাড়তে অইব। এহেনে আর কুনুদিন আইতে পারবি না।
পবনা খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসে। কত্তারা আমি কি আপনেগ লগে মশকরা করতাছি নি? এবার কথা বলে লতিফ। বুইজ্জা দেক পবনা, আড়াই সের আমিত্তি এক বহায় খাওন খেলা কতা না।
লতিফ বলল, আবার বোজ?
বুজছি বুজছি, দিয়া দেহেন।
এবার উত্তেজনা বেড়ে যায় আউয়ালের। লতিফ। টেকা আমি দিমু।
লতিফ তো মহাখুশি। তবুও মুখে কিছু একটা বলতে যাবে, তাকে থামায় কাশেম। তোমার কী লতিফ বাই, দেও। ইট্টু কষ্ট কইরা আড়াই সের আমিত্তি বেশি বানাইবা! দাঁড়িপাল্লা হাতে নিয়ে লতিফ বলল, আমার অসুবিদা নাই। মাল-সামান আছে। আদা ঘণ্টার খাটনি। আমি চিন্তা করি পাগলার লেইগা।
পবনা বলল, আমার লেইগা আপনের কুন চিন্তা নাই কত্তা। আপনে আমিত্তি বানান আর দেহেন, পাগলায় কেমনে বেবাকটি খায়।
দু'পাল্লায় সোয়া সের করে গরম আমৃতি মেপে একটা মাটির খাদায় ঢেলে পবনাকে দেয় লতিফ। তারপর হাসে। অহনও টাইম আছে পবনা, বুইজ্জা দেক।
পবনার তখন দিকবিদিকের খেয়াল নেই। হাতের সামনে গরম গরম আড়াই সের আমৃতি। সবই তার। একলা খাবে। কতকালের সাধ। খাওয়ার সাধ পূরণের যে কী সুখ, পবনা ছাড়া পৃথিবীর আর কে তা এই মুহূর্তে জানে!
প্রথম আমৃতিটা মুখে দিয়ে পবনা বলল, আহা কী সোয়াদ গো কত্তা। আইজ রাইতে আপনের দোকানে জিন-পরি আইবঐ।
এ কথায় লতিফ একটু অন্যমনস্ক হয়ে যায়। বাপের মুখে শুনেছিল, খাঁটি মিষ্টি নিতে পরিস্তান থেকে জিন-পরি আসে গভীর রাতে। দোকানের বেবাক মিষ্টি নিয়ে যায়। যত হাঁড়ি মিষ্টি নেয় টাকা দেয় তত হাঁড়ি। ভাগ্যকুলের কালচাঁদ একরাতে সাত হাঁড়ি টাকা পেয়েছিল। সেই টাকায় কালচাঁদ এখন মহা ধনী। কলিকাতায় শয়ে শয়ে মিষ্টির দোকান তার। বাড়ি, গাড়ি।
লতিফ ভাবে, আইজ রাতে যদি হাচাঐ জিন-পরি আহে আমার দোকানে! যুদি আধামণ আমৃতি লইয়া আধামণ টাকা দেয়! ইস্ তাইলে আর কথা নাই। এই দিন থাকব না। বদলাইয়া যাইব।
গপাগপ দশটা আমৃতি খেয়ে পবনা বলল, বেশি খাওন সামনে থাকলে আমার আবার ইট্টু প্যাঁচাল পারতে অয়, বুজলেননি কত্তারা। আপনেরা আইজ্ঞা করলে কই।
আউয়াল বিড়ি ধরিয়ে বলল, ক। তয় বুজিচ, বেবাক কইলাম খাইতে অইব। ওকাল পাকাল করতে পারবি না।
পবনা হাসে। দেহেন না কত্তা কেমনে খাই।
তারপর আর একটা আমৃতি মুখে দেয়। একবার আমার বাপে গেছে চরে ডাকাতি করতে। আমি তহন পোলাপান। সাত-আষ্ট বচ্ছর বয়েস। আমাগ বাড়ি আছিল কোরাটি গেরামে। পদ্মার পারে। অহন আর কোরাটির নামগন্ধ নাই। পদ্মায় ভাইঙা গেছে। তয় আমি করতাম কী, হারাদিন গাঙপার পইড়া থাকতাম। মায় আমারে গাঙপার থনে দইরা আইন্না বাতপানি খাওয়ায়।
পবনা আর একটি আমৃতি মুখে দেয়।
ততক্ষণে আরো দু'চারজন দোকানদার এসে ভিড় করছে লতিফের দোকানের সামনে। কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বেঞ্চে বসে। সবাই হাঁ করে দেখছে পবনাকে। পবনার পাশে কুত্তাটা। আমৃতির লোভ তারও আছে। এর মধ্যেই বার দুয়েক ঘেউ দিয়ে ফেলেছে সে। কী ঠাকুর, আমারে ইট্টু দিবা না! নাকি একলা-একলাই খাইবা! আ? পবনা খেয়াল করেনি। সুখের সময় কে কার কথা মনে রাখে!
আমৃতি চিবাতে চিবাতে পবনা বলল, বাজানে গেছে চরে ডাকাতি করতে। সাত দিন চইলা যায়, ফিরে না। কুনো সম্বাদ নাই। গাঙপার আটতে আটতে আমার খালি বাজানের কথা মনে অয়। কাসার বাসনে বাত বাইরা দিলে মারে আমি জিগাই, বাজানে আহে না ক্যা মা?
মায় কয়, আইব, বড় কামে গেছে।
তয় বাজানে কুনওদিন ডাকাতি করতে গিয়া দুই দিনের বেশি দেরি করত না। হেই কথা ভাইবা মনডা কেমুন করে আমার। অইলে অইব কি, পোলাপান মানুষ, মারে বেশি কতা জিগাইতে পারি না। রাইত-বিরাইত জাইগা হুনি আন্দার গরে মায় জানি কার লগে কতাবার্তা কয়। বিয়ানে কেঐরে দেহি না। মারে জিগাইলে কয়, আমি গুমের তালে কথা কই।
আবার তিন-চারটা আমৃতি খায় পবনা। ততক্ষণে বিকেল ফুরিয়ে গেছে। পদ্মার হাওয়ার সঙ্গে কাশরেণুর মতো উড়ে উড়ে আসছে অন্ধকার। দোকানে দোকানে জ্বলে উঠেছে হারিকেন, হ্যাজাগবাতি। লতিফ ময়রাও যে কোন ফাঁকে পুরনোকালের জংধরা হ্যাজাগটা পাম্প করে, তেল ভরে কাচ পরিষ্কার করে ম্যানটেলে আগুন দিয়েছে, কেউ খেয়াল করেনি। হ্যাজাগটা এখন মিষ্টির আলমারির সঙ্গে বসে জ্বলছে। কী আওয়াজ তার। শোঁ শোঁ। সেই আওয়াজের সঙ্গে মিলেমিশে আসছে আগরবাতির গন্ধ। সন্ধেবেলা দোকানে আগরবাতি জ্বালায় লতিফ। আজ সতেরো-আঠারো বছর। যে ধর্মের যে রীতি। হিন্দুরা দেয় ধূপ, মুসলমানরা আগরবাতি। যাবতীয় সুগন্ধই বুঝি পবিত্র।
হ্যাজাগ জ্বালিয়ে লতিফ আবার বসেছে চুলার পাড়ে। মনোযোগ দিয়ে আমৃতি তুলছে। পবনার চারপাশের ভিড়টা একটুও নড়েনি। দোকানিদের কত কাজ থাকে সন্ধেবেলা, আজ সেসব কাজের কথা কারো মনে নেই।
হ্যাজাগের দিকে তাকিয়ে আবার দু'খান আমৃতি খায় পবনা। ছয় দিনের দিন নিশি রাইতে গুমের তালে আমি হুনি কি, কই জানি বহুৎ দূরে কী একখান পইক ডাকতাছে। কু কু। হুইনা আমার বুকের বিতরে কেমুন জানি করে। পোলাপান মানুষ তো, কিচ্ছু বুঝি না। বিয়ানে উইট্টা দেহি মনে নাই কিছু। পরদিন দুইফর বেলা, আমি আর মায় বইয়া রইছি দাওয়ায়, এমুন টাইমে একজন অচিন মানুষ আইল। মাতায় তার আড়াই সেইরা একখান মাইট্টা পাইলা। নতুন। মুখখান আবার বাঁশকাগজ দিয়া বান্দা। দেকলে মনে হয়, মিষ্টি মাতায় লইয়া বিয়ার চলনে যাইতাছে। আমি চাইয়া চাইয়া মানুষটারে দেহি। হেয় দেহি আমাগ বাইতঐ আহে। দেইক্কা আমি আর আমুদে বাঁচি না। আমাগ কুনো সজন আইলনি। মেলাদিন বাদে আইল দেইক্কা বুঝি মিষ্টি লইয়া আইছে। মিষ্টির মইদ্যে আমিত্তি অইল আমার জানপরান। পাইলা দেইখা আমার লোভ পইরা যায়। আহা আইজ পেট বইরা আমিত্তি খামু। কুনোদিন তো ভরপেট আমিত্তি খাই নাই। দুই চাইরখান খাইছি। পেডের কোনাও ভরে নাই।
আউয়াল বলল, ওই পবনা খাচ না? অহনো তো এক সেরও খাইতে পারচ নাই। বেবাকটি যুদি না পারচ তাইলে বুজিচ। আইজঐ পিডাইয়া বাজার থেকে খেদামু।
লোকে বোঝে, আড়াই সের আমৃতির দাম দিতে অইব। আবার কাইল থনে পবনার থাকন-খাওন। জেদের চোটে কাজটি করেছে আউয়াল। সেই রাগে ভেতরে ভেতরে গজরাচ্ছে এখন। দেখে অন্য দোকানিরা খুশি হয়। ভালা হোগামারানি খাইছে হালায়। পয়সার গরম, বোঝ অহন!
লতিফও মনে মনে হাসে। হোগায় গুঁড়া কিরমি অইলে এমনুঐ অয়।
কথা বলতে বলতে পবনা একটু আনমনা হয়েছিল। আউয়ালের খ্যাঁকানিতে আমৃতির কথা মনে পড়ে। আবার নতুন করে খাওয়ার লোভটা হয়। এক থাবায় দু'তিনটে আমৃতি তোলে পবনা। মুখে দেয়। এইভাবে চার-পাঁচবার। দেখে ভিড়টা হুল্লাচল্লা করে ওঠে। এইবার পবনা ওকাল করব।
শুনে গর্জে ওঠে আউয়াল। লতিফের দোকানের ঝাঁপ ঠিকনা দেওয়ার বাঁশটা আঁকড়ে ধরে। ওকাল করলেই পিডান আরম্ভ করুম।
পবনা সেসব খেয়াল করে না। আমৃতির স্বাদ মুখে নিয়ে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসে। চেইতেন না কত্তা। বহেন আর দেহেন। তয় আমারে ইট্টু কতাবার্তা কওনের টেইম দিতে অইব।
পবনা আবার দুটো আমৃতি খায়। মানুষডা করল কী, বুজলেননি কত্তারা, পাইল্লাখান মার পার সামনে নামাইয়া ইট্টু খাড়ায়। খরালিকাল আছিল। কত্তার চুলার লাহান গরম অইয়া গেছে দুনিয়া। মানুষডা গাইম্মা চুইম্মা সারা। মাজায় বান্দা আছিল লাল একখান গামছা। খুইল্লা মোক পোছে। চেহারাখান কী তার, দেকলে ডর করে। মাথায় বাবরি চুল। মোকে খাশির লাহান কালা মোচ, দাড়ি। চক্কু দুইখান শোল মাচের পোনার লাহান লাল। কইল, ওস্তাদ আপনেগ লেইগা মিষ্টি পাডাইছে। হেয় আইব সাত দিন বাদে। হুইনা মায় আমার কুনো কতা কয় না। মানুষডা কুন দিকে যে চইলা যায়, আর দেহি না। তয় আমার তহন কুনওদিকে খেল নাই। মায় যেমুন বইয়া রইছিল, তেমুনঐ বইয়া থাকে দেইখা আমার পরানডা আইঢাই করে। পাইল্লাডা খোলে না ক্যান মায়। বইয়া রইছে ক্যা? মোক দিয়া আবার লোল পড়ে আমার। সইতে না পাইরা কাগজ ছেদা কইরা পাইল্লার ভেতর আত দেই আমি। হায় হায়, আত দিয়া দেহি মিষ্টি কৈ! আতে দেহি বেতকাডার লাহান কী বিন্দে! উক্কি দিয়া দেহি কি, হায় হায় মিষ্টির নামে হারে বাইশ, পাইল্লার মইদ্যে বাজানের কল্লাডা। বাজানের মাথার চুল আছিল কুডিকুডি। বেতকাডার লাহান খাড়াখাড়া। মোক ভরা মোচ, দাড়ি। গায়ের রংখান আছিল চুলার ছাইয়ের লাহান। আন্দারে বাজানের চক্কু দুইডা ছাড়া আর কিছু দেহা যাইত না। পাইল্লার মইদ্যে বাজানের কল্লাডা দেইক্কা, পোলাপান মানুষ কিচ্ছু বুঝি না আমি। কই, মাগো, দেহ পাইল্লাডার মইদ্যে দিহি বাজানের মাতাডা।
কী কচ? মায় আমার পাইল্লার মইধ্যে ফালাইয়া পড়ে। তার বাদে চিক্কার মাইরা অজ্ঞেন। বুঝলেননি কত্তারা, মায় অজ্ঞেন হইয়া গেল। হেয়া দেইক্কা আমি চিক্কইর আরম্ভ করি। আমার চিক্কইরে পশ্বিরা দরাইয়া আহে। ওই পবনা কী অইছে রে? আ?
আমি কিচ্ছু বুঝি না। কী কমু। পশ্বিরা বাজানের কল্লাডা বাইর করে। তার বাদে হারা গেরামের মানুষ আইয়া ওডে আমাগ বাইত। আসলে অইছিল কী, বুজলেননি কত্তারা, চরে ডাকাতি করতে গিয়া ডাকাতির মাল-সামান লইয়া সাকরিদগ লগে কাইজ্জা লাগে বাজানের। হের লগের মাইনষেঐ হেরে মারে। তার বাদে কল্লাডা কাইট্টা আত্মীয় বাইত মিষ্টি পাডানের লাহান আমাগ বাইত পাডাইয়া দেয়।
পবনা আর দু'তিনটে আমৃতি খায়। লোকজন নিজেদের মধ্যে কী কী সব কথাবার্তা কয়, পবনার কথা শোনে কি শোনে, বোঝা যায় না। কেবল পবনা আড়াই সের আমৃতি খেতে পারবে কি, পারবে না, তাই নিয়ে কথা।
আউয়াল দেখে অর্ধেকের বেশি আমৃতি খেয়ে ফেলেছে পবনা। বাকি অর্ধেকও বুঝি খেয়ে ফেলবে! যেভাবে কথা বলে আর খায়, বেজায় লোকসান হয়ে গেল আউয়ালের। কেন যে চালাকি করে আগে সময় বেঁধে দেয়নি। এখন পবনা যদি সারা রাত বসে আস্তে ধীরে খায় আর কথা বলে! এ কথা ভেবে ভাবনায় পড়ে যায় আউয়াল। পবনা যদি সারা রাত বসে খায়, তাহলে তো তারও সারা রাত বসে থাকতে হবে। ওদিকে নতুন বউ বিছানায় শুয়ে সারা রাত এপাশ-ওপাশ করবে। সকালবেলাও বাড়ি ফেরা যাবে না। দোকানে যেতে যেতে কাল সন্ধ্যা। তখন বউ থাকবে মুখ ভার করে। কথাই বলবে না। তার ওপর নতুন শরীরের স্বাদ। আহা দুনিয়ার যাবতীয় মিষ্টিদ্রব্যের চেয়েও মিষ্টি। সেই কথা ভেবে মাথা খারাপ হয়ে যায় আউয়ালের।
খেঁকিয়ে বলে ওই পবনা হবিরে কর। তর লেইগা কি হারা রাত বইয়া থাকুমনি?
এ কথায় পবনা একটু বেজার হয়। এমুন কলাম কতা নাই কত্তা। আমি কইছি এক বহায় খামু। বান্দা টেইম দেই নাই। আপনি খালি দেকবেন আমি না খাইয়া উডিনি। তাইলে যা মনে লয় করবেন।
লতিফ ততক্ষণে ছয়-সাত সের আমৃতি ভেজে শেষ করেছে। মাটির ঝাঁজরটা এখন আমৃতিতে ভরা। না সরালে খোলা নামাবে কোথায়। এই ভেবে লতিফ তার টিনের দাঁড়িপাল্লা টেনে নেয়। গামছা দিয়ে মোছে। তারপর সোয়া সের ওজনের দু'খান বাটখারা এক পাল্লায়, আরেক পাল্লায় আমৃতি মেপে নতুন পাতিলে রাখতে থাকে। এক-একটায় দু'পাল্লা করে। মাপতে মাপতে বাইরেও চোখ রাখে। বাইরে আড়াই সেরের কারবার। আট ন'টাকার কাজ। কথাটা ভেবে ভেতরে ভেতরে খুশিতে মরে যায় লতিফ। আইজ সব কিছু কেমুন জানি লাগে! বিয়ানে পাইলাম আদামোণ আমিত্তির গাহাক। বিয়ালে আড়াই সের। নিশি রাইতে ভাইগ্যাকুলের কালাচান্দের দোকানের লাহান আমার দোকানে আইজ জিন-পরি আইব নাত! আদামোণ আমিত্তি লইয়া আদামোণ টাকা যুদি দেয়! হায় হায়রে, তাইলে আর কতা নাই। দিন বদলাইয়া যাইব। দিন বদলের চিন্তায় মগ্ন থাকে লতিফ। বাইরে কে কী বলে, পবনা কতটা আমৃতি খায় না খায় খেয়াল করে না।
পবনার কথায় চুপ করে থাকে আউয়াল। নিজের দোষে নিজে ফেঁসেছে। কিছুই বলার নেই। তবুও তেজি গলায় বলে, বাইত যামু না বেডা!
পবনা হাসে। যাইয়েন নে। বহেন, হপায় তো হাজ অইল। তারপর আবার আমৃতি মুখে দেয়। ঘজ ঘজ করে আমৃতি চিবায় আর কথা বলে। বাজানে তো মরল। হেই দুঃখে আমি আর বাইত থনে বাইর অই না। খালি চিন্তা করি, মাইনষে মইরা যায় কই। ফিরত আহে না ক্যা! তয় একখান কতা কী, মারে দেহি আগের চাইয়া যেমন বেশি আশিখুশি। পোলাপান মানুষ তো, বুঝি না, ক্যান! রাইতে আন্দার গরে হুইয়া ফুসুর-ফাসুর মানুষের কতা হুনি। বেডা মাইনষের গলা। কেডা আহে রাইতে আন্দার ঘরে! মায় তার লগে কী এত কতা কয়? অইলে অইব কী, বেছি পুচপাচ করন যায় না। আমি পোলাপান মানুষ জিগাইলে মা কয়, তুই সপন দেহচ। আর নাইলে আমি যে গুমের তালে কতা কই, হেই হুনচ। হায় ভগমান! তার বাদে অইল কী, বুজলেননি কত্তারা। একদিন নিশিরাইতে অইছে কী, আমি গুমের মইদ্যে হুনি কই জানি বহুত দূরে হেই পইকডা আবার ডাকতাছে। কুকু। হেই ডাকে আমার নিদ ছুইটা যায়। ডর করে। আন্দারে আইত্তাই, মা মাগো। মার কুনো হদিস পাই না। এই ঘুডঘুইট্টা আন্দারে মায় গেল কই! তার বাদে মালুম করি পেশাব-পাইখানা ফিরতে গেছে। আইবোনে। আবার গুমাইয়া যাই। এক গুমে রাইত পার। মাইনষে কয় না কালগুম, বুজলেননি কত্তারা। বিয়ানে উইট্টা দেহি মায় তো আমার কুনোহানে নাই। পাড়া বইরা বিচরাই, গেরাম নাই। মায় আমার কুনো হানে নাই। হেষমেশ যাই দাইমার বাড়ি। হেয়ও আমার লগে মারে বিচরায়। নাই। মায় আমার নাই।
দাইমার আছিল এক মাইয়া, হরিদাসী। আমার লাহান বয়েস। দাইমার পতি চিতায় গেছে একখান ঘোড়া রাইখা। সেই ঘোড়াখান বেলদারগ কাছে বর্গা দিয়া, মাইয়া লইয়া দুইবেলার অন্ন জোটে দাইমার। এমুন মানুষ হেয়। আমি আর হরিদাসী মিইল্লা বেবাক জায়গায় মারে বিচরাই। সম্বাত নাই। আমি পোলাপান মানুষ, বিয়াল অইয়া যায়, মারে না দেইক্কা আমি চিক্কইর পারি। হেই দেইক্কা দাইমায় আমারে তাগ বাড়ি লইয়া গেল। বুজলেননি কত্তারা, তার বাদে কতদিন গেল, আইল, মায় আমার আর আইল না। বয়েসকালে বুজি মা'র একখান পিরিতের মানুষ আছিল। রাইতে বাজান থাকত না বাইত, হেই মানুষখান আইয়া মার লগে কতাবাত্তা কইত। বাজানে বাইচা থাকতে হের ডরে নাগরের আত ধইরা পলাইতে পারে নাই মায়। কেষ্টা ডাকাতের গরের বউ লইয়া পালাইব, এমুন ক্ষেমতা কুন মাইনষের আছে! তয় পালাইল, বাজানে মইরা যাওনের পর। আমারে একলা থুইয়া।
পবনা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর আস্ত একখান আমৃতি মুখে দিয়ে উদাস হয়ে চিবায়। কুত্তাটা কুত্তাদের চিরকালীন ভঙ্গিতে তখনো পবনার পাশে বসা। অবাক হয়ে প্রভুকে দেখছে। প্রভু যে আজ তাকে না দিয়ে একলাই খায়! কী কারণ? মানুষের সব আচরণ বোঝে না সে। মানুষ জাতটা বড় অদ্ভুত। কুত্তাদের মতো না। কুত্তাটা কেবল এই কথা ভাবে।
ততক্ষণে রাত হয়ে গেছে। বাজারের ঠিক ওপরে ফুটে উঠেছে কাটা বাঙির মতো চাঁদ। তার ম্লান একটা জ্যোৎস্না এসে পড়েছে বাজারের সাদা মাটিতে। পদ্মার হাওয়াটা আছেই। বাজারের ওপর ঘুরে ঘুরে আমৃতি ভাজার গন্ধ আর চাঁদের আলোর মিশেল দিচ্ছে এখন।
আমৃতি চিবাইতে চিবাইতে গলা খাঁকারি দেয় পবনা। বুজলেননি কত্তারা, আমি তার বাদে দাইমার বাইতেঐ থাকি। নিজের মাইয়ারে আর আমারে এক রহমঐ সোয়াগ আল্লাদ করে দাইমায়। রাইতে হোয়ায় তার লগে। অইলে অইব কী, মা'র কতা কলাম আমি ভুলি না। যহন তহন মনডা কান্দে। পরানডা কান্দে। আর দিন যায়। শইলখান আমার বাজানের লাহানঐ জুয়ান তাগড়া অইতে থাকে। হেই দেইখা দাইমায় একদিন কয়, অই পবনা জুয়ান মদ্দ তো অইয়া গেলি কামকাইজ কর। বিয়াশাদি কর। আমি আর কয়দিন। আপনা পেডেরডা তো আছেই, তুইও অহন আপনাঐ। তগ বেবস্তা না কইরা চিতায় উডুম কেমনে?
কামকাইজের কতাডা ভালাই, বিয়াশাদির কতা, বুজলেন না কত্তারা, হুইনা আমার লাজ করে। কই, কী করুম? বাজানের লাহান চুরি-ডাকাতি?
হেই হুইনা দাইমায় আমারে মুইরা পিছা লইয়াহে পিডাইতে। চুরি-ডাকাতি করনের লাইগা তরে পালছি, এ্যাঁ গোলামের পো।
দাইমারে আমি বহুত ডরাইতাম। কই, তয় তুমি কও কী কাম করুম।
দাইমায় আর কতা কয় না। পরদিন বেলদারগ থনে ঘোড়াডা ফিরাইয়া আনে। ঘোড়াডার নাম আছিল পঙ্খিরাজ। আইনা দাইমায় কয়, ল এই ঘোড়াডা দিলাম। এইডা লইয়া আডবার গোয়ালীমান্দ্রা যাবি, দিগলী যাবি। ধানচাইল টানবি, গেরস্তর সবজি টানবি। আমরা তিনজন মানুষ, দিন চইলা যাইব। হরিদাসী তহন ডাঙর অইয়া গেছে। জোলাগ কাপড় পিন্দা চলে। আর খালি আসে, খালি আসে। আমারে দেইখাও লাজ করে। হেই দেইকা, বুজলেননি কত্তারা দাইমায় হরিদাসীর লগেঐ আমারে_
কথাটা শেষ করে না পবনা। পাগল-ছাগল মানুষ, তবুও লাজলজ্জা আছে। তাই দেখে লোকজন হাসে। আমৃতি ভাজতে ভাজতে লতিফ বলে, কইয়া হালা পবনা, হরিদাসীর লগে আদম খেলা খেলনের বেবস্তা কইরা দিল।
শুনে হাসির রোল পড়ে যায়। পবনা কথা বলে না। আমৃতির খাদার দিকে তাকায়। তাকিয়ে খুশি হয়। পেরায় খতম অইয়া আইছে। আর তিন সাড়ে তিন গণ্ডা অইব আছে। পেডের তো অহনও কিছু অয় নাই আমার। আহা কী সুখ গো! আউয়াল কত্তায় কইছে কাইল থনে হের দোকানে থাকন-খাওন ফিরি। আমারে আর পায় কোন হালায়! সুখের কথা ভাবে, আর গপাগপ আমৃতি মুখে দেয় পবনা। পঙ্খিরাজ আছিল হরিদাসীর বাপের আমলের। বেলদারগ কাছে বর্গা আছিল। হালায় বেলদারের পোরা জবর খাটাইত পঙ্খিরাজরে। ধানচাইল টানাইতে টানাইতে আমরক্ত বাইর কইরা হালাইত। পঙ্খিরাজরে পয়লা দিন দেইক্কাঐ আমার এমুন মায়া লাগল, কী কমু কত্তারা। বিলে ছাইরা আইট কইরা খাওয়াইলাম কয়দিন। দেহি, হ পঙ্খিরাজ ঝাড়া দিয়া উড়ছে। তার বাদে শুরু করলাম কাম। গোয়ালীমান্দ্রার আডে যাই, দিগলীর আডে যাই। আডবার না থাকলে যাই অইলদার বাজারে, শিমইল্লার বাজারে। আয়-বরকত ভালোই অয়। দিন চইলা যায়। তয় আমি কইলাম কত্তারা, পঙ্খিরাজরে জবর সোয়াগ করতাম। হারাদিন কাম কইরা রাইতে দিতাম বিলে ছাইরা। পঙ্খিরাজ আছিল আমার খুব বাদুক। বিয়ানে রইদ উডনের আগেঐ বাইত আইয়া পড়ত। আবার কামে যাও। পেডের ধান্দা অইল বড় ধান্দা। তয় পঙ্খিরাজরে কলাম হরিদাসী দেখতে পারত না। কইত, এইডা অইল আমার হতিন। এই ফাঁকে আরেকখান কতা কই কত্তারা, যেদিনঐ আডেবাজারে যাইতাম, বাইত আহনের টেইমে আমি কলাম একখান দুইখান আমিত্তি কিন্না খাইতাম। আমিত্তি খাওনের লোবটা আমারে যে কেমুন হেইডা আপনেরা বুজবেন না। বাজানের কল্লাডা যেদিন মিষ্টির পাইল্লার লাহান আমাগো বাইত আইল, ওই দিন যে লোবটা অইছিল, আহা আইজ পেড বইরা আমিত্তি খামু_হেই লোবটা আর যায় নাই। অহনও আছে। মাইনষে কয় না, ভগমান মানুষের বেবাক আশা পূরণ না করলেও দুই-একখান করে। আমার আমিত্তি খাওনের আশাডা কইলাম পূরণ অইয়া গেল। এই যে আইজ। ইচ্ছামতন খাইতাছি। পেড বইরা। বলেই পবনা আবার আমৃতি মুখে দেয়। তাই দেখে আউয়ালের মুখে মরা বটপাতার রং ধরে। আদতেই তো হালায় বেবাকটি খাইয়া হালাইব। আর তো আছে পাঁচ-ছয়খান। ইসরে কী কামডা করলাম। কতডি টেকা লোকসান। আবার কাইল থনে পাগলার থাকন-খাওন দিতে অইব। ঘাইরামি করলে বদনাম।
নিজের ওপর রাগে জ্বলে যায় আউয়াল।
কাশেম বলে, হ বুজছি, বেবাকটিঐ খাইব হালায়।
তারপর পবনাকে বলে, একটানে খাইয়া হালা পবনা। দেইক্যা দোকানে যাই। লতিফ বলে, আর কী দেকবা, যাও। ঐত আর কয়খান।
ধীরেসুস্থে খাউক।
আউয়াল মনে মনে বলে, তোমার কি চোদানির পো। খালি মাইনষের হোগা মারনের তালে থাক।
মুখে এসব কথা বলা যায় না। আউয়াল আবার বিড়ি ধরায়। তারপর চাঁদের ম্লান আলো আর পদ্মার হাওয়ার ওপর ধোঁয়া ছাড়তে শোনে, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই হরিদাসী গেল পোয়াতী অইয়া। হেই দেইক্কা আমি হারাদিন পঙ্খিরাজরে লইয়া আডবাজারে পইরা থাকি। আমিত্তি খাওন ছাইরা দেই। খাওনের মুখ বাড়তাছে। আয় না বাড়লে কেমনে চলব। দাইমায়ও হেই কতাঐ কয়। ভালা কইরা কামকাইজ কর। পোলাপান অইলে খরচা আছে। খালি হরিদাসী কয়, এত কাম কইর না। নিজের জানপরানডার খেল রাইখ। পবনা আবার একটা আমৃতি মুখে দেয়। মুখে দিয়েই টের পায়, পেটটা কেমন করে। বুকটা কেমন করে। হায় হায় ওকাল পাকাল অইব না তো! তাইলে সব্বনাশ অইয়া যাইব। আউয়াল কত্তায় অহনঐ বাঁশ দিয়া পিডাইব। কাইল থনে এই বাজারে আর থাকন যাইব না। তাইলে আমি যামু কই। যাওনের একখান জাগা আছিল দাইমা। হেয় চিতায় উটছে একযোগে বারো বচ্ছর।
পবনা একটু নড়েচড়ে বসে। তাতে পেটটা একটু আরাম পায়। বুকটা একটু আরাম পায়। একদিন রাইতে হরিদাসীর বেদনা উঠল। বাইত আছিল একখান গর। দাইমায় কইল, ওই পবনা তুই গিয়া গাছতলায় ব। এই টেইমে মরদরা গরে থাকে না।
উডানে আছিল একখান রোয়াইল গাছ। আমি হেই গাছের লগে ঢেলান দিয়া বহি। নিশি রাইত। পঙ্খিরাজ গেছে বিলে। আসমানে চুনাকুমড়ার লাগান গোল একখান চান। চান্নী কী! ফক ফক করে। মাইত্তে ফুঁ দিলে ধুলাবালি উড়তে দেহা যায় এমুন। আমি গাছতলায় বইয়া বইয়া বিড়ি টানি আর হুনি গরের মইদ্যে হরিদাসী আহুইজ্জা বেদনায় কোঁকায়। আমার কেন জানি পরানডা কান্দে। কেমুন যানি লাগে। এমনু টেইমে হুনি কী, বুজলেন নি কত্তারা, কই জানি বহুত দূরে হেই পইকখান ডাকতাছে। কু কু। হুইনা আমার পরানডা কান্দে। কেমুন যানি লাগে। বিয়ান অয় নায়, তখন দাইমায় চিক্কইর দিয়া উঠল। হায় হায় রে, কী সব্বনাশ অইল গো। আমি দউর পাইরা গরে যাই। গিয়া দেহি হরিদাসী নিজে গেছে, পেডেরডাও লইয়া গেছে। দেইক্কা আমার যে মাতার মইদ্যে একখান চক্কর মারল, হেই চক্করডা আর কুনদিন গেল না। অহনও আছে।
পবনা তারপর আর কোনো কথা বলে না। উদাস হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। কী যে দেখে, কী যে ভাবে, কেউ জানে না।
খাদায় তখন একটা মাত্র আমৃতি। দেখে আউয়াল উঠে দাঁড়ায়। মরা বটপাতার মতো মুখটা নিয়ে বলে, খাইয়া হালা পবনা। বাইত যামু।
ম্যালা রাইত অইল।
কাশেম বলল, দেরি করচ ক্যা পবনা? খাইয়া হালা।
পবনার তখন পেটটা কেমন করে, বুকটা কেমন করে। এতকালের পুরনো শরীরটা আর নিজের মনে হয় না। ভাবটা চেপে থাকে পবনা। মুখে খুব বিনীতভাবে বলে, কত্তারা, এইডা না খাইলাম। কুত্তাডা হারাদিন বইয়া রইল, এইডা অরে দেই।
শুনে গর্জে ওঠে আউয়াল। বানড়ামি পাইছ বেডা হালা। খাও। নাইলে অহনঐ পিডামু। পবনার আর কথা বলার মুখ থাকে না। মনে মনে কুত্তাটার কাছে ক্ষমা চায় সে। ভাইরে ক্ষমা কইর।
তারপর শেষ আমৃতিটা মুখে দিয়ে উঠে দাঁড়ায় পবনা। দাঁড়িয়ে টের পায় এতকালের পুরনো শরীরটা আর তার হাতের মধ্যে নেই। অচেনা হয়ে গেছে।
তখন ভিড়টা ভাঙছে। দোকানিরা পবনার গর্বে বুক ফুলিয়ে ফিরে যাচ্ছে। কত পদের কথা তাদের। সাব্বাস পবনা, বাপের নাম রাখছচ।
পবনা এসবের কিছুই শোনে না। অচিন শরীরখান টেনে টেনে, চাঁদের ম্লান আলো মাথায়, নদীর দিকে হেঁটে যায়। পৃথিবীর দূর কোনো প্রান্তে বসে কি সেই পাখিটা তখন ডাকছিল। কু কু?
পরদিন সকালে মাছচালায় ধুলোবালি থেকে মুখ তুলে নেড়িকুত্তাটা তার প্রভু পবন ঠাকুরকে খোঁজে। নেই।
কুত্তাটা তারপর ওঠে। উঠে বাজারময় চক্কর খায়। প্রভুকে খোঁজে। নেই, প্রভু কোথাও নেই।
কুত্তাটা তারপর মন খারাপ করে নদী তীরে যায়। সেখানে জেলেদের দু'তিনখান নাও ডাঙায় উপুর করে রাখা। মেরামত হবে। আলকাতরা মাইটা তেল খেয়ে আবার জলে নামবে।
কুত্তাটা দেখে দু'খান নাওয়ের মাঝখানে মাটিতে তার প্রভু পবন ঠাকুর হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। দেখে কুত্তাটা দু'তিনখান ঘেউ দেয়। পবন ঠাকুর নড়ে না। কুত্তাটা কী বোঝে কে জানে, সে আর ঘেউ দেয় না। একটা নাওয়ের সামনে পা তুলে পেচ্ছাব করে।
  
হাসন সখীঅন্নদাশঙ্কর রায় 
অঙ্কন : সুমন
¦হাসন সখীঅন্নদাশঙ্কর রায়

হাসন সখীঅন্নদাশঙ্কর রায়
হাসন সখীঅন্নদাশঙ্কর রায়
ক্লাসে যারা ডাকসাইটে দস্যি ছেলে, পড়া বলতে পারে না, বেঞ্চির উপর দাঁড়ায়, তারা বসে পিছনের সারিতে। একদিন তাদের রাজা সূর্যমোহন এসে আমায় বললে, 'আজ থেকে তুমি হলে আমাদের মন্ত্রী। আমাদের সঙ্গে বসবে, খাতা দেখতে দেবে, প্রম্পট্ করবে। কেমন, রাজি?'
আমি নবাগত, আমার ছেলেবেলার ইস্কুল থেকে নাম কাটিয়ে পুরী জেলা স্কুলে ভর্তি হয়েছি। কাউকে চিনিনে বললে হয়তো ভুল বলা হবে, কারণ আমার এক দূর সম্পর্কের দাদা আমার সহপাঠী, তারই কাছে বসি ও তারই সঙ্গে বেড়াই। এমন যে আমি, সেই আমাকেই কিনা মন্ত্রী মনোনয়ন করলেন সেকেন্ড ক্লাসের ছোট লাট সূর্যমোহন ছোটরায়।
শুনেছিলাম তাদের অসাধ্য কাজ নেই। ফুটবল খেলার সময় ফাউল করে পা ভেঙে দেওয়া তাদের নিত্যকর্ম। সন্ধ্যার অন্ধকারে ল্যাং মারা ও গলির মধ্যে অদৃশ্য হওয়া তাদের অভ্যাস। আমার যদিও ফুটবল খেলার ব্যসন ছিল না, সমুদ্রতীর থেকে বাসায় ফিরতে প্রায়ই অন্ধকার হত। বাসা ছিল গলির ভিতরে, সুতরাং ভয়ের হেতু ছিল। আমি আর কথা কাটাকাটি না করে পিছনের সারিতে মুখ ঢাকলুম।
এই ঘটনা যে কেউ লক্ষ করবে অতটা আমি ভাবিনি। আমি অপরিচিত নগণ্য ব্যক্তি, কেই বা আমাকে চেনে? কিন্তু দিন কয়েক পরে আমাদের ইংরেজি মাস্টার কেশববাবু আমাকে অযাচিত অপমান করলেন আমি খারাপ ছেলেদের একজন বলে। তার পর কী মনে করে আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে বললেন, 'ওভ ুড়ঁ ধিহঃ ঃড় নব ধ মড়ড়ফ নড়ু ভড়ষষড় িসু ঘরষঁ.'
কেশববাবুর ছেলে নীলাদ্রি পড়ত আমাদেরই ক্লাসে, বসত সামনের সারিতে। সত্যিকারের ভালো ছেলে, ফার্স্ট সেকেন্ড হত। আমি তার সঙ্গে আলাপের চেষ্টা করিনি, সেও আমার সঙ্গে না। আমি লাজুক, সে অহংকারী। অন্তত লোকে তো তাই বলে। তার বাবা যখন এত মানুষের মাঝখানে আমাকে অপমান করে গেলেন তখন আমিও আমার মুখরক্ষার জন্যে তার কথাগুলির অন্য অর্থ করলুম। আমার দুষ্ট ছেলের দলটিকে মন্ত্রণা দিলুম, 'ওহে মাস্টার মশাই কী করতে বললেন শুনলে তো। নীলুকে ফলো করতে হবে। তার মানে, নীলু যখন যেদিকে যাবে তোমরাও তখন সেই দিকে যাবে। কিন্তু খবরদার, নীলু যেন টের না পায়।'
সে দিন থেকে আমাদের মন্ত্র হল নীলুকে ফলো করো। আমরা ওটার উপর বাঁদরামি ফলিয়ে ওর উচ্চারণ করতুম, ফল্লো মাই নীল্লো!
তখন ঠাহর হয়নি এর পরিণাম কী হতে পারে। একদিন আমাদের দলের দীনকৃষ্ণ এসে আমার কানে কানে বললে, 'জানিস, ও কোথায় যায়?'
'কোথায়?'
'কাউকে বলিসনে। সমুদ্রের ধারে একটা ছোট দোতলা বাড়ি আছে, চক্রতীর্থের দিকে। সেখানে রোজ বিকেল বেলা নীলু গিয়ে কাদের সঙ্গে আড্ডা দেয়, শুনবি?'
'কাদের সঙ্গে?'
'মেয়েদের সঙ্গে!'
ডিটেকটিভ বই পড়েও আমি এমন রোমাঞ্চিত হইনি। সেদিন আমার ইচ্ছা করছিল দুনিয়ার লোককে ডেকে বলতে, আহা! নীলু কেমন ভালো ছেলে দেখলেন তো আপনারা! ফল্লো মাই নীল্লো!
মেয়েদের উল্লেখ শুনে আমি আমার মুখখানাকে যথাসাধ্য সাধু সন্ন্যাসীদের মতো করে বললুম, 'আমরা দুষ্টু ছেলে বটে, কিন্তু দুশ্চরিত্র নই। আমাদের আদর্শ স্বামী বিবেকানন্দ, আমরা কি কখনো মেয়েদের সঙ্গে মিশতে পারি!'
দীনু বললে, 'মেশা দূরে থাক, ওদের কাছে যেতেই আমার বুক ধুকপুক করে। একটি মেয়ে যেই নিচে নামল আমি দিলুম ভোঁ দৌড়। নীলুর, যাই বল, সাহস আছে।'
আমি সেদিন আবিষ্কার করলুম যে আমরা দুজনেই সমান ভণ্ড। যেমন আমি তেমনি দীনু। আসলে আমরা নীলুর অনুসরণ করতে পেলে বাঁচি। দুনিয়ার লোকের চোখে ধুলো দিয়ে আমরা দুই ভণ্ড সন্ন্যাসী নীলুর পিছু নিলুম। বুক ধুকপুক করছিল বটে দুজনেরই কিন্তু মেয়েদের জন্য নয়, তাদের অভিভাবকদের ভয়ে। মুখে বোলচাল দিচ্ছিলুম, 'নীলুটাকে ধরিয়ে দিতে হবে।' কিন্তু অন্তরাত্মা জানেন যা মনে মনে বলছিলুম। 'যদি ধরা পড়ি তখন?' তখন অবশ্য ভোঁ দৌড়।
বাড়িটার নাম 'ঊর্মিমুখর'। ছোট দোতলা বাড়ি। ফিকে নীল রং। সমুদ্রের হাওয়ায় ছিল সমুদ্রের স্বনন। বাড়িটা সার্থকনামা।
আমরা ওর পাশে ঝিনুক কুড়োতে বালু খুঁড়তে আরম্ভ করে দিলুম গুটি কয়েক অচেনা শিশুর সঙ্গে ভাব করে। নজর রাখলুম নীলুর উপরে। নীলু যখন দোতলায় পেঁৗছল তখন হাসির হররা উঠল তাকে দেখে, না তার পোশাক দেখে, না কী দেখে তা বোঝা গেল না। নীলুও সে হাসিতে যোগ দিলে। আমাদের কানে আসতে লাগল, হা হা। হো হো। হি হি।
নীলুটা যে এমন বাঁদর তা কে জানত। মেয়েদের সঙ্গে সমানে চাল দেয়। কখনো হাসে, কখনো গায়, কখনো খুনসুটি করে। আমরা শুনে পেলুম ওরা ওকে ভূতুম বলে ডাকছে। নামের কী ছিরি। ভূতুম! নীলুর কিন্তু তাতেই আনন্দ। সে পেঁচার মতো আওয়াজ করছে, 'হুঁম... হুঁম... হুঁম...'
দীনু বললে, 'খেতে খেতে আওয়াজ করছে বলে অমন শোনাচ্ছে।'
আমি বললুম, 'বুঝেছি, খাবার লোভেই ছোঁড়া রোজ এদিকে আসে।'
নীলু যে একজন ভাগ্যবান পুরুষ এ বিষয়ে আমাদের দ্বিমত ছিল না। না জানি কী ভালোমন্দ খায়, আমরা তো পাইনে। এতগুলো মেয়ে মিলে রেঁধেবেড়ে খাওয়ায়। হয়তো চপ কাটলেট ডিমের অমলেট। কী বলে ওকে? পুডিং। হয়তো চকোলেট টফি লজেন্স খেতে দেয়, আইসক্রিম লেমনেড সিরাপ।
আমরা স্থির করলুম নীলুর বাবাকে জানাতে হবে সে কুসংসর্গে মিশছে। আমাদের দলের টাইগারের উপর সে ভার পড়ল। ওর মতো ঠোঁটকাটা বেহায়া খুব কম দেখা যায়। মানুষের গায়ে পড়ে ঝগড়া বাধায়, বিশ্রী গালাগাল দেয়। ওর মুখে কিছু আটকায় না। গুরু লঘু জ্ঞান নেই।
টাইগার একদিন মাস্টার মশায়ের পা মাড়িয়ে দিয়ে ঘটা করে পায়ের ধুলো নিলে। তারপর বললে, 'এবার থেকে নীলুরও পায়ের ধুলো নেব স্যার। সে আমাদের চেয়ে অনেক উঁচুতে।'
'কেন হে?'
'সে গাছের ডালে বিচরণ করে, নাম তার ভূতুম। একটি নয়, দুটি নয়, অনেকগুলি পেচানী তার সহচারিণী।'
মাস্টার তো হতবাক। তারপরে টাইগারের কানটা নিজের মুখের কাছে টেনে নিয়ে বললেন, 'ভালো করে খোঁজ নিলে জানবে যে নীলু যায় একটি রুগ্ন মেয়েকে একটুখানি আনন্দ দিতে। মেয়েটির যক্ষ্মা, বাঁচবে কিনা সন্দেহ। সহচারিণী যাদের বলছ তাদেরও ঐ কর্তব্য। সহচরও আছে। সব ভদ্র ঘরের ছেলে, ভদ্র ঘরের মেয়ে। তোমাদের মতো ইতর নয়।'
এর পরে আমি নীলুর সঙ্গে যেচে আলাপ করি। সে একটি যক্ষ্মা রোগীকে একটুখানি আনন্দ দিতে যায়, ভূতুম সাজে, লোক হাসায়। এতে আমি তার মহত্ত্বের পরিচয় পেলুম। তাকে খুলে বললুম সমস্ত, মাফ চাইলুম। নিজের দল ছেড়ে সামনের সারিতে বসতে লাগলুম তার পাশে। ইতিমধ্যে সেও পেয়েছিল আমার বিদ্যার পরিচয়। মাস্টার মশায় আমার খাতা দেখে তাকে নাকি বলেছিলেন যে ছোকরার স্টাইল আছে।
অবশেষে সেই অনিবার্য দিনটি এল যেদিন নীলু আমাকে তার অনুসরণ করতে বললে 'ঊর্মিমুখরে'র দোতলায়। সেখানে একখানি ইজি চেয়ার পাতা, তাতে ঠেস দিয়ে বসেছিল বা শুয়েছিল আমাদেরই বয়সের একটি বিষণ্ন রুগ্ন মেয়ে। নীলু বললে, 'এ আমার হাসন সখী।' মেয়েটি একটু হাসল। 'আর আমি এর ভূতুম।'
'তোমার নাম কি বুদ্ধু?' প্রথম আলাপেই প্রশ্ন করল মেয়েটি। আমি বলতে যাচ্ছিলাম আমার নাম, কিন্তু চোখ টিপল নীলু। তখন আমি উত্তর করলুম, 'হ্যাঁ, ভাই, আমার নাম বুদ্ধু।' সে যখন আমাকে তুমি বলেছে আমিও কেন তাকে তুমি বলব না? শুধালাম 'তুমি বুঝি 'ঠাকুমার ঝুলি' পড়তে ভালোবাসো?'
'ভালোবাসি। সবচেয়ে ভালো লাগে কিরণমালার কাহিনী। আমি যেন কিরণমালা আর তোমরা যেন অরুণ বরুণ। তোমরা যেন মস্ত এক পুরী বানালে মর্মর পাথরের। আর আমি তাকে সাজালুম যত রাজ্যের মণি মাণিক্য দিয়ে। তবু কিসের যেন অভাব। তাই তোমাদের বললুম, যাও তোমরা, নিয়ে এসো সেই সোনার পাখি আর সেই মুক্তা ঝরার জল।'
মেয়েটির আসল নাম চাঁপা। এককালে ওর গায়ের রং চাঁপার মতো ছিল, এখন শুকিয়ে কালো হয়ে আসছে। মুখে এক প্রকার মাদকতা বা মদিরতা। নেশা লাগে ওর সঙ্গে কিছুক্ষণ থাকলে। দেখতে যে খুব সুন্দর তা নয়, কিন্তু তন্ময় হয়ে কথা যখন বলে তখন মনের সৌন্দর্য এসে তনুর সৌন্দর্য হয়।
সেদিন ওদের ওখান থেকে যখন ফিরলুম, তখন চোখে আমার জল। নীলু লক্ষ করলে।
বললে, 'কাঁদছিস নাকি?'
'কাঁদব না তো কী? হাসব? আমি কি তোর মতো পাষাণ?'
'আমি যে হাসি তা পাষাণ বলে নয়। হাসি ওকে হাসাতে।'
'ওকে হাসাতে চাইলেও আমি হাসতে পারব না। এ কি হাসির কথা যে একটি সুন্দর ফুল দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে! হায় ভগবান, কেন আমাদের এত অক্ষম করে সৃষ্টি করলে। কেন, কেন, ওগো একটিবার বলে দাও কেন আমরা পারব না ওকে মুক্তা ঝরার জল দিয়ে বাঁচাতে।'
নীলু শুধু বললে, 'মানছি তোর স্টাইল আছে।'
এখন যেমন আমি একজন হাস্যরসিক তখন তেমন ছিলুম না। তখন ছিলুম উচ্ছ্বাসপরায়ণ ও অরসিক। সেই যে সেদিন ফিরলুম আর ও মুখো হলুম না। নীলু ডাকলে চোখের জল মুছি। বলি, 'যেদিন পারব ওকে মুক্তা ঝরার জল এনে দিতে সেদিন যাব। তার আগে নয়।'
নীলু হাসিয়ে হাসিয়ে বলে, 'বুঝেছি। প্রথম দর্শনেই প্রেম। দ্বিতীয় দর্শনের আবশ্যক হত বিয়ের আশা থাকলে।'
আমি তাকে তাড়া করে যাই। ভাবি, নীলুটা এমন নিরেট।
পুরীতে আরো কিছু কাল থাকলে হয়তো আবার যেতুম, কিন্তু যে কারণেই হোক আমাকে আবার নাম লেখাতে হলো আমার ছেলেবেলার ইস্কুলে। পুরী থেকে বিদায় নিলুম অকালে।
প্রায় চার বছর পরে পাটনা কলেজের উত্তরে গঙ্গার ধারে বেড়াচ্ছি, এমন সময় নীলুর সঙ্গে মুখোমুখি। শুনলুম সে পাটনা ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলে পড়ে, ওভারসিয়ার হয়ে বেরোবে। তার বাবা হঠাৎ মারা যান, তাই কলেজে পড়বার সাধ থাকলেও সাধ্য ছিল না।
নীলু বললে, 'তোর চেহারার তো বিশেষ পরিবর্তন দেখছিনে। তোর স্বভাবটি কি তেমনি আছে? কথায় কথায় কান্না।'
'তোর শরীরটা তো বেশ খোট্টার মতো হয়েছে। স্বভাবটি কি তেমনি আছে? কথায় কথায় হাসি!'
এর থেকে হাসন সখীর প্রসঙ্গ। নীলু বললে, 'বেঁচে আছে। তার চেয়ে বড় কথা ভালো আছে। বিয়ের কথাবার্তা চলছে।'
'বলিস কী! এত দূর! আমি আশ্চর্য হলুম। 'আমি ভাবছি এ অসম্ভব হলো কী করে? কে তাকে এনে দিলে মুক্তা ঝরার জল? তুই, নীলু? না আর কেউ?'
নীলু আমাকে তার হোস্টেলে ধরে নিয়ে গেল। খেতে দিলে পাটনার অমৃতি আর পল্লী অঞ্চলের ঠেকুয়া। যাক, ছাতু আর লঙ্কা খেতে দেয়নি, এই ঢের। ও নাকি নিজে তাই খেয়ে খেয়ে চেহারা ফিরিয়েছে। পাশেই কোন এক মহাবীরজির আখড়ায় ডন বৈঠক ফেলে, সাঁতার কাটে গঙ্গায়।
সে কিছুতেই স্বীকার করলে না যে তার সখী সেরে উঠেছে তার আনন্দ রসায়নে। বললে, 'দু বছরের উপর আমি পাটনায়, চাঁপা দেওঘরে। ছুটির সময় দেখা হয় অল্প কয়েক দিনের জন্যে। কাজেই আমার কৃতিত্ব কতটুকু! জানিনে আর কেউ আছে কিনা ওখানে।'
পাটনায় নীলুর পড়া শেষ হয়ে গেল আমার আগে, যাবার আগে সে আমাকে খবর দিয়ে গেল যে চাঁপার বিবাহ হয়েছে কলকাতার এক ডাক্তারের সঙ্গে। বললে, 'ওঃ। কী ভাবনাই ছিল ওর জন্যে আমার। ডাক্তার শুনে ধড়ে প্রাণ এল। ও বাঁচবে বহুকাল। চিরকাল বাঁচবে ও। ডাক্তার ঠিক বাঁচাবে ওকে। তোকে বোধ হয় বলিনি যে ডাক্তারটি প্রবীণ ও প্রসিদ্ধ। হাঁ, দোজবর।'
আমি বললুম, 'নীল, মুক্তা ঝরার জল ডাক্তারখানায় মেলে না। মানুষকে যে বাঁচায় সে ডাক্তার নয়। আমি নিশ্চিন্ত হতুম, যদি তোর সঙ্গে ওর বিয়ে হত। হাসছিস যে। তোর না হয় অর্থ নেই, কিন্তু ভালোবাসা তো আছে। তুই কিসে অযোগ্য শুনি?'
'শঙ্কর', নীলু আমার দুহাত ধরে আমার দুচোখে চোখ রেখে বললে, 'তুই বিদ্বান, তুই কবি। কিন্তু বিদগ্ধ নস্। কখনো ভালোবেসেছিস কি না সন্দেহ। যদি কোনো দিন বাসিস তা হলে দেখবি দুরকম ভালোবাসা আছে। সখার সঙ্গে সখীর। প্রিয়ের সঙ্গে প্রিয়ার। চাঁপার সঙ্গে আমার ভালোবাসা দ্বিতীয় পর্যায়ের নয়, কোনো দিনই ছিল না, তুই ভুল বুঝেছিলি।'
'বুঝেছি।' আমি যেন কত বড় একটা আবিষ্কার করলুম। 'তোরা ছিলি এক হিসাবে ভাইবোন। কেমন, ঠিক ধরেছি কিনা।'
'না ঠিক নয়, বেঠিক। ভাইবোনের ভালোবাসা অন্য জিনিস। চাঁপাকে আমি বোন বলে ভাবতে পারিনে। ও আমার সখী, সই, সহেলী। এই যেমন তোর সঙ্গে আমার সখ্য তেমনি ওর সঙ্গেও। তুই কি আমার ভাই? ভাইয়ের কাছে কি সব কথা বলা যায়? তুই আমার সুহৃদ, তাই তোর কাছে আমার লুকোবার কিছু নেই। তেমনি চাঁপার কাছে।'
'কালিদাস তো গৃহিণীকেই সখী বলে গেছেন। তা হলে চাঁপা কেন তোর গৃহিণী হতে পারে না, বল আমাকে।' আমি চেপে ধরলুম।
'গৃহিণী হয়তো সখী হতে পারে, কিন্তু সখী হতে পারে না গৃহিণী। কেউ যদি জোর করে আমাদের বিয়ে দেয় তা হলেও আমরা স্বামী-স্ত্রী হব না। যদি হই তা হলে আমাদের মুখে হাসি চোখে মিলিয়ে যাবে।'
বছর পাঁচ ছয় পরে আমি বিলেত থেকে ফিরেছি, উঠেছি কলকাতার এক বিখ্যাত হোটেলে। ওরা আমার নাম খবরের কাগজে ছাপিয়েছে। ফলে অনেকেই দয়া করে আসছেন আমাকে দেখতে। বেয়ারা এক রাশ কার্ড নিয়ে এল। তাদের একখানার পিঠে ছাপা ছিল, 'নীলদ্রিনাথ গুপ্ত। মার্টিন এন্ড কোম্পানী।' পাছে চিনতে না পারি সেই জন্যে কালি দিয়ে লেখা ছিল 'নীলু'।
নীলু! আমার বাল্যবন্ধু নীলু! নীলু কলকাতায়, মার্টিন কোম্পানিতে? নীলুকেই অভ্যর্থনা করলুম সকলের আগে।
খাটো শার্ট খাটো প্যান্ট পরা এক লৌহ মানব আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করল না পাঞ্জা কষল। আমি শিউরে উঠে বললুম, 'আঃ ছেড়ে দে, ভাই। লাগে।'
'হুঁ'! বাংলা মনে আছে। আমি পরখ করে দেখছিলুম, বাংলা বেরিয়ে আসে, না ইংরেজি!'
শুনলাম চাকরিতে বেশ উন্নতি করেছে, মাইনে পাচ্ছে ইঞ্জিনিয়ারের সমান। বললে, 'সময় একদম পাইনে। এই যে তোকে দেখতে এসেছি এ অনেক কষ্টে। চাঁপার ওখানে তোর নিমন্ত্রণ। আমি তোকে ড্রাইভ করে নিয়ে যাব সন্ধ্যার পরে। তৈরি থাকবি। না, না, অন্য এনগেজমেন্ট আছে, ও কথা শুনব না। ক্যানসেল ইট। চাঁপা একেবারে অধৈর্য হয়ে উঠেছে তোকে দেখতে। ওঃ, কত কাল পরে। তুই কিন্তু তেমনি আছিস। তোর স্বভাবটিও কি তেমনি আছে?'
আমি জানতে চাইলুম চাঁপা কেমন আছে, বিয়ে সুখের হয়েছে কিনা, ছেলেমেয়ে কটি, নীলুও কি বিয়ে করেছে, ইত্যাদি। উত্তর পেলুম, নীলুর স্ত্রী চাঁপার সঙ্গে অত মাখামাখি পছন্দ করেন না, তাই চাঁপার সঙ্গে নীলুর কদাচ দেখা হয়। ওদিকে আবার ডাক্তার সাহেবেরও সেই মনোভাব, তিনিও নীলুকে প্রশ্রয় দেন না। এসব বাধাবিঘ্ন সত্ত্বেও তাদের বন্ধুতা অবিকল তেমনি রয়েছে। নীলুর একটি ছেলে, চাঁপার সন্তান হয়নি।
নীলু এক নিঃশ্বাসে উত্তর দিয়ে এক দৌড়ে প্রস্থান করলে। সময় নেই যে। সন্ধ্যার পর কথা রাখলে। ওর নিজের মোটরে করে আমাকে পেঁৗছে দিলে থিয়েটার রোডে। ডক্টর সেন আমাকে সাদর সম্ভাষণ করে তাঁর স্ত্রীর কাছে নিয়ে গেলেন। তাঁর স্ত্রীর কাছে ছিলেন আরো কয়েকটি তরুণী। শুনলুম তাঁরা সকলেই মিস। কেউ ও বাড়ির, কেউ পাশের বাড়ির। বাড়ি মানে ফ্ল্যাট। আমার কিন্তু নজর ছিল না আর কারো প্রতি। আমার দৃষ্টির সবটা জুড়েছিল চাঁপা। আমাদের হাসন সখী। আমাদের কিরণমালা। আমাদের হারানো কৈশোর।
চাঁপার গায়ের রং আবার চাঁপাফুলের মতো হয়েছে, ভরন্ত দেহ, সুঠাম গড়ন। কেবল তার চোখ দুটিতে কত কালের ক্লান্তি, কত কালের নিরাশা।
'তার পর, বন্ধু, তোমাকে বুদ্ধু বলে ডাকলে ক্ষমা করবে তো? তুমি বলব না আপনি বলব?' সে হাসল। কী তন্ময় হাসি। সে যখন যা বলে, যা করে, তন্ময় হয়ে বলে, তন্ময় হয়ে করে।
'বুদ্ধু বলতে পারো, বরুণ বলতে পারো, যা বলতে তোমার সাধ যায়, যা বললে তুমি রূপকথার স্বাদ পাও।' আমি আশ্বাস দিলুম। 'না, আপনি কেন? আপনি কবে হলুম?' সেই প্রথম থেকেই তো তুমি।'
'তুমি তো এত দেশ দেখলে, এত রাজ্য বেড়ালে, ঠিক রূপকথার রাজপুত্রের মতো। কই, তোমার রাজকন্যা কোথায়?' সে তেমনি হাসল।
'রাজকন্যা এখনো ঘুমিয়ে। সোনার কাঠি খুঁজে পাইনি।'
'কিন্তু রূপোর কাঠির খোঁজ তো পেয়েছ?'
'তা পেয়েছি, কিন্তু রূপোর কাঠি ছোঁয়ালে তো সে জাগবে না। যে জাগবে না তাকে নিয়ে আমি কী করব! আমার অন্য কাজ আছে, হাসন। আমি একজন কবি।'
এমনি কত কথাবার্তা। সব সাংকেতিক ভাষায়। সে বুঝল যে আমি তার ননদদের কাউকে, তার প্রতিবেশিনীদের কাউকে বিয়ে করব না। একটু ক্ষুণ্ন হলো। তার আশা ছিল, ওদের একজনকে বিয়ে করে আমি তার সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক পাতাব। তা হলে দেখাশোনা সুগম হবে। কিন্তু আমি নীলুর দৃষ্টান্ত দিলুম। বিয়ের পরে সব মেয়েই সমান। কেউ কারো স্বামীকে স্বাধীনতা দেবে না সখীর সঙ্গে মিশতে, নিজের বোন হলেও না, বৌদি হলেও না।
ডিনার টেবিলে আমি ছিলুম তার ডান দিকে, খেতে খেতে কথা বলছিলুম সাংকেতিকে। ডিনারের পর অন্যান্য মেয়ের দিকে মনোযোগ দিতে হলো। হাসন তাতে খুব খুশি হলো না, নীলুকে নিয়ে বসল তাস খেলতে। আমার কানে এল, 'বুদ্ধু দেখছি এক নম্বর ফ্লার্ট। বিয়ে করবে না একজনকেও, তবু সকলের সঙ্গে রঙ্গ করা চাই।'
ডাক্তার সাহেবের লক্ষ সব সময় নীলুর উপর, আমাকে তিনি প্রতিযোগী বলে গণ্য করেননি। নীলু বেচারা সমস্তক্ষণ উসখুস করছিল, তার লক্ষ একটা ক্লক ঘড়ির উপরে। দেরি করলে তার বৌ রাগ করবে। লৌহমানবও তার বৌকে ভয় করে। আমার এমন হাসি পাচ্ছিল ভাবতে। আমি তাকে রহস্য করে বললুম, 'আজ তোর কপালে ঝাঁটা আছে।'
বিদায়বেলায় চাঁপা বললে, 'আবার যখন কলকাতা আসবে, দেখা করবে তো?' বুদ্ধু, আবার যেন দেখা হয়।' কী জানি কেন আমার চোখ সজল হলো। নীলু বললে, 'চল, তোকে রেখে আসি। ইচ্ছা ছিল এক দিন আমার ওখানে ডাকতে, কিন্তু কালকেই আমাকে মফঃস্বলে বেরোতে হচ্ছে। আসছে বার কলকাতা এলে আমার ওখানেই উঠিস।'
তারপর নানা কারণে ওদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটেনি। প্রায় সাত বছর পরে ছুটি নিয়ে মিহিজামে বিশ্রাম করছি, একদিন ঠিক দুপুর বেলা একখানা মোটর এসে আমার দরজায় থামল। লাফ দিয়ে নামল একটা কুকুর, তা দেখে ছুটে এল আমার দুই ছেলে। উত্তেজিত হয়ে বললে, 'বাবা, দেখবে চলো কাদের মোটর আর কুকুর।'
বেরিয়ে দেখি সাহেবী পোশাক পরা এক ভদ্রলোক, ওভারকোট গায়ে দেওয়া শাড়ি পরা এক মহিলা। আরে, এ যে আমাদের নীলু, সঙ্গে ওর স্ত্রী রত্নাবলী। আমার স্ত্রী রান্নাঘরে ছিলেন, তাঁকে ইতিমধ্যে কুকুরের ও মোটরের খবর দেওয়া হয়েছিল, মহিলার খবর দেওয়া হয়নি। আমার ডাক শুনে তিনি বাইরে এলেন ও থাকবার নিমন্ত্রণ জানালেন। শোনা গেল নীলুরা আসানসোল থেকে এসেছে জমি কিনতে, একটু পরে আসানসোল ফিরে যাবে, থাকবে না। যদি রান্নার দেরি না থাকে খেয়ে যাবে।
আমি বললুম, 'আমরা একটার সময় টিফিন খাই, এখনো এক ঘণ্টা বাকি। চল নীলু, তোকে একখানা মনের মতো জমি দেখাই।'
নীলু রাজি হলো। তার স্ত্রী আমার স্ত্রীর সঙ্গে রান্নাঘরে গেলেন। শীতের দুপুর। হাওয়া দিচ্ছিল। আমরা পায়ে হেঁটে কতক দূরে গেলুম। মোটর এবং কুকুর রইল ছেলেদের হেফাজতে। জিজ্ঞাসা করলুম, 'নীলু, চাঁপা কেমন আছে?'
নীলু উত্তর দিলে, 'সে অনেক কথা। আরেক দিন বলব।'
'আরেক দিন মানে তো আরো সাত আট বছর। তার চেয়ে তুই যেটুকু পারিস বল।'
'আচ্ছা। তবে সারাংশটুটু বলি।'
বিয়ের অল্প কয়েক দিন পরেই তার স্বামী তাকে বলেন অপারেশন করতে হবে। কিসের অপারেশন, চাঁপা অত শত বোঝে না। মত না দিলে যদি প্রাণসংশয় হয় সে কথা ভেবে মত দেয়। অপারেশনের পরে টের পায় চিরজীবনের মতো বন্ধ্যা হয়েছে। তার মনে দারুণ আঘাত লাগে। নীলুকে বলে, আর বেঁচে থেকে কী হবে! কী হবে প্রাণ রেখে, যদি প্রাণ দিতে না পারি! নীলু বলে, কত মেয়ে বন্ধ্যা হচ্ছে নৈসর্গিক কারণে। মনে করো, তুমিও তাদের একজন। তোমার স্বামীর চার পাঁচটি ছেলেমেয়ে, তারা তোমাকে মা বলে। তুমি তাদের মানুষ করে তোল, প্রচুর বাৎসল্য রস পাবে।
কিন্তু কিছুদিন পরে ভদ্রলোক তাঁর ছেলেমেয়েদের অন্যত্র সরালেন। বাড়িতে রইল তাঁর ভাই বোন, চাঁপার ননদ দেওর। তাদের নিয়ে চাঁপার সময় কাটত মন্দ না, কিন্তু তাদের সঙ্গ পেয়ে তার হৃদয় ভরবে কেন! স্বামীর সঙ্গ পাওয়া ভার, তাঁর পসারের ক্ষতি তিনি সইতে পারেন না, আর পসারও তাঁর অসাধারণ। সে নীলুকে চিঠি লেখে ফোন করে, সাধে। কিন্তু নীলুরও কি উপায় আছে! তারও যে ঘরে বাইরে হাকিম, এখানে জবাবদিহি, ওখানে কৈফিয়ৎ। নীলু পরামর্শ দিলে, চাঁপা, তুমি একটা কোনো কাজ বেছে নাও। কাজ করো, কাজ করে যাও। পৃথিবীতে আমরা হৃদয় ভরাতে আসিনি, এসেছি মাটি খুঁড়তে, বাড়ি গড়তে, রাস্তা বানাতে, শহর বসাতে, ভোগোপকরণ উৎপাদন করতে, শিক্ষা বিস্তার করতে, স্বাস্থ্য বর্ধন করতে, আনন্দ দিতে ও পেতে। চাঁপা, তুমি যে কোনো একটা কাজ বেছে নাও, তা হলেই বাঁচবে।
সে এক এক করে অনেক রকম কাজে হাত দিলে, কিন্তু দিতে না দিতে গুটিয়ে নিলে। বললে, আমার পুরী কবে নির্মাণ করবে, তাই বল? অরুণ বরুণ, কবে আনবে মুক্ত ঝরার জল, সোনার বরণ পাখি? আমি এ বাড়িতে বাঁচব না, অরুণ। আমাকে আমার নিজের বাড়ি দাও। কত লোকের বাড়ি তৈরি করো, সখীর বাড়ি তৈরি করতে পারো না?
বাস্তবিক এর কোনো উত্তর নেই। ইচ্ছা করলেই নীলু পারে হাসনকে তার নিজের বাড়ি দিতে। অবশ্য মুক্ত ঝরার জল কিংবা সোনার বরণ পাখি দেওয়া তার সাধ্য নয়। শঙ্করেরও অসাধ্য। কিন্তু বাড়ি! মনের মতো বাড়ি দিতে পারবে না সখীকে। নীলু ভাবে কিন্তু উপায় খুঁজে পায় না। মনের মতো একখানা বাড়ি মানে কত কালের সঞ্চয়। স্ত্রীকে বঞ্চিত করে সখীকে দেবে তার সঞ্চয়! তা কি হয়! রত্না কী মনে করবে! সমাজ কী মনে করবে! নীলু পিছিয়ে যায়। কথা দিতে পারে না। চাঁপা একেবারে অবুঝ। যে মানুষ লক্ষ লক্ষ টাকার বাড়ি তৈরি করেছে সে মানুষ পাঁচ সাত হাজার টাকার বাড়ি তৈরি করতে পারত না! তার কি টাকার অভাব! আর দেওঘর তো সস্তা।
ডাক্তারের টাকার অভাব নেই, চাঁপা চাইলেই সাত হাজার টাকার চেক পায়। কিন্তু চাইবে কী করে! ডাক্তার কি অরুণ বরুণ, বুদ্ধু ভূতুম! তিনি তাকে দয়া করে বিয়ে করেছেন, যত্ন করে বাঁচিয়ে রেখেছেন, পারত পক্ষে অবহেলা করেন না, কিন্তু তাঁর কাছে কি সখীর মতো দাবি করা চলে। না, তাঁর সঙ্গে তেমন সম্পর্কই নয়। কোন সুবাদে চাইবে!
নীলু কিছু করলে না, পরিণামে চাঁপার আবার জ্বর হতে লাগল এবং সে কথা শুনে নীলুর মনে হলো সে-ই দায়ী। তখন সে দেওঘর মধুপুর গিরিডি অঞ্চলে জমি খুঁজতে শুরু করে দিলে রত্নাকে না জানিয়ে! বাড়িও তৈরি হলো বেনামীতে মধুপুরে। খরচ যা পড়ল তা এল বোনাস থেকে। কিন্তু প্রশ্ন উঠল, বেড়ালের গলায় ঘণ্টা পরাবে কে? ডাক্তারকে সমঝাবে কে যে মধুপুরে না গেলে চাঁপার শরীর সারবে না? কে তাঁকে বিশ্বাস করাবে যে সেখানে চাঁপার আপন বাড়ি আছে? চাঁপার আত্মীয়দের একে একে ডাক পড়ল। তাঁদের জেরা করে ডাক্তার জানতে পারলেন তাঁকে ধোঁকা দেওয়া হচ্ছে। শেষকালে একটা মনোমালিন্য ঘটল। চাঁপা চলে গেল মধুপুর। বছর খানেক সবুর করে সেন আবার সাদী করলেন।
চাঁপা সে কথা শুনে দুঃখিত হলো না, বরং অভিনন্দন জানালে। নীলু তো চটেমটে লাল। বোকা মেয়ে, নিজের স্বার্থ বোঝে না। আর হতভাগা ডাক্তার, কেবল শরীরটি বোঝে। মানুষের যেন মন বলে কোনো পদার্থ নেই। কিন্তু নীলুর চোখ কপালে উঠল যখন চাঁপা লিখলে, আমি একা থাকলে মরে যাব। অরুণ বরুণ, তোমরাও এখানে এসো। আবার আমরা হাসব, আমরা গল্প করব, গান করব, রাঁধব আর খাব। তোমরা আনবে মুক্তা ঝরার জল, অর্থাৎ অফুরন্ত জীবন। তোমরা আনবে সোনার বরণ পাখি, সোনালি রঙের শুক, অর্থাৎ সুখ। অরুণ বরুণ, তোমরা কবে আসবে?
এক বার নয়, দুবার নয়, বারবার আসতে লাগল চিঠি। নীলু আর চুপ করে থাকতে পারলে না, গেল মধুপুর। দেখলে সখী শুকিয়ে যাচ্ছে চাঁপা ফুলের মতো। ওকে বাঁচিয়ে রাখার একমাত্র পন্থা ওর সঙ্গে সময় কাটানো। কিন্তু সময় যে বয়সসুলভ ছিল সে বয়সে তো আর নেই। এখন সময় মানে টাকা, টাকা প্রাণধারণের উপায়। নীলু ওকে অনেক কিছু দিতে পারে, কিন্তু সময় দেবে কী করে? নিজের স্ত্রীকেই সময় দিতে পারে না, রোজ ঝাঁটা খায়। ঝাঁটা নয় খোঁটা, একই কথা। পরের স্ত্রীকে সময় দেবে? বাপ রে! সমাজ ফোঁস করে উঠবে না? সমাজের কথা দূরে থাক, ঘরের লোকটি কি রক্ষা রাখবে?
নীলু অনেক খরচ পত্তর করে ওর জন্যে সঙ্গিনী নিয়োগ করলে। বই কিনে দিলে। গ্রামোফোন, রেডিও, রিফ্রিজারেটর কিনে দিলে। ওর বসবার ঘর শোয়ার ঘর ডিস্টেম্পার করা হলো। মার্বেল পাথর আনিয়ে মেঝে বাঁধিয়ে দেওয়া গেল। তা সত্ত্বেও সখী বলে, ওতে আমার হৃদয় ভরবে না। আমি চাই বান্ধব বান্ধবী। বান্ধবীদের সকলের বিয়ে হয়ে গেছে। কেউ আমার চিঠির জবাব পর্যন্ত দেয় না। এমনকি, মিনতি, যার সিঁথির সিঁদুর মুছে গেছে সেও আমার কাছে আসবে না। তুমি একমাত্র বান্ধব যে আমাকে বাঁচাতে সাহায্য করেছ। আর সবাই স্বার্থপর। ভূতুম, তোমার কাছে আমি চিরঋণী। এ ঋণ জন্মান্তরেও শোধ হবে না। জন্মান্তরে যেন তোমার মতো বন্ধু পাই। তোমাকেই বন্ধু রূপে পাই।
'তারপর?' আমি এতক্ষণ পরে কথা কইলুম।
'তারপর?' নীলু শুকনো গলায় বললে, ''আমি তার আত্মীয়দের অনুনয় বিনয় করলুম, টাকা দিতে চাইলুম, কিন্তু কেউ কেন রাজি হবে তার কাছে থাকতে? তাদের প্রাণের দাম আছে, তারা সংসারী মানুষ, তাদের উপর নির্ভর করছে বহু অসহায় প্রাণী। তারা বললে, 'দাও ওকে কোনো স্যানিটরিয়ামে পাঠিয়ে। ভাওয়ালীতে কি মদনপল্লীতে। অন্ততপক্ষে যাদবপুরে। আমরাও সাহায্য করব।' বোঝে না যে মধুপুরে ওর নিজের বাড়ি, ওর 'মায়াপুরী', ওখান থেকে ও কোথাও যায় তো স্বর্গে।''
'তারপর, ও কি এখনো সেইখানে আছে, না স্বর্গে?'
'তারপর, আমি সমস্ত খুলে বললুম আমার সহধর্মিণীকে। বললুম, ও যদি মরে যায় তো আমার ভিতরটা শুকিয়ে যাবে, ঝুনো নারকেলের মতো। তুমি কি তেমন স্বামী নিয়ে সুখী হতে পারো, রত্না? যদি না হও তো আমাকে ক্ষমা করো, আমাকে অনুমতি দাও মাঝে মাঝে ওর ওখানে হাজিরা দিয়ে আসবার, অবশ্য উঠব আমি ডাক-বাংলোয়। তুমিও যেতে পারো আমার সঙ্গে। রত্না যখন দেখলে যে আমার ভিতরের মানুষটাই মরতে বসেছে তখন অনুমতি দিল। কিন্তু আমার সঙ্গে যেতে রাজি হলো না। এই ভাবে দুবছর কাটল। সখী আবার সজীব হলো, তার রং ফিরল, হাসি ফুটল। মনে হলো তার সুখ না থাকলেও দুঃখ নেই। কিন্তু ওটা আমার মনের ভুল। ভিতরে ভিতরে ও শুকিয়ে যাচ্ছিল ঠিকই। সখ্যের অভাবে নয়, প্রেমের অভাবে। আমি তার কী করতে পারি!'
'থাক', আমি সান্ত্বনা জানালুম, 'যে যাবার সে গেছে, তার কথা ভেবে মন খারাপ করিসনে। তুই তোর যথাসাধ্য করেছিস। সংসারে এই বা কজন করে। তুই আদর্শ বন্ধু।'
'কিন্তু ও বেঁচে আছে। হ্যাঁ, বেঁচে আছে। ভালো আছে। সুখে আছে। ও পেয়ে গেছে মুক্তা ঝরার জল, সোনার শুক পাখি।'
'য়্যাঁ! এ অসম্ভব সম্ভব হলো কী করে! করলে কে!'
'ওরই মতো এক যক্ষ্মা রোগী। মধুপুরেই ওদের আলাপ। ওরা এখন এক সঙ্গেই থাকে। আমি কিছু বলিনে। দেখেও দেখিনে শুনেও শুনিনে। জীবন বড় না নীতি বড়? মানুষ বড় না সমাজ বড়? শঙ্কর, তুই তো কবি ও সাহিত্যিক। তোর কী মনে হয়?'
উচ্ছ্বাস আমার কণ্ঠ রোধ করেছিল। কোনো মতে বলতে পারলুম, 'ওরা নিরাময় হোক!' কলকাতায় নীলুর সঙ্গে আবার দেখা হয়েছিল এই সেদিন। রবীন্দ্র জন্মদিন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত এক আসরে। রত্না ছিলেন সঙ্গে। কুশল-বিনিময়ের পর ওকে একান্তে টেনে নিয়ে শুধালাম, 'সখীর খবর কী?'
'ভালো আছে। ওদের জীবন পরিপূর্ণ হয়েছে। ওরা এখন তিন-চারটি ছেলেমেয়ের মা বাপ।'
আমি চমকে উঠলুম। 'বলিস কী! হলো কী করে!'
নীলু হেসে বললে, 'হয়নি। রুগ্ন দেখে আশ্রয় দিয়েছে। হাসন তাদের আপন সন্তানের মতো ভালোবেসে মানুষ করছে।'
'খরচ জোগায় কে?'
'যে জোগাত সেই জোগায়।'
'রত্না জানে?'
'জানে। তারও তো মায়ের প্রাণ। এত দিনে তার গ্লানি মুছে গেছে। আমাকে আর ঘরে-বাইরে সংগ্রাম করতে হয় না।'
আমি তার হাতে হাত রেখে বললুম, 'নীল, তোকে যদি ফলো করতে জানতুম ধন্য হতুম। চাঁপার সঙ্গে দেখা হলে বলিস, যে বাঁচায় সেই বাঁচে।'
   কেয়া আমি এবং জার্মান মেজরআবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
অঙ্কন : সুমন
¦

কেয়া আমি এবং জার্মান মেজর
কেয়া আমি এবং জার্মান মেজরআবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
আমি তখন ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করছিলাম। হঠাৎ ক্রিং ক্রিং শব্দে টেলিফোন বাজল। শব্দটা যেন সন্ধ্যার ধূপের ধোঁয়া। কিছুক্ষণের জন্য আচ্ছন্ন করল আমার চোখে দেখার এবং চিন্তা করার ক্ষমতা। এই পনেরো দিন যন্ত্রটা ছিল মৃত। রিসিভার তুলেও কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া যেত না। হঠাৎ সেই মৃত যন্ত্রটা (না জন্তুটা) পুনর্জীবন পেতেই অদৃশ্য প্রেতের মতো মনে হলো শব্দটাকে। ধোঁয়া থেকে যেন শরীর ধারণ করছে। একটা হিম হিম ভৌতিক পরিবেশ ঘরটায়। উত্তরের জানালাটা খোলা। লাইটপোস্টের সঙ্গে একটা ফেস্টুন তখনও ঝুলছে। এপ্রিলের বাতাসে এখনো শীতের ছোঁয়া। হঠাৎ মেঘ গর্জালো। মুনসুনও বুঝি এবার আগেই শুরু হবে।
টেলিফোন তখনো বাজছে। মেঘের শব্দে দেখার এবং চিন্তা করার ক্ষমতাটা ফিরে এলো। কেয়া বাইরের ঘরে আলো জ্বালতে দেবে না। শাড়ির খসখসানি শুনে বুঝলাম কাছেই আছে। মাথার চুলে সুগন্ধী তেলের ঘ্রাণ। এক মাস আগে ওর এক বান্ধবী কলকাতা থেকে ফিরে এসে উপহার দিয়েছিল। আজ পনের দিন পরে চুল ধুয়েছে কেয়া। মাথায় তেল মেখেছে। অন্ধকারেও মনে হলো ওকে এখন কিছুটা স্বাভাবিক ও সহনীয় দেখাচ্ছে।
'রিসিভার তুলে আগেই সাড়া দিয়ো না। দ্যাখো কে ডাকছে? ফ্রেন্ড অর ফো।' ও বলল।
অনেকটা ভূতে পাওয়ার মতোই এগিয়ে গেলাম। এমন হয় না আমার। টেলিফোন বাজলেই ছুটে যাওয়া আমার অভ্যেস। এই নিয়ে কেয়ার সঙ্গে আমার প্রতিযোগিতা। কে আগে টেলিফোন ছোঁবে। এ যেন অনেকটা বুড়ি ছুঁয়ে কানামাছি খেলার মতো। খেলায় কেয়াই জিতত। কেয়ার শরীর স্লিম। দুটো বাচ্চা হওয়ার পর মেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েছে। তবুও মেদ জমেনি শরীরে। ক্ষিপ্রতায় হরিণী না হোক খরগোশ তো বটেই। সেই তুলনায় আমি একটু মুটিয়ে গেছি। বেশ নাতিপোয়া ভুঁড়িটা পাঞ্জাবির উপরেও দৃশ্যমান। কেয়া মাঝেমধ্যে সস্নেহে হাত বুলিয়ে দেয়। আবার এ কথাও বলে, 'এবার ওটাকে সামলাও। হাঁটো, না হয় ডায়েট করো। নইলে আর কিছুদিন পর আমার অ্যাডভানসড স্টেজের অবস্থা হবে।' উপমাটার শ্লীলতাবোধ নিয়ে অনেক দিন তর্ক করেছি। এখন করি না। করার প্রয়োজন নেই। দিন দুই আগে কেয়া হঠাৎ সবিস্ময়ে আবিষ্কার করেছে আমার নাতিপোয়া ভুঁড়িটা অপস্রিয়মাণ। জামার অগ্রভাগ-যা এই কিছুদিন আগেও পেটের ওপর ফুরফুর করছিল নৌকার মাস্তুলে বাঁধা কাপড়ের মতো, এখন সেটাও পেটের সঙ্গে বেশ শান্ত হয়ে লেপটে আছে। ডায়েট নয়, হাঁটাহাঁটি নয়, কেবল উদ্বেগ-পনেরো দিনের নিদারুণ উদ্বেগেই শরীরের ফ্যাট সব শুকিয়ে গেছে। এখন আমি অনেকটা কৃশতনু কেয়ার মতোই। এই দুর্বিষহ মুহূর্তে এটাই একমাত্র সহনীয় চিন্তা মনে হয়।
রিসিভার তুলে মাউথ পিসের ওপর হাত চাপা দিলাম। রুদ্ধ নিঃশ্বাস দাঁড়িয়ে অপর প্রান্তের গলা শোনার অপেক্ষা করলাম।
মনে হলো ঝড় বইছে। অথবা টেলিফোন নামক সেই মৃত জন্তুটাই পুনর্জীবন পেয়ে হাঁপাচ্ছে। বাইরে একটা কর্কশ বোমা ফাটার শব্দ হলো। কেয়া চকিতে আমার জামার খুঁট ধরে টান দিল, 'রিসিভারটা রাখো।' বললাম, 'কোনো মিলিটারি ট্রাক। ব্যাক ফায়ারের শব্দ। ভয় পেয়ো না_' কেয়া বলল, 'তা হোক' সে আমার ঘনিষ্ঠ হলো আরো। বললাম, 'ভয় পেয়েছো, আলোটা জ্বালব?'
'না, না।' একটা শব্দের নহর বয়ে গেল আমার শরীরে। অন্ধকারেই মনে হলো সে বুকের আরো কাছে সেঁধিয়ে এসেছে। আমার বাঁ হাতের মুঠোয় যেন বন্দুকের বাঁট। ডান হাতের আড়ালে আহত হরিণী। ঢাকা থেকে একবার খুলনা হয়ে সুন্দরবনে গিয়েছিলাম হরিণ শিকারে। মনে পড়ল সেই কথা। সেই মানুষখেকো বাঘের দেশে যে ভয় পাইনি, তার চেয়েও বেশি ভয়ে এখন কাঁপছি মধ্য ঢাকার এক ফ্ল্যাট বাড়ির ড্রয়িংরুমে টেলিফোনের রিসিভার হাতে।
সেই ঝড়ের শব্দটা থেমে গেল। থেমে গেল সেই অস্পষ্ট যান্ত্রিক গোঙানি। ঝড়ের পরে শান্ত হওয়া, স্নিগ্ধ সুরভিত হাওয়া। সেই ঘ্রাণের স্বাদে ইন্দ্রিয় লোভী হয়ে ওঠে। ভয়ের শিহর থেকে জীবনের শিহরণ। তার আগেই কেয়ার তেলমাখা মাথাটা আমার বুকের কাছ থেকে ধীরে ধীরে সরে গেল। কেয়া সরে গিয়ে চেয়ারের হাতলের ওপর হাত রাখে। অন্ধকারে অনৈসর্গিক হয়ে উঠল ওর শরীর। টেলিফোনের অদর্শন কণ্ঠের মতো গলা, 'বুঝতে পারছো কে কথা বলছে?'
কেউ কথা বলেনি। আমি রিসিভারটা নামিয়ে রাখতে গেলাম।
'তাহলে টেলিফোনটা বাজল কেন?' কেয়ার গলায় আবার ভয়ের শিহর।
'হয়তো বন্ধুবান্ধবদের কেউ খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করছে।' আমি থেমে থেমে বলি। যেন চোখের সামনে থেকে অন্ধকার তাড়িয়ে বলছি। অন্ধকার তো মশা নয়, মাছি নয় যে তাড়ালেই যাবে। যতই প্রখর হোক না চোখের দৃষ্টি, অন্ধকার যেন আরো বেশি প্রাখর্য নিয়ে চোখের সামনে কালো পর্দার দেয়াল তুলে দাঁড়ায়। কেয়ার কণ্ঠ সেই নিরেট দেয়ালেই যেন বারবার আঘাত করে। সারা ঘরে তার প্রতিধ্বনি রমরম করে।
'একটু আস্তে কথা বলো।' আমি বলি।
'আমি তো ফিসফিসিয়ে কথা বলছি!' কেয়া চেয়ার ছেড়ে কাছে এগোয়।
'টেলিফোন লাইন ওরা রেসটোর করেছে মনে হয়। এদ্দিন পরে এখন বাজল তাই ভয় হচ্ছে।'
'ভয়টা কিসের?'
'ওটা ট্রাপ করার নতুন ফাঁদ হতে পারে। জাসট দেখছে আমরা কারা বাসার ভেতরে রয়েছি। ওই যে তুমি ফোনের রিসিভার তুললে, তাতেই ওরা ধরে নেবে বাসার ভেতরে কেউ না কেউ রয়েছে। লেক সার্কাসে আমাদেরই মতো কয় ঘর ফ্যামিলি বাইরে দরজায় তালা ঝুলিয়ে ঘর অন্ধকার রেখে রাত কাটাচ্ছিল। ফোন বাজতে রিসিভার তুলতেই ধরা পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে একটা মিলিটারি লরি এসে দাঁড়িয়ে ছিল বাড়ির সামনে।
'তারপর?' কেয়ার গলা নয়, আমার গলাই এবার কেঁপে উঠল।
'ওরা কাউকে মারেনি। কাউকে কিছু বলেনি। লরিতে একজন মেজর ছিল সে কেবল সোনিয়াকে নিয়ে গেছে।'
'সোনিয়াকে। হায় আল্লাহ!' আমি টেলিফোনের সাদা ধাতব যন্ত্রটার ওপর ভর করে শরীরের ব্যালান্স ঠিক রাখার চেষ্টা করি। কেয়ার মুখটা দেখা যায় না। কেয়া এখন অপার্থিব, অলৌকিক জগৎ থেকে যেন টেলিফোনে কথা বলছে। ওর গলায় সেই ভয়ের শিহর থির থির কাঁপছে শরীরে। ওর ভয় নেই। অন্ধকার ওর ভয়কে আবৃত করে রেখেছে।
সোনিয়াকে আমি চিনি। লেক সার্কাসের মেয়ে। পোস্ট গ্র্যাজুয়েটের ছাত্রী। কেয়াই আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। লেক সার্কাসের কামেলা আপার মেয়ে। সয়েল সায়েন্সে ডিগ্রি নিয়েছে। সামনের বছর স্টেটসে যাবে গবেষণার জন্য। তা ছাড়া ...
আমার কনুইয়ে আলতো করে একটা চিমটি কেটেছিল কেয়া, 'ওর হবু স্বামী জুট টেকনোলজিস্ট ডান্ডিতে আছে। কলেজে সেই ফার্স্ট ইয়ার থেকে ভালোবাসা। মাগো কি লম্বা চিঠি লেখে সেই পাটবিশেষজ্ঞ। তুমি দেখলেও হাসবে।'
সোনিয়া তার রং করা ঠোঁট ফাঁক করে সাদা মার্বেলের মতো ঝকঝকে দাঁতে হাসির ঝিলিক ছড়িয়ে বলেছিল, 'মাঝে মাঝে আমিও বড় বেশি বোর ফিল করি।'
'সেই সোনিয়া! সেই সোনিয়া গেল মেজরের সঙ্গে?'
'কী করবে ও? কী করতে পারত ও?' কেয়ার গলা এবার তীক্ষ্ন, অথচ উত্তেজনা নেই। 'ধরো এখনই যদি ওদের কেউ এসে তোমার বুকে বন্দুক ধরে আমাকে ওদের টার্ম শোনায়। কী করতে পারি আমি?'
'কী করতে পারি মানে?' আমার গলা এবার টাইম বোমার মতো বিস্ফোরিত হলো। বিস্ফোরিত হয়েই থেমে গেল। আমার কথাগুলোই যেন টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল সারা ঘরে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে ভাঙা কাচের মতো নিমিষে চূর্ণ হয়ে গেল। অনুরেণু হয়ে ধুলোয় মিশে গেল। আমার আর বলার কথা_ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেওয়ার মতো কিছু রইল না।
অন্ধকারে কেয়ার শ্বাসপতনের শব্দ শুনলাম। চেয়ারটার ওপর গুটিয়ে বসেছে সে। নীল বুটিতোলা সবুজ পাড়ের সাদা শাড়ি তার পরনে। কুয়াশার ভোরে নদীর পারে চোখ ফেরালে যেমন দেখায়_আলো নয় অথচ অন্ধকারও নয়, ধূসরও নয়, একটা অস্পষ্ট প্রতিভাস। কেয়ার শাড়ি ঘরের অন্ধকারে সেই প্রতিভাস। আমি সেই প্রতিভাস লক্ষ করে এবার সহজ গলায় বললাম, 'সোনিয়া আর বাড়ি ফেরেনি?'
'ফিরেছে। রোজ সকালে ফিরে আসে। মিলিটারি জিপে। বাবাকে বলেছে, ওর বড় ভাইয়ের আর ভয় নেই। ওর বড় ভাই পলিটিঙ্ করত। এখন ফেরার। মেজর আশ্বাস দিয়েছে, ধরা পড়লে অ্যারেস্ট করবে। মারবে না।'
'পাড়ার বাসিন্দারা কিভাবে নিয়েছে ব্যাপারটা?'
'সহজভাবে। সহজভাবে নিতে তারা বাধ্য। কী করতে পারে ওরা? তাদের কারো ঘরে ব্যাপারটা ঘটতে পারত। ঘটেনি এ জন্য সোনিয়ার কাছে তারা কৃতজ্ঞ। ওরা জানে, সোনিয়া রোজ সন্ধ্যায় চলে যায়, সকালে ফিরে আসে।'
কোথাও মেঘ গর্জাল। মেঘ অথবা মর্টার দুয়ের শব্দই হতে পারে। কেয়া চট করে চেয়ার ছেড়ে পাশে এসে দাঁড়াল। ফিসফিসিয়ে বলল, 'আমি বাজি ধরে বলতে পারি, ওরা কোথাও গোলা ছুড়ল!'
'গোলা ছুড়বে কেন?'
'মানুষ মারার জন্য।'
মৃত্যু এত সহজ হয়ে উঠবে আমাদের জীবনে কোনো দিন ভাবিনি। কেয়ার একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় তুলে নিলাম। মৃত্যুকে পরাস্ত করে বেঁচে ওঠার প্রয়াসের মতো এই স্পর্শ। কেয়ার হাত নরম এবং ঠাণ্ডা। ফিসফিসিয়ে বলল, 'আমি ভাবছি সোনিয়ার কথা। আচ্ছা, ওরা যদি আমাকে সোনিয়ার মতো ধরে নিয়ে যায়, নেওয়াটা যেখানে এমন বেশি কিছু নয়, তাহলে তুমি কী করবে?'
'আমি?' প্রশ্নে আকস্মিকতায় আমি বিব্রত। মেয়েরা বিব্রত মুহূর্তে এমন বিভ্রান্ত করে দিতে পারে প্রশ্নের আঘাতে, আমি ভাবি।
কেয়া বলল, 'হ্যাঁ, তুমি। বাচ্চা দুটোর জন্য এখন ভাবি না। এটা আল্লার মেহেরবানি, ওরা গণ্ডগোল শুরু হওয়ার আগেই গ্রামে নানির কাছে চলে গেছে। ওদের নিয়ে আপাতত আমি ভাবি না; কিন্তু নিজেকে নিয়ে ভাবি। কাল রাতেই নাকি দুটো ট্যাঙ্ক এসে ঘুরে গেছে এ পাড়ায়। উপরের ফ্ল্যাটের খালেক সাহেব তাঁর ফ্যামিলি পাঠিয়েছেন গ্রামে। পাড়া বলতে গেলে খালি হয়ে গেছে। তুমি তো নড়তে চাও না এবং আমিও না। কোনো কোনো গ্রামে এর চেয়েও অঘটন ঘটেছে। ধরো, সোনিয়ার মতো অঘটন যদি আমার জীবনেও ঘটে? কী করবে তুমি?'
জবাব নেই এ কথার। আর থাকলেও এই মুহূর্তে আমার জানা নেই। আমার হাতের মুঠো শিথিল হলো। শিথিল মুঠো থেকে কেয়ার হাতটা ঝরে পড়তে চাইল। অন্ধকার অসহ্য মনে হলো। বললাম, 'কেয়া, এক সেকেন্ডের জন্য হলেও আলোটা একটু জ্বালাবে।'
'বেশ, সুইচটা অন করে দাও।' ঠাণ্ডা ভিজেভিজে গলা কেয়ার।
কিন্তু সুইচটা অন করতে হলো না। তার আগেই টেলিফোনটা আবার বেজে উঠল।
'খবরদার, ওটাকে ছুঁয়ো না।' কেয়ার গলা বড় ক্রূর মনে হলো আমার কাছে। দু'পা পিছিয়ে গেলাম। টেলিফোন বেজে চলেছে। স্বৈরিণী শব্দ যদি এখন শরীরিণী হয়ে উঠতে পারত, তাহলে, কেয়ার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ঝগড়া করত, কেন, তুমি আমায় ছুঁতে দিচ্ছ না? কেয়াও আমার কাছে এখন শব্দ। অন্ধকারে তার শরীর দেখা যায় না। একদিকে কেয়ার কণ্ঠে নিষেধ। অন্যদিকে টেলিফোনের ধাতব কণ্ঠে আমন্ত্রণ। কিছুক্ষণ ভেবে দ্বিধা জয় করলাম। কেয়ার কথা-ই রইল। টেলিফোনটা বেজে ক্লান্ত হয়ে থামল। বললাম, 'কেয়া, এবার ভেতরে আলো জ্বেলে খেতে দাও। রেডিওটা লো ভলিউমে অন করবে নাকি?'
'না। হুক্কামে মার্শাল ল' শোনার ইচ্ছে আমার নেই। আমি ভেতরে যাচ্ছি।'
এবার দরজায় মৃদু অথচ স্পষ্ট টোকা। থেমে থেমে একবার দু'বার তিনবার। আমরা নিশ্চয়ই পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়েছি। আমি আর কেয়া; কিন্তু অন্ধকারে কেউ কাউকে দেখলাম না।
আবার টোকা। আরো স্পষ্ট। আমি দরজার দিকে এগোলাম। কেয়া ফিসফিসিয়ে বলল, 'আমি ও ঘরে যাচ্ছি। তুমি নাম জিজ্ঞেস করো।'
দরজার হাতলে হাত রেখে বললাম, 'কে?' আমার গলা কেঁপে গেল। এবার ভারী গলার উর্দু কথা এবং ভারী বুট পরা পায়ের শব্দ আশঙ্কা করলাম। তার বদলে আমারই কম্পিত গলার সাড়া পাওয়া গেল, 'সুলেমান সাহেব ঘরে আছেন?'
'কে?'
'আমি উপরের ফ্ল্যাটের রহমান। হবস অ্যান্ড রব কম্পানির ম্যানেজার।' আমি ঝটিতি দরজা খুলে দিলাম, 'আরে আসুন আসুন রহমান সাহেব। আলো জ্বালা বারণ, মার্শাল ল অথরিটির নয়, স্ত্রীর। কমপ্লিট ব্ল্যাক-আউট।'
রহমান বললেন, 'আমারও তাই; কিন্তু এইমাত্র একটা মিলিটারি লরি কী অর্ডার প্রচার করে গেল জানেন?'
কেয়া কখন ফের ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে জানি না। সেই বলল, 'কী অর্ডার বলুন তো? আমরা নিচের তলায় থাকি। অনেক সময় মাইকের ঘোষণাও শুনি না।'
রহমান অন্ধকারেই হাতড়ে একটা চেয়ার টেনে নিলেন। বললেন, 'ঘরে আলো নেভানো চলবে না। রেডিও রেকর্ড প্লেয়ার বাজাতে হবে; অর্থাৎ কমপ্লিট নরম্যালসি দেখাতে হবে।'
কেয়া বলল, 'যদি হুকুম মানা না হয়।'
রহমান বললেন, 'মিলিটারির হুকুমে যদি বলে কিছু নেই। হিটলার প্যারিস দখল করার পর যা করেছেন, ইয়াহিয়াও তাই করতে চান ঢাকা দখলের পর।'
'হিটলার কী করেছেন প্যারিসে?' কেয়ার গলাটা কেঁপে উঠল, আমার মনে হলো।
রহমান সশব্দে একটা দিয়াশলাইয়ের কাঠি ধরালেন। বললেন, 'এঙ্কিউজ মি ম্যাডাম, আপনার অনুমতি সাপেক্ষে একটা সিগারেট ধরাচ্ছি। গলাটা অনেকক্ষণ যাবৎ খড়খড়ে হয়ে আছে।'
অনেকক্ষণ পর নিবু নিবু আলোয় দেখলাম কেয়াকে। আলোয় উদ্ভাসিত কেয়ার পাথুরে স্ট্যাচু যেন। শীর্ণ চোয়াল। চোখ জ্বলছে। শীতের নদীর দূর থেকে বাঁক ঘোরার আলোর সংকেত যেমন দেখায়, তেমনি দেখাচ্ছে কেয়ার দু'চোখের মণি। শাড়ির নীল বুটি আর সবুজ পাড় এখন এক। কেয়া বলল, 'আপনারা ভেতরে বেডরুমে বসে গল্প করুন। আমি দু'কাপ চা করে দিচ্ছি।' রহমান বললেন, 'আমি চা খেতে আসিনি। নতুন মার্শাল ল অর্ডার শুনে ভাবলাম, আপনারা কী ভাবছেন শুনি? বার দুই টেলিফোনে ডাকলাম, সাড়া পেলাম না। আমার টেলিফোনটা আজই রেসটোর করে দিয়েছে। আপনার দেয়নি?'
সত্য কথাই বললাম, 'দিয়েছে; কিন্তু কল রিসিভ করছি না। কেয়া লেক সার্কাসের যে কাহিনী শোনাল, তাতে টেলিফোন বাজলেও রিসিভার তোলার ভরসা পাই না।'
রহমান বললেন, 'লেক সার্কাসের কাহিনী তাহলে আপনারাও শুনেছেন। ওটা আমার স্ত্রীর ভাই_মানে মেজো শ্যালক বহন করে এনেছে। ও লেক সার্কাসে থাকত কি না!'
কেয়ার দিকে তাকিয়ে রহমান বললেন, 'আপনি আবার শুনেছেন আপনার স্ত্রীর কাছে তাই না?'
ছোট্ট দম দেওয়া পুতুলের মতো কেয়া মাথা নাড়ল। রহমানের হাতে দিয়াশলাইয়ের কাঠিটা নিভে গেল। অন্ধকারে আমরা তিনজনই মুছে গেলাম। আমার সেই ছেলেবেলার শ্লেটে লিখে লিখে মুছে ফেলার খেলার কথা মনে পড়ল। কালো শ্লেটে পেনসিলের দাগ বোলালেই সাদা সাদা লেখা। মুছে ফেললেই আবার কালো শ্লেট। আমরা যেন এতক্ষণ ছিলাম অন্ধকারের কালো শ্লেটে তিনটে সাদা দাগ। এইমাত্র কেউ আমাদের মুছে ফেলল। পেনসিলের মতো কালো সুইচ টিপলেই আমরা আবার ফুটে উঠব।
কেয়া এবার সত্যি সত্যি সুইচ টিপল। উত্তরের জানালাটা বন্ধ করে দিল। উদ্ভাসিত আলোয় আমরা অনেক দূর থেকে পরস্পরের যেন অনেক কাছাকাছি এলাম। রহমান বললেন, 'আলোটা জ্বেলে ভালোই হলো। না জ্বেলেও বাঁচোয়া নেই। ওদের মেথড বড় ক্রুয়েল। এই যে বেঁচে আছি এটাই বিস্ময়, বেঁচে না থাকাটা নয়।'
দূরের কোথাও টা-টা-টা শব্দ হলো। আমি আড় চোখে কেয়ার দিকে তাকালাম। সেই সাদা মার্বেলের মতো চোখ। কেয়া যেন অনেকক্ষণ আগে প্রস্তুরীভূতা হয়ে গেছে। রহমান কেয়ার উপস্থিতি গায়ে মাখলেন না। বললেন, 'আমার অনুমান যদি ভুল না হয়, এলএমজির শব্দ। চায়নিজ মেড এলএমজি। ভেরি পাওয়ারফুল। মিনিটে নাকি দুই শ লোক মারতে পারে।'
'নিরস্ত্র লোক মেরে কী লাভ?' আমি বলার কিছু না পেয়ে বোকার মতো বলে ফেললাম।
'নাপাম বোমা দিয়ে বস্তি পুড়িয়ে লাভ?' সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলেন রহমান। জিজ্ঞেস করুনগে নিঙ্ন অথবা চেয়ারম্যান মাওকে। কী জন্য ওঁরা পাকিস্তানকে অস্ত্র দিচ্ছেন? আমার তো ইচ্ছে হয় পারলে চেয়ারম্যানকে ডেকে নিয়ে আসি ঢাকায়। সদরঘাট আর শাঁখারীপট্টির মৃতদেহগুলো দেখাই; বলি, কমরেড, এগুলো কি বুর্জোয়া পার পাতি বুর্জোয়ার মৃতদেহ, না বাংলাদেশের গরিব রিকশাওয়ালা, ফেরিওয়ালা, বস্তির ভিখিরিদের মৃতদেহ? কাদের মারছে ইয়াহিয়া কমিউনিস্ট অস্ত্রে?'
এবার সত্যি সত্যি মেঘ গর্জাল। বিদ্যুৎ চমকাল আকাশে। দরজার কপাটের ফাঁকে আলোর রেখার চমক খেলে গেল। বললাম, 'আজ বৃষ্টি হবে।'
রহমান বললেন, 'হোকগে।' তাতে সমস্যার সমাধান নেই। আমি এলাম পরামর্শ করতে। কী ঠিক করলেন? রাতে নিচেই থাকবেন, না উপরে আমাদের ফ্ল্যাটে আসবেন?
'উপরে গিয়ে লাভ?' আমি প্রশ্ন করলাম।
'লাভ কিছু নেই। সান্ত্বনা।' রহমান হাসলেন, 'ওই মার্শাল ল অর্ডার শুনে আমার স্ত্রী বললেন, ওদের গিয়ে জিজ্ঞেস করো, ওরা উপরে আসতে চান, না আমরা নিচে যাব? একসঙ্গে থাকলে ভয়টা অন্তত কমে।'
এতক্ষণে কেয়া মুখ খুলল। এই প্রশ্নের জবাব দেওয়াটা ওর জুরিসডিকশনের মধ্যে। বলল, 'আপনারাই বরং আসুন। বাচ্চাদের বেডরুমটা ছেড়ে দেব। অসুবিধা নেই। এটাচড বাথ আছে। তা ছাড়া সুবিধার দিকটা ভেবে দেখুন ...'
হঠাৎ থেমে গেল কেয়া। তার মুখের ভাব দেখে আমার মনে হলো একটা সচল ছবি যেন হঠাৎ স্থির ছবি হয়ে গেল। রহমান তার শেষের কথাটা ধরলেন, 'হ্যাঁ, সুবিধার দিকটা বলুন।'
কেয়া আমার দিকে তাকাল। বলবে কি বলবে না এই প্রশ্ন তার চোখে। দ্বিধা জয় করে বলল, 'আমরা আজকাল পেছনের প্যাসেজের গেট খোলা রেখে ঘুমুই। কারফিউর রাত। চোর-ডাকাতের ভয় নেই।'
'তারপর?' রহমান সাগ্রহে ঝুঁকে বসলেন।
'ধরুন রাত্রে যদি সামনের দরজায় টোকা পড়ে ...' কেয়ার কথা এবার সত্যি সত্যি জড়িয়ে গেল।
'দরজায় টোকা পড়বে?' রহমান বিচলিত হলেন। কথাটা বুঝতে পারলেন না। কেয়া কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিল, 'বলছিলাম, সোনিয়াদের বাড়ির মতো ঘটনা তো এখন ঢাকার পাড়ায় পাড়ায় ঘটছে। তাই পেছনের প্যাসেজের দরজা খোলা রেখে ঘুমুই। ওরা যদি আসেই সামনের গেট দিয়ে আসবে। পেছনের সরু গলি পথে নিশ্চয়ই আসবে না। কোনো বিপদের আশঙ্কা কিছু দেখলে পেছনের গলিপথে পালাতে পারব। উপরের ফ্ল্যাটে থাকলে তা হবে না।'
রহমান গম্ভীর হলেন, বললেন, 'প্ল্যানটা ভালো; কিন্তু কথা হচ্ছে কি জানেন, ওদের অপারেশন বড় ক্রুয়েল। ওরা ঠিক আপনার ঘরের দরজায় এসে নক করবে না।'
'সোনিয়াদের বাড়িতে কিন্তু ওরা তা-ই করেছিল।' কেয়া বলল।
রহমান বললেন, 'আপনার কথা সত্যি; কিন্তু সবটা নয়। সোনিয়াদের বাড়ির দরজায় নক করার আগে ওরা গোটা পাড়া এনসারকেল করে ফেলেছিল। ওটাই ওদের মেথড। তারপর অপারেশন।'
'তাহলে?' কেয়ার চোখেমুখে এবার স্পষ্ট ভীতির আভাস।
'তাহলে যেখানেই থাকুন মনের জোর নিয়ে থাকতে হবে। আমি মহিলাদের সামনে এসব আলোচনা সাধারণত করি না। আপনাদের নার্ভের খবর আমার জানা আছে। তবু এখন করি। নিজের স্ত্রীর সঙ্গেও খোলাখুলি আলোচনা করি। রিয়ালিটি ইজ রিয়ালিটি। এখন বাস্তবকে স্বীকার করে বাঁচতে হবে প্রয়োজনে মরতে হবে। ভয় পেয়ে লাভ নেই। আপনি হিটলারের গল্প শুনতে চেয়েছিলেন না?'
কেয়া আবার দম দেওয়া পুতুলের মতো ঘাড় নাড়ল, 'হ্যাঁ।'
'শুনুন।' রহমান স্ট্রেতে সিগারেটের ছাই ঝাড়লেন। বাইফোকাল লেন্সের চশমাটা নাকের ডগায় ঠিক করে বসালেন। বললেন, 'হিটলার প্যারিস দখল করলেন। ক্ষমতায় বসালেন এক বৃদ্ধ ফরাসি মার্শালকে। নাম মার্শাল পেতাঁ। ভারদুনবিজয়ী মার্শাল পেতাঁ। ওর নাম নিশ্চয়ই আপনারা জানেন। হ্যাঁ এই ফাঁকে বলে রাখছি ইয়াহিয়া যদি-পূর্ববাংলা কবজা করতে পারেন, তাহলে এখানে ক্ষমতায় বসানোর জন্য এক বুড়ো বাঙালিকে খুঁজে বের করবেন। বাঙালিদের মধ্যে তো আর মার্শাল-টার্শাল নেই। হয় রিটায়ার্ড সিভিল সারভেন্ট নয় বুড়ো হাবড়া পলিটিশিয়ান, এদের মধ্য থেকেই পাপেট গভর্নমেন্টের একজন হেড বেছে নিতে হবে।'
'কেন, নূরুল আমিন, সবুর খাঁ তো আছেনই।' আমি বললাম।
'আমি সে ডিবেটে যাচ্ছি না।' রহমান বললেন।
'হিটলারের কথা বলুন।' কেয়া নরম করে বলল।
রহমান আরেকটা সিগারেট ধরালেন, 'আমি সেই কথাই বলছি। হিটলার প্যারিস দখল করলেন। সৈন্যদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হলো শহর। ভয়ে ছেলে-বুড়ো-মেয়ে সবাই পালাল। যারা পালাতে পারল না তারা আমাদেরই মতো ঘরের আলো নিভিয়ে দরজা-জানালার খড়খড়ি বন্ধ করে যিশুর নাম নিয়ে পড়ে রইল ঘরে। জার্মান সৈন্যরা ঢুকল দলে দলে বারে, থিয়েটারে, অপেরায়, একটি যুবতী মেয়ে নেই কোথাও। এক পানশালায় ঢুকে প্রৌঢ় জার্মান মেজর হুকুম দিলেন পাড়া সার্চ করে যত মেয়ে আছে ধরে নিয়ে এসো। আজ এখানে ডান্স হবে, পান-ভোজন ফুর্তি হবে। পাড়া সার্চ করতেই ডজন দুই মেয়ে বেরিয়ে পড়ল। তার মধ্যে দু-তিনটে আবার যুবতী এবং সুন্দরী। সারা রাত নাচল ফরাসি মেয়েরা। কেউ কেউ মদ খেল। কেউ কেউ ভিরমি খেল। হট্টগোল আর হৈ-হল্লায় কারো কারো কান্না চাপা পড়ে গেল। প্রৌঢ় মেজর সবচেয়ে সুন্দরী এবং বিদূষী মেয়েটিকে বেছে নিয়েছিলেন। শেষ রাতে স্খলিত কণ্ঠে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন, সুন্দরী, তোমার অ্যাপার্টমেন্টে যাব। আপত্তি আছে? মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, না নেই। মেজর খুশি হলেন। কোমরে রিভলবার গুঁজে নিলেন। ইউনিফর্ম ঠিক করে নিলেন শরীরে। মেয়েটির কাঁধে ভর রেখে বেরিয়ে গেলেন আলোকিত নাচঘর ছেড়ে। পেছনে তখনো চলছে অশ্লীল চিৎকার হৈচৈ। মেয়েকে অত রাতে ফিরতে দেখে ফরাসি মা খুশি হলেন। বাবা বললেন, ফিরেছিস? পেছনে জার্মান মেজরকে দেখে তাঁরা স্তব্ধ হয়ে গেলেন। মেয়ে বলল, তোমরা ঘরে যাও। আমার জরুরি কাজ রয়েছে। কেউ আমাকে আজ ডিস্টার্ব কোরো না। বলেই সে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াল। মেজর ফরাসি ভাষা জানেন না, বললেন, কী বলল তোমার মা-বাবা? মেয়ে বিশুদ্ধ জার্মান ভাষায় বলল, ওরা তোমাকে দেখে খুশি হয়েছে। প্রৌঢ় মেজর আনন্দে গোঁফ চুমরে নিলেন। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে মেজরের কণ্ঠলগ্না হয়ে ফরাসি মেয়ে বলল, এতক্ষণ ভারি কষ্ট পাচ্ছিলাম। তোমার ওই খোঁচা খোঁচা দাড়িগোঁফের জন্য। কদ্দিন শেভ করো না? মেজর বললেন আজ তিন দিন। প্যারিস ফল করার পর এই তিন দিন তো তোমাদের নিয়েই মেতে আছি। শেভ করব কখন? মেয়েটি মেজরের বুকে আরো সেঁধিয়ে গিয়ে আহ্লাদি গলায় বলল, ঊহু, সেটি হবে না। আমি নিজে তোমায় শেভ করিয়ে দেব। তারপর চান করে আসো বাথরুম থেকে। আমি ততক্ষণে দুটো 'হাইবল' রেডি করব। মেজর খুশিতে বাগ বাগ। বললেন, আমি তোমার হাতে শুধু শেভ হওয়া নয়, মরতে পারি। মেয়েটি বলল বেশ। তার বাবার ঘর থেকে রেজার, ব্লেড, সাবান নিয়ে এলো সে। সাবান ঘষল অনেকক্ষণ মেজরের গালে এবং গলায়। মেজর আবেশে চোখ মুদে রইলেন। সে চোখ তাকে আর খুলতে হলো না। সাবান মাখা গলায় ধারাল ব্লেডটা অনেকখানি ঢুকে তখন কণ্ঠনালি ছিন্ন করছে। গলগল করে রক্ত গড়িয়ে পড়ল মেঝেয়। প্রৌঢ় জার্মান মেজরের ভারী শরীরটা চেয়ার থেকে গড়িয়ে পড়ল মাটিতে।
গল্প শেষ করে রহমান কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। কেয়ার দিকে চেয়ে বললেন, 'কেমন লাগল গল্পটা?'
কেয়া বলল, 'ব্লেড দিয়ে মানুষ খুন। এটা তো গল্পই।'
'হ্যাঁ গল্প। সেকেন্ড ওয়ারর্ল্ড ওয়ারের ওপর লেখা গল্প; কিন্তু আমাদের জীবনে এই গল্প যেকোনো সময় সত্য হয়ে উঠতে পারে।' রহমান বললেন।
'তা পারে।' আমি সায় দিলাম। অন্ধকার থেকে আলোয় ফিরে আমরা যেন অনেকক্ষণ হয় নিজেদের মধ্যে ফিরে এসেছি। অন্ধকারে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলাম নিজেদের থেকেই। এই উপলব্ধিটা সহসা আমাকে সাহস দিল। বললাম, 'রহমান সাহেব, সব গল্পেরই একটা শেষ কথা থাকে। এই গল্পেরও শেষ কথা আছে। আমরা যেন ভয় না পাই। আমরা শুধু মরতে পারি না। মারতেও পারি। তাই না? রহমান কী বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই টেলিফোনটা আবার বেজে উঠল। কেয়া এবার নিষেধ করল না। এগিয়ে গিয়ে রিসিভার তুললাম। হ্যালো বলে এক সেকেন্ড কথা শুনে রিসিভারটা বাড়িয়ে দিলাম রহমানের দিকে, 'আপনার স্ত্রী। কথা বলতে চান।'
রহমান উঠে দুই মিনিট কথা বললেন। রিসিভার রেখে বললেন, 'ব্যাড নিউজ; সোনিয়া আজ দুই দিন বাড়ি ফিরছে না।'
'খবরটা কে দিল?'
'আমার সেই শালা। তবে খবর এটা নয়, আরেকটা। দুটি ট্রাকবোঝাই মিলিটারি আসছে এদিকে। ওদের মুভমেন্ট রহস্যজনক। কেউ বলছে, নারায়ণগঞ্জে যাবে, কেউ বলছে, টার্গেট এদিকের কোনো পাড়াই।' কেয়ার মুখে ভাবান্তর নেই। সে শক্ত হাতে চেয়ারটা চেপে ধরেছে দেখলাম। এখন ওই চেয়ার চেপে ধরার মধ্যেই তার মনের প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ। রহমান বললেন, 'আমার স্ত্রী ভয় পেয়েছিল। বললেন, তোমরা কী করবে? উপরে আসবে, না নিচে যাব?'
বললাম, কেয়া, 'কী বলছ?'
কেয়া কথা বলল না। হয়তো বলতে পারল না। তার চোয়াল শক্ত হয়ে রয়েছে! ওর মুখের সতেজ লাবণ্যটুকু শুষে যেন ঘরে বিজলির আলো জ্বলছে। রহমান কেয়ার মুখের দিকে তাকালেন। হয়তো ওকে বুঝতে পারলেন। বললেন, 'আমরাই বরং নিচে আসি। একটা বেডরুম যখন খালি রয়েছে। তা ছাড়া আমাদের তো একটা বাচ্চা। অসুবিধা হবে না।'
নিজের হাতে দরজা খুলে বেরোতে যাচ্ছিলেন রহমান। ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, 'মাস দুই আগে ট্রাপ ফর সেভেন ছবিটা দেখেছি। তখনও বুঝিনি, ট্রাপ কাকে বলে! এখন এই বাড়িটা ট্রাপ ফর ফাইভ না হলেই হয়। না, না ভয় পাবেন না। যতক্ষণ বেঁচে আছি, একটু ঠাট্টা-তামাশাও করব না।'
রহমানের গলা নির্লিপ্ত আত্মগত শোকবাণীর মতো। আমার বুঝতে বাকি রইল না, রহমান ঠাট্টা করছেন না, নিজেকেই নিজে সাহস জোগাচ্ছেন।
দরজা বন্ধ করে ঘুরে দাঁড়ালাম। কেয়া নেই। খাবার ঘরে পেয়ালা-পিরিচের টুংটাং আওয়াজ পেলাম। হঠাৎ মনে সাহস এলো। ওই টুংটাং আওয়াজ যেন কোনো বড় ওস্তাদের হাতে মধ্যরাতের বাজনা। দরবারি আলাপের মতো থেমে থেমে বাজছে। এখনো দ্রুতলয়ে ওঠেনি। কেয়ার যেন এই মধ্যরাতের দরবারি।
পর্দা ঠেলে। খাবার ঘরে ঢুকলাম। টুংটাং আওয়াজ থেমে গেল। কেয়া চোখ তুলে তাকাল। আর সঙ্গে সঙ্গে ঘর কাঁপিয়ে, আকাশ আলোময় করে একটা ভয়াবহ শব্দ ছুটে গেল। কেয়ার শক্ত চোয়াল ধীরে ধীরে নরম হলো। দৃঢ়বন্ধ ঠোঁট ফাঁক হলো। বলল, 'বাজ?'
বললাম, 'সম্ভবত।' সেই মধ্যরাতের দরবারি মূর্ছনা তখন আমার মনে নেই। স্পষ্টই দেখলাম, কেয়ার চোখে অবিশ্বাস। আমরা দুজনই দুজনের কাছ থেকে মনের ভাব লুকোচ্ছি।
সে রাত্রে আমরা খেলাম ফ্রিজে রাখা শুকনো মাংস, পাউরুটির শুকনো স্লাইস। বয়-সার্ভেন্ট পালিয়েছে। ঝিটা আসছে না সেই মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে। বেঁচে আছে কি না জানি না। কেয়া হিটারে জল চাপিয়ে দুই কাপ ওভালটিন তৈরি করল।
রহমান তাঁর ঘরের দরজা বন্ধ করেছেন অনেকক্ষণ হয়। শুভরাত্রি জানানোর সময় বারবার বলেছেন, দেখবেন, তেমন বিপদের আশঙ্কা কিছু দেখলে দরজাটা টোকা দেবেন।' ইচ্ছে হয়েছিল রহমানকে সেই পোয়াতি মেয়ের গল্পটা শুনিয়ে দিই, যে তার মাকে বলেছিল, মা, বাচ্চা বিয়োনোর সময় হলে আমাকে জাগিয়ে দিও। মা বলেছিল, আমাকে জাগাতে হবে না বাছা, তুমিই কতজনকে জাগাবে; কিন্তু কেয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে গল্পটা বলিনি। অমন সুন্দর একটা ঠাট্টার লোভ সংবরণ করেছি। কেয়া কেমন ফুলে আছে। ফুঁসে আছে। কিন্তু ফুঁসছে না। আমি ঝড়ের আগে নদী দেখেছি। বৃষ্টির আগে নদী দেখেছি। তখন নদীর জল বড় শান্ত। বড় উদাস; কিন্তু কেমন যেন ফুলে ফুঁসে থাকে। ঔদাস্যের সঙ্গে ফুলে থাকাটা বেমানান। আর বেমানান বলেই আমার চোখে বাজে বেশি। নদী আর নারী। আমি এই দুয়ের কোনো অমিল দেখিনি কখনো।
বিছানায় বসতেই ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজের চেহারা দেখলাম। খোঁচা খোঁচা কাঁচা-পাকা দাড়ি। রোজ এখন শেভ করি না। এমন অফুরন্ত সময় হাতে পেয়েও না। গায়ের জামা ভাঁজ নষ্ট হয়ে কুঁচকে আছে। অফিসে যাই না আজ কত দিন! তত দিন জামা বদলও হয়নি।
আয়না থেকে মুখ ফেরাতেই দেখি, কেয়া কেমন অদ্ভুত চোখে আমার দিকে চেয়ে আছে। তার কালো চোখের তারায় ভয়ের শিহর। অথবা সেই ফুলে ফুঁসে ওঠা ভাবটা বাড়ছে। বললাম 'কী দেখছ?'
কেয়া হঠাৎ আমার কাছ থেকে সরে গেল। একটা বালিশ আঁকড়ে ধরল দু'হাতে। আমি তার পিঠে সস্নেহে হাত রাখলাম। সে হাতটা সরিয়ে দিল।
'ভয় পেয়েছ?' জিজ্ঞেস করলাম।
'না।' কেয়া আরেকটু দূরে সরে গেল। বালিশে মুখ গুঁজল, 'আয়নায় নিজের চেহারা দেখেছ' আমার মনে হলো, কেয়া হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠল।
'ও, এই কথা।' আমি হাসতে চাইলাম। 'আয়না যখন ঘরেই রয়েছে তখন দেখব না কেন? কিন্তু তা নিয়ে অমন করার কী আছে?'
'তো-মা-কে, তো-মা-কে,' কান্নার আবেগে কেয়া থেমে থেমে বলল, 'তোমাকে জার্মান মেজরের মতো দেখাচ্ছে।'
'কার মতো, কার মতো দেখাচ্ছে বললে?' আমি বিভ্রান্ত হয়ে প্রশ্ন করলাম। যেন ওই একটি কথাই দ্বিতীয়বার না শুনলে আমার বিশ্বাস হবে না যে, কেয়া বলছে।
   দীপিতার ঘরে রাত্রিঅমিয়ভূষণ মজুমদার 
অঙ্কন : আহমেদ সদরুল হাসান রাফি
¦

দীপিতার ঘরে রাত্রি
দীপিতার ঘরে রাত্রিঅমিয়ভূষণ মজুমদার
দীপিতার সঙ্গে পরিচয় হবার আগেই ইন্দু তার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়াল। ব্যাপারটা বোধ করি ঠিক এ-শব্দটা দিয়ে বোঝানো যায় না। সাধারণত ভিন্নমুখী দুটি শক্তিকে এনে পাশাপাশি দাঁড় করানো গেলে বলা যায় এ-কথাটা। কিন্তু কতগুলি অসাধারণ ক্ষেত্রও আছে যখন বৈপরীত্য বোধটা পাশাপাশি অবস্থানের উপর নির্ভর করে না, যখন তুলনার বিষয় দুটিও সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির, যেমন গোমড়ামুখো মন আর শরৎকালের প্রারম্ভিক রোদ, পলিটিক্যাল পরাজয়ের অনুশোচনা ও যে-কোনো একটা জেঠামেয়ের হাসির মাঝখানে স্যান্ডউইচ করা তার নরম কাঁধের শ্রাগ।
শান দেওয়া শহরের মেয়ে দীপিতা; কথা যখন সে বলে চশমার সোনার ফ্রেম সেগুলিতে পালিশ লাগিয়ে দেয়, কানের অদ্ভুত-গড়ন দুলজোড়া দুলে, ডিগবাজি খেয়ে কাঁধের আনতিতে ফুটে ওঠা যতি কমা, কোলোন, জিজ্ঞাসাচিহ্নের প্রকাশগুলি স্পষ্ট করে তোলে।
দীপিতা খদ্দরেই অভ্যস্ত; শুধু শাড়িতে নয়, তার বসবার ধরন, বুকের কাছে বইগুলি কুড়িয়ে নেবার পদ্ধতিটাতেই শুধু খদ্দর নয়, উঁচু করে কথা সে বলে না, উঁচু গলায় হাসে না।
কিন্তু এ সত্ত্বেও লোকে বলে : হঠাৎ কিছুদিন ধরে আঁচলের একপ্রান্ত একটু তুলে খোঁপাটাকে আড়াল করার যে-রেওয়াজ উঠেছিল কলেজে তার পেছনে দীপিতার শুধু প্রশ্রয়ই ছিল না। তেমনি ডাক-পিওনদের মতো চামড়ার অর্ধচন্দ্রাকার ব্যাগ কাঁধে ঝোলানোর ব্যাপারটাতেও দীপিতার নাম জুড়ে গেছে।
কিন্তু লোকে প্রকাশ্যে বলে না। পাছাপেড়ে শাড়ি কলকাতায় কী করে জুটল, এর চাইতেও বড় সমস্যা হলো একদিন সেটা পরে কলেজে আসবার কথা দীপিতা কী করে ভাবতে পারল! শুধু পরা নয় যেখানে যে-রকম টানটোন দেয়া দরকার তেমনি করে দেহকে ফুটিয়ে তুলে! সারা দিন তাকে কেন্দ্র করে কলেজে একটা বাতাস খেলে গেল। প্রকাশ্যে কেউ কিছু বলেনি, হয়তো হাস্যকর ব্যাপারও অভিভূত করে দেবার মতো ভালো লেগে যায় কখনো।
দীপিতা নিজেও জানে এগুলি তার একসেন্ট্রিসিটি, আগে টের পায় না, পায় ঘটে যাবার পর। কলেজে নতুন পাশ-করা কোনো অধ্যাপককে বিব্রত করে, লেডি চ্যাটারলির লালসার সমালোচনা তাঁর মৌনতা থেকে টেনে বার করে-করে, শেষ পর্যন্ত উপন্যাসের প্রথম একশো-তিরাশি পাতা স্রেফ গ্রন্থের কলেবর বাড়ানোর জন্যে লেখা বলিয়ে নিয়ে, লরেন্সের প্রশংসা নিন্দায় পরিণত করে দীপিতা যখন তার বেঞ্চটাতে বসে তখন সে ভাবে এটাও একসেন্ট্রিসিটি হল।
ডিবেটিং-ক্লাবের দীপিতা, ভারতীয় ফেবিয়ান-ক্লাবের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা 'এমাজন' নয়। কেউ তাকে দেখেনি হেদোর উঁচু ব্রিজ থেকে কালো পোশাকে ঝাঁপ দিয়ে পড়তে জলে। কল্পনাও করা যায় না।
কিন্তু যখন সে বাড়ি ফিরে যায় কেউ কি দেখেছে তাকে? একটা ব্লাউজ থেকে আর-একটায় যাবার ক্ষণটুকু দীর্ঘায়িত হয়ে আয়নায় যখন প্রতিবিম্বিত হয় তখন ক্লান্তির স্বেদমালা নাভির কাছে জন্ম নিয়ে বিপন্ন স্তনযুগলের মাঝখান দিয়ে কাঁধের দুদিকে ছড়িয়ে পড়ে ঘাড়ের পেছনে আবার একত্রিত হয়ে মাথাটাকে সামনের দিকে নত করে দেয় যেন। দীপিতা 'আঃ' বলে পাশের চেয়ারটায় গা ঢেলে দেয়। সে শুধু উনিশ বছরের একটি মেয়ে।
পরেশ মিত্তির বেড়িয়ে ফিরে আদ্দির পাঞ্জাবি খুলল, চুনট-করা কোঁচাটা এক অদ্ভুত কায়দায় জড়িয়ে আলনায় ঝুলিয়ে রাখল। পাম্পশুটা খুলে ব্রাশ দিয়ে ঝেড়ে গুছিয়ে রাখল, পাঞ্জাবির তলে যে মোটা গেঞ্জিটা পরা ছিল সেটা পালটে মসলিনের মতো হালকা একটা পরল। হালকা রঙের সিল্কের লুঙ্গিটার বাঁধন আলগা করে পায়ের দুপাশে মাথা হেলিয়ে-হেলিয়ে লুঙ্গির ঘের মাটি স্পর্শ করেছে দেখে নিশ্চিন্ত হলো। আলনা থেকে বিলিতি তোয়ালেটা কাঁধে ফেলে বাথরুমের দিকে যেতে-যেতে ফিরে দাঁড়াল, আলনাটার পায়ের কাছে বসে জুতো চটিগুলি সোজা করে রাখল।
কাঁধ থেকে চুলের গোড়া, আঙুলের ডগা থেকে কনুই অবধি সাবান দিয়ে ধুয়ে পরেশ যখন ঘরে ফিরে সরু ধাতব ফ্রেমের চশমা খাপে পুরে কালো ফ্রেমের পুরু কাচের বই-পড়বার চশমা বার করে বসেছে টেবিলের সম্মুখে, তখন ইন্দুর ফিরবার সময় হলো
ইন্দুর বর্ণনা করা বেশ একটু কঠিন। যতই গম্ভীর হয়ে বিচার করতে বসা যাক, বর্ণনা খানিকটা হাস্যকর হবেই। নস্য রঙের সিল্কের পাঞ্জাবিটা আধো-অন্ধকারেও দৃশ্য হচ্ছে। হাতে একগোছা গোলাপ ফুল। তার গলার সাড়া পেয়ে প্রথম ও দ্বিতীয় বার্ষিক শ্রেণীর দু-তিনটে ছেলে তার কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল। ঘরের তালায় চাবি পরাতে-পরাতে ইন্দু তাদের দেখে ফিরে ঘরগুলির সম্মুখে বারান্দায় রেলিঙের কাছে দুটো থামের মাঝখানে যে-কোণটুকু আছে তার কাছে ফিরে দাঁড়াল_ভাবখানা এই, এস হল্লা করি খানিকটা।
একটা ছেলে কচি গলায় বললে, 'গোলাপের উঠনো বন্দোবস্ত আছে নাকি, ইন্দুদা?' আর-একজন রসিকতা করবার চেষ্টা করে বললে, 'প্রেমের ব্যাপার নাকি, ইন্দুদা, শুনেছি তিনি বন্ধুপত্নী।'
ইন্দু খক-খক করে হেসে উঠে বললে, 'তা প্রেম বইকি। দাদাকে অজস্র মুঠি-মুঠি বিলোবার পরও বউদির ভাড়ার কিছু কিঞ্চিৎ থাকে, আমাকে ডুবিয়ে দিতে সেইটুকুই যথেষ্ট।'
দীপিতা স্বীকার করে ইন্দুর বর্ণনাটা আগাগোড়াই কল্পনা, হয়তো-বা খানিকটা পক্ষপাতদুষ্ট। সে হয়তো নস্য রঙের সিল্কের ভক্ত নয়, কিন্তু ইন্দুর কথা মনে হলেই এ-রকম দৃশ্যই তার মনে পড়ে। অনেক অজুহাতেই পরেশ মিত্তিরের ঘরখানা সে দেখেছে। সেটা কল্পনা নয়, ঘর গুছিয়ে রাখে পরেশ। কিছু বললে বলে_নিজের হাতে সাতদিনের জঞ্জাল এক রবিবারে সাফ করবার চাইতে জঞ্জাল জমতে না দেওয়াই ভালো। কিন্তু ইন্দু?
দীপিতা না-দেখেও বলে দিতে পারে ইন্দুর ঘরের দুর্দশার কথা। সিগারেটের দগ্ধাবশেষ, টিনের খাবারের খালি আধার, ময়লা কাপড়-জামা, ধুলোয় ঢাকা টেবিল এসবই থাকবে_যেন শরৎবাবুর কোনো নায়ক; কোনো নায়িকা এসে ঘর গুছিয়ে দেবে, গুছিয়ে দেবার মধ্যে ফুটে উঠবে_নিশ্চিন্তে আরাম এনে দেবার মতো স্ত্রী হতে পারি তোমার। মানুষকে চেনা গেলে তার সম্বন্ধের খুঁটিনাটি বিষয়গুলি কল্পনা করা কঠিন নয়।
ইন্দুর কথায় পরেশের মনে হয় : মানুষের জীবন কেন বাহুল্য-বর্জিতের একটা তরঙ্গে গঠিত হয় না।
দুজনে একসঙ্গে ঝরনা কলম কিনতে গিয়েছিল দোকানে; পরেশ কিনল ধূসর রঙের স্ট্রিমলাইন্ড একটা-কিছু আর ইন্দু নিল কলরব-করে-ওঠা ফিরোজারঙের দামি পার্কার সোনার খাপে মোড়া। এইখানেই রুচির তফাত, এই পার্থক্যই দুজনের সর্বত্র।
পরেশের বন্ধু হিসাবে ইন্দু চলতে পারে না। বহুদিন পরে, ম্যাট্রিক পাশ করবার পর চতুর্থ বার্ষিক শ্রেণীতে এসে, দেখা; পরেশও খুশি হয়েছিল বইকি; হাত জোড় করে স্মিত হাসিতে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছিল_ইন্দুবাবু! ভালোই হলো, পুরনো দিনের অনেক কথা বলা যাবে। প্রত্যুত্তরে ইন্দু_আরে বাঁটলো যে রে, বলে লাফিয়ে এসে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল পরেশকে।
ইন্দুর সঙ্গে পরেশের বিচ্ছেদের যা কারণ সেটাকে এই রকম বলা যায়; রবিবারের পাগল ইন্দু; প্রতি রবিবারে সকাল থেকে বেলা বারোটা অবধি কলকাতার পথে-পথে হৈ-হৈ করে হা-হা করে হেসে, কেবল সিগারেট ফুঁকে রেস্তোঁরা-কাফেতে চা খেয়ে ঘুরে বেড়াবে। এই বোহেমিয়ানা যে এক শতাব্দীর পুরোনো হয়ে গেছে এ ইন্দু বোঝেও না, জানে না।
কিন্তু এ-কথাগুলি ভাবলেও, কী শোভন প্রকাশ করেছিল তার পরেশ, এতটুকু ক্ষোভ নেই, এতটুকু বিচলন নেই, শান্ত মৃদুস্বরে বলেছিল, 'ওর স্বাস্থ্য ভালো, ও পারে, পিছিয়ে পড়লুম আমি।... এইসব দিয়ে ইন্দু গড়া, পরেশও।
মাঝে মাঝে কিন্তু ইন্দুর রুচি মোহগ্রস্ত করতে পারে চারিপাশের লোককে। দীপিতার গত জন্মদিনে এ রকমের একটা ব্যাপার ঘটেছিল; অন্য অনেকের মতো ইন্দুও উপহার দিয়েছিল। সত্যিকারের কাজ যাতে আছে এমন একটি রুপোর রেকাবিতে একটা কালচে-লাল রঙের দগদগে গোলাপ। টাকার দেমাক না-দেখিয়ে যতটা ব্যয় করা ছাত্রের পক্ষে সম্ভব ততটা নিশ্চয় হয়েছিল রেকাবিখানা কিনতে, কিন্তু তার চাইতে প্রাধান্য পেয়েছিল ক্ষণস্থায়ী গোলাপটি। এমনকী দীপিতার গালেও ব্রীড়ার রং লেগেছিল।
তেমনি হয়তো ভালো লাগার উপাদান তাকে তার হঠাৎ বলা কোনো কথায়। পরেশ বলেছিল_এখনও অর্ধেক কল্পনায় ঘিরে রাখতে চাই নারীকে। হর্ষে, দুঃখে, উদারতায়, হিংসার সার্টের আড়ালের মানুষটির সঙ্গে বডিসের অন্তর্বর্তিনীর কোনো প্রভেদ নেই, এ বুঝব আমরা কবে? এখনও এই বিংশ শতকের মাঝামাঝি এসেও বলব, তুমি হেঁটে গেলে পদ্ম ফুটে ওঠে। এসব কথা, ছেলে ভুলানো ছড়া আর-কতদিন চলবে।
দীপিতা বলতে যাচ্ছিল_ছেলে ভুলানো ছড়া যাদের জন্য সেই শিশুমনগুলিতে এখনও আছে, এমনি সব লাল রং দেখে হাত-বাড়ানো শিশু।
প্রথম দিকে ইন্দু চুপ করেছিল, হঠাৎ বলে উঠল_বিংশ শতকের কাচের বাঙ্ েরাখা জীবন আমাদের; শো-কেসে রাখা প্রজাপতির ডানার পরাগের মতো খসে গেছে আমাদের কল্পনা; অনেক গালভরা টানা টানা লাতিন নাম সুস্পষ্ট পাইকায় লিখে দিয়েছি বাঙ্রে গায়ে-গায়ে; তবু পরাগ-উঠে-যাওয়া জীবন। তারপর সে দীর্ঘনিঃশ্বাসও ফেলেছিল।
মাঝে-মাঝে মনে হয় লোকটি কথা বলছে না যেন স্ফটিক নিয়ে খেলা করছে। কিন্তু এ-ব্যাপারটা তার পিছিয়ে থাকবার নজিরও বটে; কথার এই সুবিবেচিত প্রয়োগ, লক্ষ্যে পড়ে যাবার মতো প্যাঁচের প্রাচুর্য। বস্তুত ইন্দুর লক্ষ্যের মাঝখানে গিয়ে পড়বেই, তার সুগৌর প্রকাণ্ড দেহের মতো প্রাধান্য-কাঙাল যেন তার রুচি, ফলে গোলাপের মতন বর্ণচ্ছটায় ও আবেগের উত্তাপে ভরে ওঠে সে।
ইন্দু নিজেও জানে তার পদ্ধতিতে সেকেলেমি ছাড়া আর কিছু নেই, সেও ধীরে-ধীরে বিকাশের প্রভাব মেনে নিচ্ছে। বিকাশ দীপিতার দাদা, তার সংস্পর্শে এসে ইন্দুর বলবার ভাষার পরিবর্তন সূচিত হয়েছে, অনাড়ম্বর, প্রজ্ঞাদীপ্ত, উৎপ্রেক্ষাহীন হয়ে উঠবার লক্ষণ দিয়েছে ইতিমধ্যে।
এ-বাড়ির কথা বলতে গেলে বিকাশের কথা বলতে হয়। খদ্দর পরেন না তিনি, সাধারণ বাঙালির মতো দোকানের কাপড় কিনে পরেন। জেল তাঁকে বারংবার খাটতে হয়েছে গান্ধী-মহারাজের ডাকে। কোনোদিন কেউ মাথায় দেখেনি গান্ধীটুপি, খুব বিরক্ত করলে মধুর পরিহাস করে বলেন : বাঙালির ছেলে, হঠাৎ নগ্নমাথায় খাপ উঠলে বেখাপ্পা দেখাবে। জেল থেকে বেরিয়ে কেউ দেখেনি তাঁকে ফুলের মালা গলায় পরতে, জেলে ঢুকবার সময়ে কেউ শোনেনি বন্দে মাতরম বলতে বুকভরে। দেশ আমার, আমার দেশকে আমার বলতে শ্লোকে গান গেয়ে উঠতে হবে কেন স্বর্গাদপি গরীয়সী বলে? আমার মা আমার ছেলে বলে কেউ কি কোনোদিন গান গেয়ে ওঠে।
এ-বাড়ির আবহাওয়া বিকাশের জ্যামিতির প্রতিজ্ঞার মতো স্বল্পবাক, বাহুল্যবর্জিত জীবনের তৈরি!
কোথা থেকে কী হলো কলেজে, কী কেলেঙ্কারি ঘটে গেল। দরজার পাল্লায় হাত ছেঁচে রক্তারক্তি। দরজার পাল্লায় মানুষের দু-তিনটে আঙুল অমন বীভৎসভাবে জখম হতে পারে এ না-দেখলে বিশ্বাস হয় না। অতটা বাড়াবাড়ি যেন ইন্দুর ক্ষেত্রে ছাড়া ঘটতও না। স্যোসালিস্ট এক নেতার সংবর্ধনা ব্যাপারকে উপলক্ষ্য করে ঘটল ব্যাপার। দীপিতা ও পরেশ ঝগড়া করতে নয়, ইন্দু ও তার পেছনে কয়েকটি ছেলের একটি দল তৈরি হচ্ছিল, তাদের বোঝাতে গিয়েছিল; কেলেঙ্কারিটা ঘটে গেল। কেউ কেউ বলে পরেশ ইচ্ছা করে দরজাটা চেপে দিয়েছিল, কেউ বলে ইচ্ছা করে দিলেও ইন্দুকে জখম করবার জন্য নয়, দিয়েছিল নিজের বিরক্তির নাটকীয় প্রতীক সৃষ্টি করতে। কিন্তু আর্তচিৎকার করে হাত চেপে ধরে ইন্দু যখন বসে পড়ল, এতসব ভাববার অবকাশ কারো ছিল না। দীপিতা স্তব্ধ হয়ে দেখল, ছ-ফিট উঁচু পুরুষটির দেহটা একেবারে তার পায়ের কাছে নুয়ে পড়েছে; বেদনায় এমন হাহাকার করতে কাউকে সে শোনেনি, দেখেনি এমন করে পুরুষকে কান্না চাপবার বৃথা চেষ্টা করতে। অ্যাম্বুলেন্স, প্রফেসাররা, ছাত্ররা যখন এল তখন দীপিতা ইন্দুর অনতিদূরে চৌকাঠে মাথা রেখে বসে আছে, তার চোখ বন্ধ, হাত মুঠো করা, চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে, ইন্দুর রক্ত গড়িয়ে এসে তার শাড়ির খানিকটা ভিজে গেছে।
সম্ভবত রক্ত সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা কম বলেই কথাটা তার মনে দাগ কেটেছিল। পরেশ মিত্তির সম্বন্ধে কেউ-কেউ সন্দেহ আরোপ করেছিল। সহসা একটা আবেগের মতো বোধ করতে প্যাড টেনে নিয়ে দীপিতা খসখস করে একদিন লিখল : পরেশবাবু, আজকের ব্যাপারের জন্য তোমার লজ্জিত হওয়া উচিত; সুরেন্দ্র তোমার ইকোনমিঙ্রে নোট চুরি করে পড়েছে এই অজুহাতে কলেজে যে-রোল উঠেছিল তার পেছনে তুমি ছিলে এ রকম সন্দেহ হচ্ছে আমার।
এই পর্যন্ত লিখে চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলেছিল সে, ডাকে দেয়া যেত, চাকরের হাতেও পেঁৗছে দেয়া যেত, বাধা সেটা নয়; চিঠি লিখবার কোনো যুক্তিই নেই বরং ভাবাতিশয্য প্রকাশ পাবে; নাটকের মতো হবে ব্যাপারটা।
রাত্রিতে সে খেল না, ইন্দুর রক্তাক্ত হাতের কথা মনে হতে গা ঘেঁটে উঠতে লাগল। পরের দিন কলেজে যেতে কুণ্ঠা হচ্ছিল তার, কিন্তু না-গেলে বাড়বে হৈ-চৈ, গেল সে, পরেশও এল; অন্যান্য দশদিনের মতো স্বাভাবিক হয়ে চলল তারা। তিনদিনের মাথায় ব্যাপারটা থিতিয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু কলেজ থেকে ফিরে দীপিতা চিঠি পেল, ভেবেছিল পরিচিত কারো, তলে নাম দেখে অবাক হলো। ইন্দু চিঠি লিখেছে! লিখেছে :
শ-দেড়েক টাকার আজই প্রয়োজন; হাতের অবস্থা ভালো নয়। হাসপাতালের ব্যবচ্ছেদে কেটে বাদ দিতে হবে দুটি আঙুল। আমার অমন সুন্দর আঙুলগুলি হারাতে চাই না, বাইরে বড় কাউকে দেখাব। টাকাটা আজই পেঁৗছে দেবার ব্যবস্থা করবেন।
ইন্দু চিঠি লিখেছে, তাকে লিখেছে, লিখে টাকা চেয়েছে! পোস্টকার্ডখানা উল্টেপাল্টে দেখে তার শুধু মনে হলো হিং টিং ছট। উপন্যাসের নায়িকা যেন সে, জোর করে মন কেড়ে নেবার পার্ট যেন তার সম্মুখে। দেড়শোটা টাকা এমন কিছু নয়, এর আগে চাঁদা হিসাবে সে দিয়েছে, বড় জোর মা একটু হুঁশিয়ার করে দেবেন, কিন্তু ইন্দুর টাকা চাইবার কী যুক্তি এত লোকের মধ্যে বেছে-বেছে তার কাছে। টাকা পাঠাবার কথা ভাবতে গিয়ে তার মনে হতে লাগল উপন্যাসের পূর্বরাগের কথা।
রাত্রিতে শুতে গিয়ে একলা অন্ধকারে তার মনে হলো চিঠিটার কথা, হাসিও পেল। কিন্তু চিন্তাগুলিকে যখন ঘুমের গহ্বর থেকে টেনে বার করতে হচ্ছে দীপিতার মনে হয়েছিল : নন্তুটা (তার ছোট ভাই) এমন করে মাঝে মাঝে পয়সা চায় বটে, কিন্তু ক্লাস সিঙ্রে ছেলে নন্তু আর ইন্দু একই অর্থে পুরুষ নয়।
প্রায় এক সপ্তাহ পরে বৈকালে, অধ্যাপক দু-তিনদিন আসেননি, তাঁর অসুখ করেছে কিনা এ খোঁজ করতে গিয়ে দীপিতা আটকে পড়ল অধ্যাপক যখন বললেন_গাড়ি রাখো, শম্ভু পণ্ডিতের হাসপাতালে ইন্দুকে দেখে যাব তোমাদের বাড়িতে, চা খাওয়া হয়নি, তোমাদের ওখানেই খাব।
এরপরে অজুহাত দেখানো চলে, না-যাওয়া চলে না। বাড়াবাড়ি হয়, জেদের মতো ুএকটা-কিছু প্রকাশ হয়ে পড়ে।
ইন্দু বিছানায় উঠে বসেছিল। ক্লান্ত নিষ্প্রভ দৃষ্টি, গভীর শোক ছাড়া এমন চেহারা হয় না কারো। অধ্যাপকের প্রশ্নের উত্তরে ব্যান্ডেজ বাঁধা হাত তুলে দেখাল ইন্দু, ব্যান্ডেজের ফের দেখেই বোঝা গেল কঠিন সত্যটুকু, দুটি আঙুলই কেটে বাদ দিতে হয়েছে। অধ্যাপক ধীরতা সম্বন্ধে কী-একটা উপদেশ দিতে ইন্দু টেনে-টেনে হেসে উঠেছিল, কিন্তু দীপিতার দিকে চোখ পড়তেই ওর হাসি থেমে গেল; গভীর অভিমানে মুখের চেহারা যেমন হয় তেমনি হলো, চোখেও জল এল।
একদিন মুখ নিচু করে বই গোছাতে-গোছাতে দীপিতা শুনছিল ইন্দুর অসুখের কথা অধ্যাপকের মুখে। তিনি একসময়ে বলেছিলেন, বেচারার আঙুলগুলির জন্য দুঃখ হয়। বাইরের কাউকে দেখাতে চেয়েছিল শুধু কিছু টাকার জন্যই হলো না।
'আপনি দিলেন না কেন,' দীপিতা বলেছিল, চিঠির কথা মনে পড়েছিল তার।
'দিয়েছি, কিন্তু বাইরের ডাক্তার এসে বললেন, অপকারটুকু হয়ে গেছে।' অতঃপর অধ্যাপক বললেন, 'কে একজন ওর আছে, তার কাছে টাকা চেয়ে পাঠিয়েছে, বলেছে তিনি টাকা পাঠালে আমার ধার শোধ করে দেবে। আমি ভেবেই পেলুম না কলকাতায় থেকে এত বড় বিপদের কথা শুনেও টাকা পাঠাতে দেরি করলেন কেন তিনি। অমন বন্ধু থেকে লাভ কী? ধার হিসাবেও তো টাকাটা দেয়া যায়।'
দীপিতা সোজাসুজি একটু তীক্ষ্ন করে অধ্যাপকের দিকে চাইল, সন্দেহ হয়েছে তিনি চিঠির কথা জানেন, বিঁধবার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তা নয়। অধ্যাপককে এমন একটি বৃত্তি আরোপ করার জন্যই দীপিতা কুণ্ঠাবোধ করল।
অধ্যাপক চলে গেলে দীপিতা ভাবল_পাঠালেও হতো টাকাটা, ইন্দুকে যা ভেবেছিল তা হয়তো নয় সে। টাকার প্রয়োজনে লিখেছিল, দীপিতাদের দেবার ক্ষমতা আছে জেনে। হৃদয়ের অনুসন্ধান সে করেনি উপন্যাসের নায়কের মতো। টাকাটা দিতে হবে, অধ্যাপকের ধার যখন ইন্দু শোধ করতে চায় তখন টাকার প্রয়োজন ফুরায়নি, ইন্দুকে অঋণী করতে অগ্রহ হলো তার।
পরদিন টাকাটা পাঠাতে গিয়ে আগ্রহটা তাকে সংকুচিত করেছিল, ইন্দু যদি তার আগ্রহে কোনো গভীরতর বৃত্তি আরোপ করে বসে। কিন্তু একটা ভালো লাগার বোধও ছিল এ-কুণ্ঠার মধ্যে। মনি-অর্ডারের কুপনে সে লিখল : পাঠাতে দেরি হলো বলে আমি দুঃখিত।
তার লিখতে ইচ্ছা হলো : আপনি নিতান্ত ছেলেমানুষ, এত অল্পদিনের পরিচয়, যাকে পরিচয়ই বলা যায় না, তাতেই আপনি টাকা চেয়ে পাঠিয়েছেন, আপনার আত্মপ্রত্যয়ের মূল অনুসন্ধান করতে ইচ্ছা হয়।
কিন্তু দীপিতার মতো মেয়ে এ-কথা কাউকে লিখতে পারে না, বরং ভালো লাগার বোধটাকে আড়াল করবার জন্য কুপনে লিখল_যখন সম্ভব হয় শোধ করে দেবেন।
টাকাটা পাঠিয়ে রাত্রির অন্ধকার অপূর্ব বোধ হতে লাগল। ইন্দু কি তাকে ভালোবাসে?
দীপিতা বালিশে মুখ গুঁজে হেসে ফেলেছিল। কিন্তু একজন পুরুষ তাকে ভালোবাসে এ-বোধটা হাস্যকর হলেও, পুরাতন হলেও প্রত্যেকটি মেয়ে প্রথম যখন অনুভব করে তখন বোধ হয় কৌতুক ও কৌতূহলে উন্মনা হয়ে ওঠে_ভাবল দীপিতা।
পরের দিন সকালে টাকা পাঠানোর ব্যাপারটায় নিজেকে খুবই বোকা বললে দীপিতা। ইন্দুকে অঋণী করবার জন্য টাকাটাও পাঠাতে হবে এতটা আগ্রহ হওয়া উচিত ছিল। দু-পাঁচদিন ডাকের দেরি হলেও ইন্দুর বাড়ি থেকেই নিশ্চয় এসেছিল টাকাটা।
কিন্তু খুব খারাপ লাগছে না, কুণ্ঠার মধ্যে ভালো লাগার বোধ একটা থাকেই, বিশেষ করে আজকের রাত্রিটায় যেন ভালো লাগছে চিন্তা করতে।
একদিন সশরীরে ইন্দু এসেছিল দীপিতাদের বাড়িতে, অন্য অনেকবারের মতো দীপিতা অবাক হয়ে শুনেছিল ইন্দুর রঙদারি ভাষা।
কিন্তু বিকাশ চলে গেলে, দীপিতার সম্মুখে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ঘামতে লাগল ইন্দু। ব্যথা নেই আর_দীপিতা বলেছিল।
অস্ফুট একটি_না।
একটু পরে আবার দীপিতা বললে_হোস্টেলে না-ফিরলে যদি চলে, খুব বৃষ্টি হচ্ছে না?
ইন্দু বললে_হোস্টেলে না-ফিরলে চলে।
আসলে ব্যাপারটা এই, পরে একদিন ভাবল দীপিতা_রোজকার ঘটনার বাইরে যা সেটাই রোমান্স, আর সব ব্যাপারটার মূলে আছে ইন্দুর রোমান্সপ্রিয়তা। টাকা ধার করার ব্যাপারটা হয় কুসীদজীবীর সঙ্গে বা কুসীদজীবীর বিলেতি প্রতিরূপ ব্যাংক ও ব্যাংকারের কাছে থেকে। আমাদের দেশের মেয়েদের অর্থ সম্বন্ধে কোনো স্বাধীনতা নেই, দিতে হলে কাউকে কিছু তাদের অভিভাবকস্থানীয় পুরুষরা দেন। ঠিক এজন্যই হঠাৎ কোনো মেয়ের যদি অর্থনীতিগত স্বাধীনতা থাকে তার আবহাওয়া অনেক পুরুষের কাছে রোমান্টিক বোধ হয়। এমনকি অনেক মেয়েরও হয়, যেমন হয়েছিল স্বাগতার। স্বাগতা বুদ্ধিশাণিতা মেয়ে, কলেজে সে রোমান্স কল্পনা করতে পারত না। কিন্তু কলেজ থেকে বেরিয়ে অধ্যাপিকা হিসাবে অর্থ উপার্জন করে সে রোমান্টিক হয়ে উঠল। তার চাইতে বয়েসে ছোট (লোকে বলে) একটি রোগা ফ্যাকাশে খদ্দর-পরা ছেলেকে এখন-তখন অর্থসাহায্য করতে করতে একসময়ে সে তার মোহে কলেজ ছাড়ল, গ্রামে চলে গেল ছোট একটি রোমান্টিক কুটির গড়বার লোভে।
বিশ বছর আগে কলেজে পড়ার ব্যাপারটাই এমন রোমান্সের উপাদান হতো, মেয়েরা কলেজে পড়ছে এই নতুনত্ব। নতুন শাড়ি পরলে পুরনো বউকে যেমন ভালো লাগে, তেমনি স্ত্রীজাতি-বিমুখ অনেক কলেজের ছাত্রের চোখে এই নতুন রূপটি, বুকের কাছে বই কুড়িয়ে নিয়ে, ছাতা হাতে করে চলা মেয়েদের, ভালো লেগে উঠল। সাহিত্যিকদের উপরেও এসব পরিবর্তন প্রভাব বিস্তার করে।
দীপিতা সকালের ডাকে আসা কলম্বিয়া য়ুনিভার্সিটি থেকে প্রকাশিত বর্তমান ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসের ধারা খুলে বসল। কিন্তু ঘুম পাচ্ছিল তার। মনে হলো ঘুম পেলে ছেলে-ছাত্ররা নস্যি নেয়। হাই তুলে সে ভাবল একদিন নিয়ে দেখলে হয় ঘুম যায় কিনা, কিন্তু বড্ড নোংরা।
তাহলেও, ভাবলে দীপিতা_একদিন যদি দেখা যায় মেয়েরা নস্যি নিতে আরম্ভ করেছে, হয়তো সেটাই রোমান্সের উপকরণ হয়ে উঠবে।
এটা হাস্যকর কথা হলেও এর চাইতে বড়-বড় ঘটনার মূলেও এ-অভিনয়ের নেশা দেখা যায় বইকি। বস্তুত আজই দেখেছে সে, বিকাশের ঘরের পাশ দিয়ে আসতে-আসতে গানের মৃদুশব্দে অর্ধোন্মুক্ত দরজা দিয়ে চোখ পড়েছিল ঘরের মধ্যে, ভামিনী বউদিকে দেখা দিয়েছিল প্রসাধন করতে। একটু অবাক লেগেছিল বইকি দীপিতার। সবজে সাটিনের পায়জামা পরা, পিঠের চওড়া চ্যাপ্টা বেণী এসে পড়েছে নিতম্বে। আর্দ্র দৃষ্টি বেষ্টন করে যেন কাজলের রেখাও ছিল।
দুগাছি সরু সোনার চুড়িতে, একগাছা সরু সোনার হারে, লাল পেড়ে সাদা শাড়িতে দেখা ভামিনী বউদির সঙ্গে মেলে না। তার দাদা বিকাশ স্কুলের হেডমাস্টার, কিন্তু তাই বলে অর্ধ-সন্ন্যাসের আদর্শে খাড়া হবেন ছাত্রদের সম্মুখে এ মত নয় দীপিতার। রাত্রির প্রভাব, আদিম সূর্যোদয়ের চাইতেও প্রাচীন তমিস্রার রক্তে সঞ্চারিত স্মৃতি।
একবার একটা কবিতার কথা মনে হয়েছিল তার। পুরুষ বলছে নারীকে : 'এইটুকু আমার কামনা, শুধু এইটুকু_তোমার পাশে দাঁড়িয়ে আমার মন যখন করুণায় টলমল করে উঠেছে, সেই কারুণ্যের কাঁপন লাগুক তোমার মর্মমূলে, পরম সহ-অনুভবের প্রতিতরঙ্গ।' মিথ্যা নয় কবির আশা, আরো দু'এক শতক পরে হয়তো মানুষের জীবনে সত্য হয়ে উঠবে।
কিন্তু তা না হলেও ক্ষতি নেই। ইংরেজি সাহিত্য ও বিজ্ঞান দীপিতার পাথেয়। যদিও সে এখনও ইংরেজি 'লাভ' কথাটাকে অপ্রচুর মনে করে মানুষের পারস্পরিক সবগুলি আকর্ষণ নির্দেশের পক্ষে, এবং যদিও সে স্নেহ ও শ্রদ্ধা কথা দুটিকে ইংরেজি চালানোর চেষ্টা করছে তাদের আদিম বাঙালি অর্থে, সে সব সময়েই স্বীকার করে ভারতবর্ষের লোক আমরা শত চেষ্টা করলেও দাম্পত্য ভালোবাসাকে স্নেহ ও শ্রদ্ধার স্তরে উন্নীত করতে পারব না, বাৎসায়নের এক্তিয়ারের বাইরে এনে।
কাল ভোর হতে-না-হতে দীপিতা প্রাত্যহিক ভোরাই চায়ের আসরে যোগ দিতে বিকাশের ঘরে যাবে। বাইরে চড়ুই পাখিটা সরু ঠোঁট দিয়ে ঠুকছে ঠুক-ঠুক করে কাচের শার্সি, কার্নিশের টবে একটি নিশাগন্ধার কলি আগামী রাত্রির তপস্যায় সংহত ও ঋজু হয়ে উঠবে। মিতভাষিণী ভামিনী বউদির মৃদু পরিহাসে ভোরের হাওয়ার মতো অনির্দেশ্য সুখের আমেজ আনবে।
কিন্তু কাল সকালে যদি মনে পড়ে যায় রাত্রির এই বেলোয়াড়ি আড়ম্বর, এই রং ও রেখার সপ্রচুরতা? ইন্দুর পক্ষে যা স্বাভাবিক তাই যেন ঘটে গেছে। যেন সে প্রভাবিত করছে। মিলিয়ে নেয়া কষ্টকর, আট পহুরে দুপুরের বিশদ বস্ত্রের বিকাশের কথা ছেড়ে দিলেও, বোরাই চায়ের আসরের অস্নাত অবিন্যস্ত কেশ বিকাশের সঙ্গেও মেলে না। দীপিতার প্রশ্ন হচ্ছে : বিকাশ কি সহ্য করতে পারে ভামিনী বউদির এই ভাবালুতা, রাত্রির রোমান্স গড়বার প্রয়াস। হয়তো করে, অপ্রিয় হবার জন্য কেউ প্রয়াস করে না, প্রসাধন করে না।
ইলেকট্রিকের বাল্বে মধ্যরাত্রির শব্দ হয় না। টেবিলের সম্মুখে বসে থাকতে-থাকতে দীপিতার মনে হলো সে যেন বাল্বের অভ্যন্তরে কম্পমান শিখা দেখতে পাচ্ছে। অনেক দিন পূর্বের এক বিয়েবাড়িতে চোখ-জ্বালা করা মধ্যরাত্রিতে শোনা গ্যাসের সাঁ-সাঁ শব্দটার কথা মন পড়ে গেল তার। সেই আলোটার চারিদিকে অসংখ্য সবুজ রঙের পোকা গিজ গিজ করছিল। দীপিতা এবার লক্ষ্য করলে ঘেরাটোপের গায়ে কতগুলি বাদলা পোকা লেগে আছে, স্ট্যান্ডের পক্ষাকৃতি গোড়াটাতেও। আঙুল দিয়ে গোড়াটা সাফ করতে গিয়ে সে আশা করেছিল আলোর গা চোয়ানো খানিকটা ময়লা আর্দ্রতা লাগবে আঙুলে, কিন্তু তাদের শুষ্কতা মনকে আকৃষ্ট করবার মতো।
আকাশের প্রান্তে মেঘ আছে। অজস্র কালো চুলের সীমার মধ্যে চকচকে অবিশ্বাস্য টাকের মতো আকাশে গুটিকয়েক তারাও চকচক করছে। দূরের মেঘগুলির গতি দেখে সেগুলিকে কালো বর্ণের ফুটন্ত দ্রব্য বলে মনে হচ্ছে, যা-কিছু বাতাস মেঘের বীচিভঙ্গে সৃষ্টি হচ্ছে, বাধা পাচ্ছে, মেঘমুক্ত আকাশের অংশটুকু যেন আতপ্ত সৈকত মেঘের ঢেউগুলির স্নিগ্ধতা বহন করে যে-বাতাসটুকু আসছে সেটুকু আতপ্ত তটভূমির স্পর্শে তপ্ত হয়ে উঠছে। রুক্ষতার একটা অনুভূতি অন্যান্য বোধগুলির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে, পরিবর্তিত করেছে সেগুলিকে, দুটি শ্রাবণের ঘণ্টার মধ্যে একখণ্ড ফাল্গুনের সময় এসে পড়েছে যেন।
গর্হিত অন্যায় কিছু নয়, অবাক করবার মতো, ধাক্কা দিয়ে জাগ্রত করে দেবার মতো বিষয়_ভাবলে দীপিতা। হয়তো কৌতুকের জন্যই এই বেশভূষা, তবু এক-একটি ব্যাপার এমন সন্দিহান করে তোলে মনকে। মনেপ্রাণে কি আমরা উপচার-প্রয়াসী? আমাদের রিয়ালিস্টিক দৃষ্টির গভীরে, র‌্যাশন্যাল জীবনপদ্ধতির আড়ালে ইন্দুর মতো একজন লুকিয়ে আছে। সেই জন্যই কি দিনমানের উচ্ছ্বাসবৃত্তি রাত্রির অবসরে এমন প্রগল্ভ হয়ে ওঠে। এতটুকু ফিকে হতে দেবে না, উপচার-বাহুল্যে আস্বাদনকে পীড়িত না-করে ছাড়বে না? কীটস্ভক্ত ইন্দুর মতো।
এত স্বাভাবিক ছিল এসব ব্যাপার যে কেউ বিচার করার কথা চিন্তাও করেনি। আজ বিচার করতে হচ্ছে : মালা গেঁথেছিল, ভামিনী বউ শাদা বেলফুলের মালা, বিকাশের গলায় পরিয়ে দেননি ভামিনী বউদি, লজ্জার বাধা নয়, দীপিতা গেঁথেছিল, সেও পরাতো। বিকাশ ফিরে এসে মালা দেখে খুশি হয়েছিল, প'রে নয়। এটা খুব বড় কথা নয়, জীবনদর্শনও নয়, তবু যেন রুচি ও চিন্তাধারার প্রতীক।
দীপিতা প্রশ্ন করল, অভ্যাসের ফলেই কি এমন হয়েছিল, নতুবা ভামিনীর কি সাধ ছিল বেলফুলের মালাটা প্রিয়জনের গলায় তুলে দিয়ে প্রতীক্ষায় ঊর্ধ্বমুখী হয়ে দাঁড়াতে পারেনি অভ্যস্ত নয় বলে।
দীপিতা জানালার কাছে উঠে গিয়ে গরাদে দেহভার রেখে দাঁড়াল। অভ্যাসের ফলে হয়েছে, ভাবতে একটু কষ্ট হলো, কারণ অভ্যাসের ফল মানে অনেক দিন অভিনয় করার ফল।
বিকাশের ছেলেটি, যে শুধু ভালোবাসা কেড়ে নেবার জন্য আঙুল বাড়াতে শিখেছিল, একদিন অব্যক্ত ব্যথায় মায়ের মুখের দিকে চেয়ে থাকতে-থাকতে নীল হয়ে কেঁদে উঠে বিদায় নিয়েছিল। সেদিন দীপিতা হাহাকার করে কেঁদে উঠতে গিয়ে বিকাশের মুখের দিকে চেয়ে শঙ্কিত হয়েছিল, শোককে ছাপিয়ে উঠেছিল মানুষের মননশীলতার প্রতি শ্রদ্ধা। বিকাশ ম্লান হেসে বলেছিল_ওকে ফুল দিয়ে সাজাবি, বরং মসলিনের নিষ্পাপ কিছু একটা পরিয়ে দে। ভামিনী শিশুমুখের দিকে চেয়ে থেকে একটা-বা অশ্রুর ধারা মুছে রোজকার মতো সাজিয়ে দিলেন।
শুধু কি অভ্যস্ততা, এত বড় বেদনার মুহূর্তেও কি অভ্যাস বড় হয়ে ওঠে? দীপিতার সন্দেহ হলো, সব আলো নিভিয়ে দিয়ে এলে সন্দেহ, বোধ হয় অনুভব ছিল না, হাহাকার করে কেঁদে উঠবার মতো প্রাণের সাড়া।
কিন্তু দীপিতা হাসল, হেসে বলতে পারল নিজেকে : দীপিতা তুমি একটি উনিশ বছরের মেয়ে মাত্র। এখনও সুস্থ সবল চিন্তাধারা তোমার নিজস্বত্বের কাঠিন্য অর্জন করতে পারেনি, অন্যান্য কারো চিন্তার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। এখন হাতে-মুখে জল দিয়ে বিছানায় যাও। কপালের রগ দুটিকে মাসাজ করে দিয়ো, ঘুমিয়ে পড়বে। কাল সকালে যখন সকালের খটখটে রোদে উঠে দাঁড়াবে তখন এপস্টাইনের মর্মরের মতো বাহুল্যবর্জিতের পরিপূর্ণতায় প্রকাশ পাবে তুমি।
তবু ভাবল দীপিতা : এখন মনে পড়ে না ঘুমাবার আগে অর্গল খোলা ছিল কিম্বা ঘুমের মাঝখানে উঠে দাঁড়িয়ে দরজাটার দিকে চেয়ে তার মনে হয়েছিল ওপারে ইন্দু হয়তো হাত-দুখানা প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে আছে তার মতো, দরজার অর্গল খুলে দিয়েছিল সে।
বর্ষণক্ষান্ত আকাশের দিকে চেয়ে দীপিতা দাঁড়িয়েছিল, তখন ইন্দু এল ঘরে, তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল বাইরের দৃশ্যের অংশ নিয়ে।
ইন্দু বলেছিল_আপনার পড়বার ঘরে ব্রাউনিং খুঁজে পেলাম না।
ব্রাউনিং খুঁজে দিয়ে ফিরে আসবার অনুভূতি এখনও লেগে আছে গায়ে, কিন্তু আরো অদ্ভুত বোধ হয় ভাবতে গেলে। ইন্দু শুধু বলেছিল_শুনুন, দীপিতা ঘরের প্রায় আধখানা হেঁটে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ইন্দুর পাশে।
ইন্দু বলেছিল তোমার চুলগুলি খুলে দাও বাইরের ঐ অন্ধকারকে আরো স্নিগ্ধ করে, কথা বোলো না। প্রজাপতি-ডানার নিচের অন্ধকারের মতো কোমল নীরবতায় ডুবে যাও। কথা বোলো না, পাতার আড়ালে একটি ডানার ছায়ায় আর-এক জোড়া ডানা স্বপন দেখছে চ্যুতমঞ্জরীর।
ইন্দু কথা না-বললে কী হতো কে জানে, ইন্দুর কথায় দীপিতার সন্মোহন টুটে গিয়েছিল, হেসে সে বলেছিল_পিলিয়াস মেলিসান্ডার কথা বলছেন? মেটারলিংক তাহলে ভালো লাগে আপনার?
না, আঘাত দেয়নি দীপিতা। অধ্যাপকের উপস্থিতিতে সাহিত্য আলোচনা করবার মতো লঘু হাসি ছিল তার ঠোঁটে।
টিনের ঘরে ফিরে এসে মনে হয়েছিল, সিনক্রিয়েট করা হলো যেন। যেন প্রেমনিবেদনভীতা ত্রস্তা কিশোরীর পলায়ন।
অতঃপর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সে স্বচ্ছ গলায় বলেছিল_ও ইন্দুবাবু, আসুন। ঘুম হচ্ছে না, হয়ও না এ-অবস্থায়, পোকার খেলি বরং।
দীপিতার সলিলকি করা অভ্যাস নয়, তবু মনে হলো আবার : তুমি কি চেষ্টা করে আজ ঘুমাতে পারো না। ইতিমধ্যে তুমি যা নয় তা চিন্তা করতে শুরু করেছ, আরো কিছুক্ষণ জেগে থাকলে নেশা মাথায় উঠবার মতো অবস্থা হবে তোমার। কাল সকালে থাকবে তা নয়, ঘুম ভালো না-হলে কাল সারাদিনই মস্তিষ্ক ভালো কাজ করবে না। নেশার পরে ভোঁতা বিস্বাদ জিহ্বার মতো হয়ে থাকবে মন। কাজেই বুঝলে... কাজেই উনিশ বছরের মেয়েটির মতো বিছানায় তালগোল পাকিয়ে রৌদ্রতৃপ্ত পুষির মতো ঘুমিয়ে পড়বে।
তথাপি প্রায় কেঁদে ফেলার মতো মুখ নিয়ে চেয়ারে ফিরে এল দীপিতা, ইন্দুর সেই মেটারলিংক প্রভাবিত রাত্রির কথা মনে পড়ে গেল। ইন্দুর ঘর তারই নিজেরই পড়বার ঘর, সেই দিন রাত্রির জন্য ইন্দুর ঘর হয়েছিল, ব্রাউনিং খুঁজে দিতে সবার মতো পুরুষের স্পর্শ-উদ্বেল অন্ধকার আজও ঘরে।
মনে হলো : যে-আগ্রহে ইন্দু কবি হয়ে ওঠে সেটা কি ভাব?
ইন্দুর উপপাদ্য একটা বিষয় মনে পড়ল_বিংশ শতকে এসে দেখছি আমরা রুক্ষ হয়ে উঠেছি, যে-কূপ থেকে উদ্বেল হয়ে ওঠে প্রাণরস, শুকিয়ে গেছে সেটা। বিশ্বাস নেই কিছুতেই থাকলেও স্বীকার করি না, কারণ বিশ্বাস জিনিসটা মধ্যযুগের ব্যাপার, সেই জন্যই তাকে বর্জন করেছি।
খুব অন্যায় করেছি? মধ্যযুগের পোশাকটা বর্জন করবার সময়ে ন্যায় ও অন্যায়ের কোনো প্রশ্ন যেমন ওঠে না, এটার বেলাতে হলে ক্ষতি কী?
ইন্দু এ রকম পরিস্থিতিতে ঠোঁট দুটি আলগা করে রাখে, বোকামির চিহ্ন নয়, কথা বলবার, তর্কের কোণ চেপে ধরবার আগ্রহাতিশয্যে সে টপ করে বলে বসল, 'দেখুন এই সাহিত্যিক অমিয়বাবুর কথাই ধরুন, আপনার প্রিয়জনস্থানীয় অমিয়বাবুর, যখন ভাবের প্রসারতায় সহানুভূতিতে যখন তাঁর চোখ দুটি করুণায় ভরে উঠবার লক্ষণ দেখাচ্ছে, কলমকে অব্যাহত ছেড়ে দিলে যখন গ্রীক ক্লাসিকের স্বল্প পরিমিত গভীর বেদনার দু-চারটে কথা লিখে ফেলবেন মনে হচ্ছে, ঠিক তখনই টপিকাল কোনো কথা উত্থাপন করে বাজে কথার অবতারণা করে নিজের ভাবাবেগকে ব্যঙ্গ করে নিজের লেখাটাকে থার্ড ক্লাস করে তুলবেন। এটা হচ্ছে একটা পোজ, যুগের ভঙ্গি। ডেমোক্রাসির রিঅ্যাকশন।'
বক্তৃতা দেবার সময়ে ইন্দুর মাংসল চোয়াল দুটি স্থূলভাবে নড়ে-নড়ে ওঠে।
দীপিতা জ্বালাময় চোখের সম্মুখে ভার্জিনিয়া উল্ফই খুলে বসল। হাতের কাছে পেয়ে এমন স্পস্ট ভাষায় নিজেদের কথা কে বলেছে, কোথায় এমন বর্তমানের আলোকসম্পাত?
কিন্তু চোখে পড়ে গেল_না-না, আমরা পারছি না, প্রাচীনদের মতো কোনো মহৎ সৃষ্টি। সেই সুর, পরাজয়ের অবিশ্বাসের আজকের রাত্রির সুর। মনে হলো : বিশ্বাস ত্যাগ করাটা উচিত হয়নি। বিশ্বাস জিনিসটা অবিভাজ্য, প্রাচীনের প্রতি সব বিশ্বাস ত্যাগ করতে গিয়ে বর্তমানে বিশ্বাস রাখা আর সম্ভব নয়।
মনে হলো আশ্রয় চাই কিছু। সহসা সিগারেটের অনাস্বাদিতপূর্ব ধোঁয়ার অদম্য পিপাসা বোধ করল সে। ছেলেমানুষি করে কেনা ডাকপিওনের মতো চামড়ার কাঁধব্যাগ হাঁটকে বেরোল কয়েকদিন পূর্বে ব্রাভাডো দেখানোর জন্য সীতার কেনা বিবর্ণ এক প্যাকেট সিগারেট, যেটা দীপিতা শাসনের ভঙ্গিতে কেড়ে নিয়েছিল।
মুখে একটা তোবড়ানো সিগারেট গুঁজে পুরুষের ভঙ্গিতে টেবিলের উপরে পা তুলে বসল। নেই নেই কিছু নেই, মহৎ কোনো সম্পদ প্রাণরসের কোনো চিহ্ন_এমনি হাহাকারে শেষ হয়েছিল ভার্জিনিয়া উল্ফের জীবন, এ-কথাটাও মনে পড়ে গেল।
চেয়ারের পিঠে মাথা হেলিয়ে দীপিতা, মুখে তোবড়ানো সিগারেট ঝুলে আছে। হঠাৎ ঘুম এলো দুর্নিবার মোহের মতো বাইরের আকাশে গুরু-গুরু বর্ষণ নামামাত্র। বাঁ-দিকের বুকটায় গরাদের চাপে ব্যথা হয়ে আছে, ঘুমের ঘোরে একখানা হাত সে-ব্যথাটাকে স্পর্শ করে রইল।
  লাশকাটা ঘরকায়েস আহমেদ 
অঙ্কন : চিন্ময় দেবর্ষি

¦

লাশকাটা ঘর
লাশকাটা ঘরকায়েস আহমেদ
মানুষটা কালীনাথ বড় চুপচাপ।
তবে কাজের লোক। ছোট-বড় যে কোন কাজ বড় মনোযোগের সঙ্গে করে। বড় কাজ করার সুযোগ অবশ্য তার জীবনে আসেনি কখনো।
'চিন্তাহরণ মেডিকেল স্টোর'-এ ওষুধ বেচে আর মিকশ্চার তৈরী করেই তার তিরিশ বছর কেটে গেলো, ২৫ বছর বয়সে ঢুকেছিলো এখানে, এখন চুল দাড়ি পেকেছে, চামড়া কুঁচকেছে, গাল মুখ ভেঙেছে, কপাল চওড়া করে টাক পড়েছে, মানুষটার স্বভাব বদলায়নি। আগে ধুতির ওপর হাতে-কাচা হাফশার্ট পরতো, ৬৪'র দাঙ্গার পর ধুতি ছেড়েছে, এখন তার নিত্যদিনের পোশাক শার্ট পাজামা।
হাফ শার্ট পরা মানুষ বড় একটা দেখা যায় না আজকাল। কালীনাথ আজো হাফ শার্ট পরে। এর দ্বারা অবশ্য তার বৈশিষ্ট্য সচেতনতা বোঝানো হচ্ছে না। অনেক কিছুর মতোই এটা তার স্রেফ অভ্যাস।
চিন্তাহরণ মেডিকেল স্টোরে তার চাকরী করাটাও যেন অভ্যাস। রোজ সকালে টুকটুক করে হাঁটতে হাঁটতে এসে দোকানে ঢোকে।
রাস্তা ঘাটে কতো ধরনের রগড় হয়। না হোক, হাঁটতে হাঁটতে মানুষ এদিক ওদিক তাকায়ও তো। কালীনাথের ওসব নেই। বাড়ী থেকে মাথা হেঁট করে এই যে বেরুলো আর মাথা তোলবার নামটি নেই। একেবারে সোজা এসে দোকানে। যেনো দম দেওয়া পুতুল। মেকাররা যেমন তৈরী করে দিয়েছে ঠিক তেমনটি। খদ্দের এসে হয়তো বললো : 'লারগ্যাকটিল সিরাপ' আছে? যদি থাকে কোন কথা না বলে আলমারী থেকে ফাইলটি বার করে এনে কাউন্টারের ওপর রাখে। যদি না থাকে, বলবে : 'নাই'।
'নাই' শব্দটি শুধুই একটি ধ্বনি, চোখে মুখে কালীনাথের কোন অভিব্যক্তি ফোটে না। খদ্দের যদি বলে : 'কোথায় পাবো বলতে পারেন?'
কালীনাথ এবার আর মুখে বলবে না, মাথাটি খুব সংক্ষিপ্ত নাড়িয়ে জানিয়ে দেবে সে জানে না।
হয়তো কালীনাথ হার্ডবোর্ডের পার্টিশন দেওয়া খুপরীটায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মিকশ্চার বানাচ্ছে। দোকানের মালিক ললিতবাবু কোন ব্যাপারে হয়তো ডাকলেন। কালীনাথ কোন জবাব না দিয়ে খুপরী থেকে বেরিয়ে এসে ললিতবাবুর মুখের দিকে তাকাবে। ললিতবাবু কোন কথা জিজ্ঞেস করলে অতি সংক্ষিপ্ত জবাব অথবা মস্তকের হ্যাঁ বা না বাচক মুদ্রা দেখিয়ে আবার খুপরীর ভেতর ঢুকে গিয়ে আপন কাজে মগ্ন হয়ে যায়।
মিকশ্চার বানানোর কাজটা তার অবশ্য সারাদিন করতে হয় না। বিকেলবেলা ৫টা থেকে ৭টা এই দু'ঘণ্টার জন্যে ডাঃ আব্দুল হান্নান এসে বসেন। (তার জন্যে একপাশে আর একটা খুপরী আছে।) তখন কালীনাথকে ইনজেকশন ফোঁড়া, মিকশ্চার বানানো_এইসব টুকটাক কম্পাউন্ডারীর কাজটুকু করতে হয়।
এই সময়টা ললিতবাবু নিজেই খদ্দের সামলান। তবে মিকশ্চার টিকশ্চার আজকালকার ডাক্তাররা দেয় না বড় একটা। ইনজেকশন আর পেটেন্ট ওষুধই চালায়।
ইনজেকশন ফোঁড়ার জন্যে রুগী প্রতি দু'টাকা। এই টাকাটা কালীনাথের উপরি আয়। কাছাকাছি সিরিয়াস রুগী হলে অবশ্য বাড়ীতে গিয়ে ফুঁড়ে আসতে হয়। কাজটা কালীনাথের মোটেই পছন্দ নয়, তবু বাধ্য হয়ে যেতে হয় অনেক সময়। স্বামীর এই অপছন্দের ব্যাপারটা গিরিবালার কাছে নিতান্তই অপরাধের। গিরিবালা বলে : বজ্জাতি।
'হাবাইত্তা মিনসা কি কম! মিটমিটা শয়তান। কারুর সুখ চায় না। খালি নিজেরটা বোঝে। ক্যান, কি এমুন জমিদার খান অইছ যে মানষের বারিত্ গিয়া ইন্জিশন দিলে মান যাইবো? আহা মান অলারে, গোয়ার নাই চাম রাধাকিষ্ট নাম। হুঁঃ।'
চ্যবনপ্রাস খেতে খেতে নিশিকান্ত বলে : 'মানুষটারে একটু শান্তিতে থাকতে দিবো না, রাইত দিন'...বাক্যটি সম্পূর্ণ করতে পারে না, তার মুখের চামড়া দলামোচা কাগজের মতো কুঁচকে যায়, চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসে, গলার রগ ফুলে ফেটে যেতে চায়। বিছানার ওপর বসে বসে প্রবল ঝড়ের ঝাপটায় টালমাটাল নিশিকান্ত নুয়ে নুয়ে পড়ে।
হৈমবতী স্বামীর পিঠে এক হাত বুকে এক হাত রেখে বুলোতে থাকে। পেটের ভেতর সাত মাসের সন্তান পিতার কাশির শব্দে কেঁপে কেঁপে ওঠে।
'কতো কই বালো দেইখ্যা এ্যালাপাথি ওষুধ খাও, ডাক্তার দ্যাহাও, তা না কি ছাতার এক চব্বনপাস পাইছে'_রাগে দুঃখে মমতায় তার কথা ভিজে চপচপে হয়ে জড়িয়ে যায়।
নিশিকান্ত'র কি হয় কে জানে, তার কাশির ঝড় থেমে আসে, বিছানার ওপর হাতের ভর দিয়ে একদিকে ঘাড়-মাথা হেলিয়ে সে মুখ হাঁ করে শ্বাস নেয়, তার তোবড়ানো বুকটি বেগে ওঠা নামা করে, আর সেখান থেকে একটানা ঘড় ঘড়ানি নিয়ে হোঁ...হোঁ...শব্দ বেরিয়ে আসতে থাকে নিশিকান্তর মুখ দিয়ে।
হৈমবতী ধীরে ধীরে স্বামীকে শুইয়ে দিয়ে বাতাস করতে থাকে। বাতাস করতে করতে সারিসারি ঘুমিয়ে থাকা ছেলেমেয়েদের দিকে এক পলক তাকিয়ে দুর্জ্ঞেয় কারণে দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্বামীর দিকে মনোযোগী হয় আবার।
এই সময় হৈমবতী সাইকেলের শব্দ পায়। মনোতোষ মাস্টার প্রাইভেট পড়িয়ে ফিরলো। পারেও লোকটা। সকাল বেলা বাজার-হাট করে দিয়ে এক ঝাঁক ছেলে পড়িয়ে স্নান খাওয়া-দাওয়া ক'রে স্কুলে ছোটে, দুপুরে একবার খেতে আসে, তারপর এইরাত দশটা সাড়ে দশটায় ফিরলো। এর মধ্যে আবার রাজনীতিও করে।
ঘরে বাইরে লোকজনকে মহা উৎসাহে তার রাজনীতি বোঝায়, কতো কি যে বলে, ও ছাইভস্ম বোঝেও না হৈমবতী শুনতেও চায় না।
নিশিকান্ত পার্টি-ফার্টির ধার কাছেও নেই, কিন্তু রাজনীতির আলোচনায় বড় উৎসাহী। চাকরী করে সাধনা ঔষধালয়ের এক ব্রাঞ্চে। প্রত্যেকদিন দোকানে বসে খবরের কাগজটি তার পড়া চাই। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে। মাঝে মাঝে বলে : 'হঃ, হ্যারা করবো রাজনীতি। নেতা আছিলো দেশবন্ধু, নেতা আছিলো নেতাজী সুভাষ বোস, গান্ধী। খালি চিককুর পারলেই যদি নেতা হওন যাইতো'...কাশির ধমকে মাঝ পথেই থামতে হয় তাকে।
একটু দম নিয়ে নিশিকান্ত স্ত্রীকে বোঝায় : 'বুঝলানি, ওই মন্তোষ মাস্টারের সমাজতন্ত্র, ওই সব অইলো গিয়া বুলি, এক হালারে বালো মনে করো তুমি? সব খালি বোচকা মারনের ফন্দি।'
হৈমবতী দেশবন্ধু, নেতাজী, গান্ধী কাউকেই চেনে না, রাজনীতির অতো ঘোরপ্যাঁচও বোঝে না, কিন্তু সে মনোতোষ মাস্টারকে চেনে, হাসি খুশি মানুষটা, মনে কুনো কালি নাই, ঠ্যাকা বেঠ্যাকায় দুই দশ টাকা পাওন যায়।
_'মন্তোষ মাস্টারের কথাগুলো তো খারাপ না।'
_'আহ্, খারাপ তোমারে কইতাছে কে, কিন্তু করনের লোকটা দেহাও।'
_'হ, তোমার লগে অহন আজাইরা প্যাচাল পারি। আমার আর খাইয়া কাম নাই।' হৈমবতী ঘাড় টান করে সংসার সামলাতে উঠে যায়।
মনোতোষ মাস্টারের স্কুলের বেতন এবং ছেলে পড়িয়ে মাসিক আয় হাজার দুয়েক টাকার মতো। সংসারে মানুষ বলতে স্বামী-স্ত্রী আর ছোট দুটো ছেলে-মেয়ে। গ্রামের বাড়ীতে বাপ আছে, ডাক্তারী করে, জায়গা জমি দেখা শোনা করে, মামলা মকদ্দমা সামলায়। সম্প্রতি বোনটি বিধবা হয়েছে, তাকে কিছু কিছু সাহায্য করতে হয় এই যা।
হৈমবতী মনোতোষের স্ত্রী জয়াকে বলে, 'তোমার চিন্তা কি, তোমার ছোট পরিবার সুখী পরিবার, আমাগো অইলো গিয়া হুয়োরের পাল।' হাসতে হাসতেই বলে হৈমবতী। কিন্তু জয়ার মুখ কিঞ্চিৎ গম্ভীর হয়ে যায় : 'হ, মানুষ বাইর থেইক্যা ওইটাই দ্যাখে।'
হৈমবতী এতোটুকু হয়ে যায় : 'আমি কিন্তু কিছু ভাইব্যা কই নাই, মনে কষ্ট নিও না।' জয়ার মুখ-ভার তবু কাটে না। হৈমবতী সে দিকে তাকিয়ে বলে : 'না, কাম পইরা রইছে, উঠি।'
মনে মনে হৈমবতী জ্বলে : 'মাগীর গাও ভরা হিংসা। বিধবা ননদরে মাসে ছয় মাসে ৫০/১০০টা টাকা দিতে অয়, তাতেই বুক ফাটে, স্বামী তো এদিকে শুনি ধইন্যা না শ্যামপুরে জমি রাখছে তিন কাঠা।'
রাতের বেলা শুয়ে শুয়ে নিশিকান্ত বলে : 'বুঝলা শিবুর মা, এইসব ওইলো তোমার গিয়া বিজনেস, বুঝছো, মহাজনরা যেমুন চাইল ডাইল মজুত কইরা বাজারে দাম বারায়, সুযোগ বুইজ্যা চরা দামে মাল বেচে, এ-ও হেমুন; জাগা জমিনের দাম বারতাছে, অহন সস্তায় কিন্যা থুইলো, দুই তিন বছর থাউক না পইরা, আরবের পয়সা আইতাছে মানুষের আতে, দুই চার বছর পর ওই জমি মন্তোষ ৮ গুণ দামে বেচবো_বুজলা অহন, সমাজতন্ত্র কারে কয়? হুঁঃ'
জয়া গিরিবালাকে বলে : 'কি কমু মাসীমা, কি যে পায় রাজনীতির মইদ্যে, আমার বালো লাগে না, পোলাপান বয়সে করছে করছে, অহন কি? থাকি হ্যাকেগো দ্যাশে, হ্যাগো মাথা গরম, কুনসুম কি অয় কওন যায়? আমরা অইলাম গিয়া ইন্দু মানুষ, আমাগো অতো মাথা ব্যথা ক্যান? হ্যাগো দ্যাশ হ্যারা যেম্নে মনে লয় চালাউকগা, তোমার অতো রাজনীতির আউস ক্যান?'
কুয়োতলা থেকে সর্বানী জবাব দেয় : 'পুরুষ মান্ষের কতো রকমের আউস থাকে, তাই ধরলে কি আর চলে?'
সর্বানীর স্বামী বাসুদেব ফরাসগঞ্জের কোন আড়তে চাকরী করে। মদ গাঁজা খায়, জুয়া খেলে, বেপাড়ায় যায়, সর্বানীর মুখে 'পুরুষ মান্ষের কতো রকমের আউস থাকে' কথাটায় জয়ার কোথা যেনো ঘা খেলো।_কোথায় বাসুদেব, একটা অশিক্ষিত, মাতাল, যার সংসারে, দু'বেলা ঠিক মতো হাঁড়ি চড়ে না, যে বৌ পেটায়, তার সঙ্গে যেনো সর্বানী মনোতোষকে একই পাল্লায় তুলে দিচ্ছে। জয়ার ভেতরটা রি-রি করে।
'হ, আউস তো অনেক রকমের, কেউ মদ গাঞ্জা খায়, জুয়া খেলে, বাজে পারায় যায়, হেইটাও আউস, আর কেউ রাজনীতি করে হেইটাও আউস; কি কন মাসীমা, দুইটা কি এক অইলো?'
'কী!'_সর্বানী সটান দাঁড়িয়ে পড়ে, তার আঁটসাঁট শরীরটা ফণা তোলা সাপের মতো দুলতে থাকে : 'আমার স্বামী মদ গাঞ্জা খায় নিজে কামাই কইরা খায়, জুয়া খেলে নিজের পয়সায় খেলে তাতে কার কি'_হাত নেড়ে দু'চোখে আগুন নিয়ে সর্বানী চিৎকার করে বাতাস কাটতে থাকে : 'আমার স্বামী বাজে পারায় যায়? ক্যান কারুর আত দইরা কুনদিন টান দিছে, না কাউরে নিয়া'...
_'চুপ করো।' গিরিবালা ধমক দিয়ে সর্বানীকে মাঝপথে থামিয়ে দিতে চায়। একটানা কথা বলে হাঁফ ধরে গিয়েছিলো, ছোট্ট করে শ্বাস টেনে সর্বানী আবার শুরু করে : 'না চুপ করুম ক্যান, বিচার করেন, কি খারাপ কথাটা কইছি আমি, হেয় আমার স্বামীর কথা কইবো? আমার স্বামী নি তারে নিয়ে কুনদিন'...
_'আহ চুপ করো না, তোমার স্বামীর নাম নিয়া তো কয় নাই।'
_'ওইসব আমরা বুঝি'...
জয়া তেতো কথার খোঁচা যেমন দিতে পারে, ঝগড়া ততোটা গুছিয়ে করতে পারে না। তার জড়িয়ে জড়িয়ে যাওয়া কথা সর্বানীর চড়া গলায় আওয়াজের নীচে চাপা পড়ে যেতে থাকে। এর মধ্যেই সে খুব একটা জুৎসই কথা বলে সর্বানীকে কাবু করতে পারে অবশ্য, কিন্তু সামনে গিরিবালা, তাছাড়া বলে পরে সর্বানীকেই সামলাতে পারবে বলেও ভরসা পায় না।
ব্যাপারটা আর কিছু নয়, গিরিবালার বড় ছেলে সুকুমার, যে ইদানীং মাস্তান হয়ে উঠেছে, সেদিন রাত্রে, বাসুদেব তখনো ফেরেনি, জয়া নিজের চোখে দেখেছে, সর্বানীকে সাপ্টে ধরে চুমু খাচ্ছে।
হৈমবতী শুয়ে ছিলো, তার শরীরটা ততো ভালো নয়, বিকেল শেষ হয়ে আসছে তবু তার উঠতে ভালো লাগছিলো না, আর এমন সময় হঠাৎ এই ঝগড়া; সে কোন কথা বললো না, তক্তপোষের ওপর শুয়ে শুয়ে জানালা দিয়ে না দেখার ভান করে ঝগড়া দেখতে লাগলো। কী যে ভালো লাগছে তার, মাগীর বড় দেমাক, বোঝ্ অহন কেমুন লাগে। হেই দিনকা হাউস তামাসা কইরা একখানা কথা কইছিলাম, ওমা তাইতে মাগীর কি গোস্সা।
বাড়ীটা একতলা। সরু সরু নীচু দরজা, ফোকরের মতো জানালা, ঘরের ভেতর ঢুকলে প্রথমেই মনে হবে ঠেলা দিয়ে দেওয়ালগুলোকে সরিয়ে দিই; এর ভেতরই তক্তপোষ, বাঙ্-প্যাটরা, সস্তা দামের আলমারী, আলনা, ছেঁড়া লেপের তুলো ভরা চটের বস্তা, চালের টিন, গমের টিন, হাজারো গণ্ডা জিনিসপত্র স্যাঁতসেঁতে ঘরকে আরো অন্ধকার করে রাখে।
রাস্তার দিকে পিঠ করে দাঁড়ানো দুটি কামরার একটিতে থাকে কালীনাথ অপরটিতে নিশিকান্ত। কালীনাথের ঘরের গায়েই লাগানো সদর দরজা, সদর দরজার মাথাটি কালীনাথের ঘরের ছাদের সঙ্গে মিলে কার্নিশের শেষ সীমানা পর্যন্ত এসেছে : একদিকে বাড়ীর পাঁচিলের কাঁধে ভর অপর দিকে ঘরের কার্নিশে, ফলে সদর দরজা দিয়ে ঢুকলেই মনে হয় একটা সুড়ঙ্গ, সুড়ঙ্গটি পেরুলেই এক খামচা উঠোন, উঠোন এবং পাঁচিলের গা ঘেঁষে তুলসী মঞ্চ, একটি গন্ধরাজ ফুলের গাছ, কয়েকটা সন্ধ্যামালতী, গোটা তিনেক কলাবতী, তার লাগোয়া ঘরটি মনোতোষ সরকারের। ওধারে, কল, কুয়োতলা এবং পায়খানার দিকে টিনের চালের ঘরটিতে থাকে বাসুদেব। বেড়ার দেওয়াল আর দিনের চালের রান্নাঘরগুলো যার যার ঘরের সামনে বা পাশে।
এই বাড়ীতেই দীপালীর জন্ম, কিন্তু আজকাল তার দম বন্ধ হয়ে আসে। আগে তবু যা হোক সারাদিনটা স্কুলে তার বেশ কাটতো। আজ এক বছর তা-ও বন্ধ হয়েছে। এই ক'দিনে ফুলে-ফেঁপে কী বড়ই না হয়ে গেছে সে। নিজেরই লজ্জা লাগে, মা তবু তাকে শাড়ী পরতে দেবে না।
গিরিবালা যতোই চেষ্টা করুক, দীপালীর ভেতরে যে আর একটি দীপালী আছে গিরিবালার সাধ্য কি তাকে সেলাই করা কাপড়ে বেঁধে রাখে, সময় নেই অসময় নেই দীপালী ঠেসে স্বপ্ন দেখে! কিন্তু এই স্বল্প পরিসর ঘর থেকে, এই বাড়ীর চৌহদ্দি থেকে তার স্বপ্নকে কতোদূর আর নিয়ে যেতে পারে কালীনাথের মেয়ে?
কালীনাথের ছেলে থালাটাকে সামনের দিকে ঠেলে দিয়ে চাপা গলায় গর্জন করে ওঠে : 'এই দিয়া খাওন যায়?' হারিকেনের আলোয় তার ঘাড় পর্যন্ত নেমে আসা কোঁকড়ানো চুলভরা মাথার বিশাল ছায়া মেঝের ওপর ভল্লুকের মতো নড়ে।
_'ই হি রে নবাব পুত্তুর, খাওন যায় না! লজ্জা করে না কথা কইতে? একখান ফুটা পয়সার মুরাদ নাই, আবার বর বর কথা_' এই দিয়া খাওন যায়?_মুখ বিকৃত করে মাথা দুলিয়ে গিরিবালা ভারী কুৎসিত একখানা ভঙ্গি করে। 'খাইতে তরে কয় কে? যা না যে বন্দুগো লগে রাইত দিন আড্ডা দিয়া বেরাস হ্যাগো কাছে যা গিয়া রাইত দুফুরে অহন আইছস মুখ নারতে! এত বড় জুয়ান গাববুর একখান, একটু যদি চিন্তা করে, একটু যদি ভাবে!'
থালাটা একটানে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে উঠে বেরিয়ে গেলে ঠিক ঠাক মানানসই কাজটা হয় এখন। কিন্তু সুকুমার ওঠে না। ধারালো চোখমুখ, টানটান ঘাড় নিয়ে ম্যাচ-ম্যাচ করে ভাত মাখতে থাকে মাথা নিচু করে। দেখলে মনে হয় সে ভাত মাখছে না আটা ছানছে।
'বোইনটা বর অইতাছে তার বিয়া দিতে ওইবো, ছোট ছোট ভাইবোন গুলার মানুষ করতে অইবো, এতোবড় পোলা হেই চিন্তা নাই।'...
সুকুমার মুখ তোলে, তার চোখ মুখ থমথমে : 'করুমটা কি? চাকরী আমার লেইগ্যা বহায়া থুইছে সব। ক্যান, বাবা'...
গিরিবালা কথাটা চিলের মতো ছোঁ মেরে ধরে : 'ওই মেচিবিলাই তরে চাকরী দিবো? কথা কইতে জানে মান্ষের লগে? ভগোবান অর মুখ দিছে? হ্যায় আছে সব কয়টিরে চিতায় তুইল্যা দিয়া পিণ্ডি দেওনের অপেক্ষায়। হ্যায় তরে দিবো চাকরী ঠিক কইর‌্যা।'
গিরিবালার তোপের মুখ কালীনাথের দিকে ঘুরে যায় : 'হারা জনম আমারে জ্বালাইয়া কয়লা করছে। হ্যায় কি একটা মানুষ? পুরুষ মানুষ এমুন অয়? বাপ দাদার ভিটাখান রক্ষা করতে পারলো না, একদিন গিয়া খারাইলো না পর্যন্ত! অখন মোসলমানেরা ভোগ করতাছে!'
সরু তক্তপোষ এখন চিতা, তার ওপর কালীনাথের শব। গিরিবালা এবং সুকুমার ভারী চমৎকারভাবে চিতা জ্বালাতে থাকে। মুখের দিক থেকে আগুন আস্তে আস্তে বুক পেট পায়ের দিকে ছড়িয়ে পড়তে পড়তে এক সময় সমস্ত চিতা দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। কালীনাথকে আর আলাদা ক'রে চেনা যায় না। গোটা কালীনাথই এখন অগি্নময় চিতা। ছোট্ট ঘরের ভেতর সেই প্রচণ্ড আগুনের উত্তাপ হা হা ক'রে ফিরতে থাকে। ঊর্ধ্বমুখী রক্তাভ অগি্নশিখা কড়ি বরগাতে গিয়ে ছোবল মারে। ধোঁয়ায় ঘর ভরে যায়। মেঝের ওপর সার সার ঘুমন্ত ভাই-বোনের পাশে-পড়ে-থাকা দীপালীর চোখে সেই ধোঁয়া এসে লাগে। দীপালীর চোখ জ্বালা করে। দু'চোখ বেয়ে জল বিরিয়ে আসতে থাকে তার।
'দ্যাহ কুত্তার বাচ্চারা রাইত দুফুরে'...নিশিকান্ত গিরিবালা সুকুমারকে বিড়বিড় করে গালাগালি করে একা একা। কিন্তু গালাগালিটা খুব জুৎসই করে করতে পারে না। মগজের সঙ্গে বাঁধা সুতোগুলোয় টান পড়ে। কপালের দু'পাশের রগ টনটন করে। চোখ মুখ কামড়ে নিশিকান্ত কাশি ঠেকায়।
হৈমবতীর ঘুম বড়ো বেশী, একবার যদি বিছানায় পিঠ দিলো তো গেলো। কিছুক্ষণ আগেও কোমরের কশি ঢিলে করে সে তার সাত মাসের গাভীন পেট মেলে চোখ বুঁজে চিৎ হয়ে পড়ে স্বামীর আদর নিচ্ছিলো; আর অহন দ্যাহ কেমুন নিশ্চিন্তে ঘুমাইতেছে। 'মাইয়া মানুষটার খালি আছে খাওন, ঘুমান আর'... বাকী অনুপ্রাসটি কাশির জন্যে উচ্চারণ করতে পারে না নিশিকান্ত, তাতে তার রাগ আর একটু বাড়ে।
রাগ মনোতোষেরও বাড়ে। তার পা থেকে আগুনের একটি হলকা মাথার ভেতর গিয়ে ধাক্কা মারে। সেই আগুনের উত্তাপে মনোতোষের চোখ-মুখ ঝলসে যায়। জয়া গোঁজ হয়ে বসে আছে। টেবিলের ওপর খাতাটাকে আছড়ে ফেলে দিয়ে মুহূর্ত কয়েক কিছুই বলতে পারে না মনোতোষ, শুধু নিজের হৃৎপিণ্ডের শব্দ শোনে।
_'তোমারে নিয়া আর পারা গেলো না।'
তার ক্রোধের তুলনায় বাক্যটি বড় বেমানান, কিন্তু মনোতোষের গলার আওয়াজে টের পাওয়া যায় কী অসীম চেষ্টায় সে নিজেকে সামলাচ্ছে। মনোতোষ দম নেয়। 'তোমার মনটা হইল এতটুক, বুঝলা?'
মনোতোষ জয়ার দিকে হাত বাড়িয়ে ডান হাতের পাঁচটি আঙুলকে একত্রিত ক'রে মনের আয়তনটা দেখায়। জয়া চোখ তুলতে গিয়েও তোলে না। তুললে দেখতে পেতো রাগটা মনোতোষের হঠাৎ করে নয়। বহুদিন ধরে একটু একটু করে জমতে জমতে ক্রোধ যখন গরল হয়ে যায় কেবলমাত্র তখনই রাগের সময় মুখের চেহারা মানুষের এমন হয়ে থাকে।
_'বাবায় আইতে চায় না ক্যান জানো? শুধু তোমার কারণে। তুমি'...
জয়া ফোঁস করে উঠে : 'ক্যান, আমি তারে কী কইছি?'
'কইতে হয় নাকি, মানুষের ব্যবহারেই বোঝন যায়।'
_'তখন মনে আছিলো না? ভাল ব্যবহারের মানুষ আনলেই পারতা।'
_'তখন কি আর এত বুঝছি। তখন তো তুমি রং ঢং দিয়া ভুলাইয়াছিলা।'
বিষের জ্বালায় জয়া ছটফট করে : 'কী, আমি রং ঢং দিয়া ভুলাইয়াছিলাম তোমারে? তুমি এইকথা কইলা?'
রাগের মাথায় কথাটা বড়ো খারাপ বলে ফেলেছে মনোতোষ। কিন্তু তখন যা হবার হয়ে গেছে। জয়া দেওয়ালে মাথা ঠুকতে থাকে।
মনোতোষ উঠে গিয়ে জয়াকে ধরে : 'আহ্, কি পাগলামী কর।' গলার স্বরকে মনোতোষ প্রাণপণ বদলে ফেলতে চায়।
_'না', তুমি আমারে ধরবা না, ছার, তোমারে আমি চিনছি, আর মিঠা কথা কইতে ওইবো না।'
চোখে জল এসে যায়। গালের জ্বলুনি মগজ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু কোন কথা বলে না, দু'হাতে গাল ঢেকে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। তার মাথায় চুল ভেঙে ছড়িয়ে পড়েছে, আঁচল লুটোচ্ছে, একদিকের স্তনচক্রের আভাস বাসুদেবকে আরো ক্ষিপ্ত করে : 'আমি বুঝি না, না? রাইত দিন ঠাকুর পো ঠাকুর পো! ক্যান, অতো মাখামাখি ক্যান'...টলমল পায়ে বাসুদেব এগোয়, আত্মরক্ষার জন্যে সর্বানী সামনে ঝোঁকে। বাসুদেব প্রহার করে না, আঁচল ধরে টান দেয় : 'আঁ?' এই 'আঁ' ধ্বনি দিয়ে সে বাক্যটিকে সম্পূর্ণ করে। নিরুত্তর সর্বানী প্রতি মুহূর্তে চপেটাঘাতের আশঙ্কায় কেঁপে কেঁপে ওঠে। বাসুদেব ক্ষিপ্রহাতে সর্বানীর বস্ত্র হরণ করে।
মধ্যম পুত্রটির ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো, ঘুম চোখে হারিকেনের আলোয় বাসুদেবের কংসমূর্তি, চাপা গর্জন এবং উলঙ্গ মাতৃ-দর্শনে ছিটিয়ে পড়ে থাকে সে।
'তরে খুন কইরা ফালামু'_বাসুদেব ন্যাংটো সর্বানীকে হ্যাঁচকা টানে কাছে নিয়ে আসে। অতঃপর ঘাড়ে রদ্দা মারলে সর্বানী তার শরীরে বাসুদেবের প্রত্যাশিত ভঙ্গিটি এনে ফেলে। বাসুদেব মেঝের ওপর সর্বানীকে কুকুরের মতো রমণ করতে থাকে।
কালীনাথ আস্তে আস্তে তক্তপোষ থেকে নামে। পা টিপে টিপে দরজার কাছে যায়। নিশিকান্ত প্রবল বেগে শ্বাস টানছে। কালীনাথ নিঃশব্দে দরজার খিল খোলে। বাইরে এসে চারপাশে তাকায়, নিথর বাড়ীটায় শুধু নিশিকান্তর শ্বাস টানার শব্দ। কালীনাথ সুড়ঙ্গের মুখে এসে দাঁড়ায়। তার বিভ্রম আসে, মনে হয় আর একটু এগোলেই কঠিন কয়লার বিশাল চাঙটায় ঘা খেয়ে তার নাক মুখ থেঁতলে যাবে। কালীনাথ হাত বাড়ায়, তার হাত অন্ধকার শূন্যতায় কোথাও ঠাঁই পায় না। দু'পা এগিয়ে সে আবার থমকায়, মনে হয় এই অন্ধকারের ভেতর কালো লোমশ একটা জন্তু গুঁড়ি মেরে বসে বসে কপিস চোখে দেখছে তাকে। কালীনাথ হৃৎপিণ্ডের শব্দ শোনে। শব্দটি তার নিজের না জন্তুটির? কালীনাথের আবার বিভ্রম আসে। হঠাৎ তার পায়ের ওপর দিয়ে কিচকিচ ক'রে ছুঁচো দৌড়োয় সামনের দিকে। কালীনাথ চমকে লাফিয়ে ওঠে। আর সঙ্গে সঙ্গে নিজের হৃৎপিণ্ডের শব্দটিকে স্পষ্ট চিনতে পারে এবার।
এই শব্দ তার মস্তিষ্কে কী কাজ করে কে জানে, কালীনাথ অন্ধকারে ভেতর দু'হাত মেলে হাঁতড়ে হাঁতড়ে সদর দরজাটা খুঁজতে খুঁজতে এগিয়ে যেতে থাকে।
মনে হয় সুড়ঙ্গ ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে, একবার মনে হয় ঐ তো সামনে খিল আঁটা বিশাল সদর দরজাটা দাঁড়িয়ে রয়েছে। একটা মোহ্নমে আচ্ছন্ন করে ফেলতে থাকে তাকে। কালীনাথ দরজার কাছে যাবার জন্যে অস্থির হয়। আর তখন ছাদের কার্নিশে প্যাঁচাটা ডেকে ওঠে।
'রাইত দুপুরে আর ডং করণ লাগবো না বুরা বয়সে।' কালীনাথ একটি হাতের স্পর্শ পায় পিঠে : 'চল'। হাতটি তাকে ঘুরিয়ে দেয়। সদর দরজা এখন কালীনাথের পেছন দিকে।
অন্ধকারে অদৃশ্য গিরিবালা তাকে পেছন থেকে ঠেলে : 'মরতে চাইলে একাই মরণ লাগবো, বুছছো, অখন আর সহমরণ নাই।'
কালীনাথের পা শিথিল হয়ে আসে। প্যাঁচার ডাকটা তার মাথার ভেতরে ঢুকে গিয়ে বোঁ বোঁ করে ঘোরে।
গিরিবালাকে আর ধাক্কা দিতে হয় না, কালীনাথ নিজেই হাঁটতে থাকে মাথা ঝুঁকিয়ে। এতোক্ষণে কালীনাথ সঠিক কালীনাথে ফিরে আসে। কেননা এই ভঙ্গিটি তার একান্ত নিজস্ব।
 বেদেনীতারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়  
অঙ্কন : বিপ্লব চক্রবর্ত্তী

¦

বেদেনী
বেদেনীতারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
শম্ভু বাজিকর এ মেলায় প্রতি বৎসর আসে। তাহার বসিবার স্থানটা মা কঙ্কালীর এস্টেটের খাতায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মতো কায়েমি হইয়া গিয়াছে। লোকে বলে, বাজি; কিন্তু শম্ভু বলে 'ভোজবাজি-ছারকাছ'। ছোট তাঁবুটার প্রবেশপথের মাথার উপরেই কাপড়ে আঁকা একটা সাইনবোর্ডেও লেখা আছে 'ভোজবাজি-সার্কাস'। লেখাটার একপাশে একটা বাঘের ছবি, অপরদিকে একটা মানুষ, তাহার এক হাতে রক্তাক্ত তরবারি, অপর হাতে একটি ছিন্নমুণ্ডু। প্রবেশমূল্য মাত্র দুইটি পয়সা। ভিতরে আছে কিন্তু 'গোলকধামে'র খেলা। ভিতরে পট টাঙাইয়া কাপড়ের পর্দায় শম্ভু মোটা লেন্স লাগাইয়া দেয়, পল্লীবাসীরা বিমুগ্ধ বিস্ময়ে সেই লেন্সের মধ্যে দিয়া দেখে 'আংরেজ লোকের যুদ্ধ,' 'দিল্লীকা বাদশা', 'কাবুলকে পাহাড়', 'তাজ-বিবিকা কবর'। তারপর শম্ভু লোহার রিং লইয়া খেলা দেখায়, সর্বশেষে একটা পর্দা ঠেলিয়া দিয়া দেখায় খাঁচায় বন্দি একটা চিতাবাঘ। বাঘটাকে বাহিরে আনিয়া তাহার উপরে শম্ভুর স্ত্রী রাধিকা বেদেনী চাপিয়া বসে, বাঘের সম্মুখের থাবা দুইটা ধরিয়া টানিয়া তুলিয়া আপন ঘাড়ের উপর চাপাইয়া তাহার সহিত মুখোমুখি দাঁড়াইয়া বাঘের চুমা খায়, সর্বশেষে বাঘটার মুখের ভিতর আপনার প্রকাণ্ড চুলের খোঁপাটা পুরিয়া দেয়, মনে হয়, মাথাটাই বাঘের মুখের মধ্যে পুরিয়া দিল। সরল পল্লীবাসীরা স্তম্ভিত বিস্ময়ে নিশ্বাস রুদ্ধ করিয়া দেখিতে দেখিতে করতালি দিয়া উঠে। তাহার পরেই খেলা শেষ হয়, দর্শকের দল বাহির হইয়া যায়, সর্বশেষ দর্শকটির সঙ্গে শম্ভুও বাহির হইয়া আসিয়া আবার তাঁবুর দুয়ারে জয়ঢাক পিটিতে থাকে_দুম-দুম, দুম। জয়ঢাকের সঙ্গে স্ত্রী রাধিকা বেদেনী প্রকাণ্ড একজোড়া করতাল বাজায় ঝন- ঝন-ঝন।
মধ্যে মধ্যে শম্ভু হাঁকে, বড় বাঘ! এ বড় বা-ঘ।
পক্ষীরাজ ঘোড়া হয়, মানুষের চুমা খায়, জ্যান্ত মানুষের মাথা মুখের মধ্যে পোরে, কিন্তু খায় না।
কথাগুলো শেষ করিয়াই সে ভিতরে গিয়ে বাঘটাকে একটা তীক্ষ্নাগ্র অঙ্কুশ দিয়া খোঁচা মারে, সঙ্গে সঙ্গে বাঘটা বার বার গর্জন করিতে থাকে। তাঁবুর দুয়ারের সম্মুখে সমবেত জনতা ভীতিপূর্ণ কৌতূহলস্পন্দিত বক্ষে তাঁবুর দিকে অগ্রসর হয়।
দুয়ারের পাশে দাঁড়াইয়া বেদেনী দুইটি করিয়া পয়সা লইয়া তবে প্রবেশ করিতে দেয়। এ ছাড়াও বেদেনীর নিজের খেলাও আছে। তাহার আছে একটা ছাগল, বাঁদর আর গোটাকয়েক সাপ। সকাল হইতেই সে আপনার ঝুলি-ঝাঁপি লইয়া গ্রামে বাহির হয়, গৃহস্থের বাড়ি বাড়ি খেলা দেখাইয়া, গান গাহিয়া উপার্জন করিয়া আনে।
এবার শম্ভু কঙ্কালীর মেলায় আসিয়া ভীষণ ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিল। কোথা হইতে আর একটা বাজির তাঁবু আসিয়া বসিয়া গিয়াছে। তাহার জন্যে নির্দিষ্ট জায়গাটা অবশ্য খালিই পড়িয়া আছে, কিন্তু এ বাজির তাঁবুটা অনেক বড় এবং কায়দাকরণেও অনেক অভিনবত্ব আছে। বাহিরে দুইটা ঘোড়া, একটা গরুর গাড়ির উপর প্রকাণ্ড একটা খাঁচা, নিশ্চয় উহাতে বাঘ আছে।
গরুর গাড়ি তিনখানা নামাইয়া শম্ভু নূতন তাঁবুর দিকে মর্মান্তিক ঘৃণায় হিংস্র দৃষ্টিতে চাহিল, তারপর আক্রোশভরা নিম্নকণ্ঠে বলিল, শালা!
তাহার মুখ ভীষণ হইয়া উঠিল। শম্ভুর সমগ্র আকৃতির মধ্যে একটা নিষ্ঠুর হিংস্র ছাপ যেন মাখানো আছে। ক্রূর নিষ্ঠুরতা পরিব্যঞ্জক একধারার উগ্র তামাটে রং আছে_শম্ভুর দেহবর্ণ সেই উগ্র তামাটে; আকৃতি দীর্ঘ, সর্বাঙ্গে একটা শ্রীহীন কঠোরতা, মুখে কপালের নিচেই নাকে একটা খাঁজ, সাপের মতো ছোট ছোট গোল চোখ, তাহার উপর সে দন্তু, সম্মুখের দুইটা দাঁত কেমন বাঁকা হিংস্র ভঙ্গিতে অহরহ বাহিরে জাগিয়া থাকে। হিংসায়, ক্রোধে সে যেন ভয়াবহ হইয়া উঠিল।
রাধিকাও হিংসায়, ক্রোধে, ধারালো ছুরি যেমন আলোকের স্পর্শে চকমক করিয়া উঠে, তেমনই ঝকমক করিয়া উঠিল, সে বলিল, দাঁড়া খাঁচায় দিব গোক্ষুরার ডেঁকা ছেড়্যা!
রাধিকার উত্তেজনার স্পর্শে শম্ভু আরো উত্তেজিত হইয়া উঠিল, সে ক্রুদ্ধ দীর্ঘ পদক্ষেপে অগ্রসর হইয়া নূতন তাঁবুটার ভিতর ঢুকিয়া বলিল, কে বেটে, মালিক কে বেটে? কি চাই?_তাঁবুর ভিতরের আর একটা ঘরের পর্দা ঠেলিয়ে বাহির হইয়া আসিল একটি জোয়ান পুরুষ, ছয় ফিটেরও অধিক লম্বা, শরীরের প্রতি অবয়বটি সবল এবং দৃঢ়, কিন্তু তবুও দেখিলে চোখ জুড়াইয়া যায়, লম্বা হাল্কা দেহ, তাজা ঘোড়া যেমন একটি মনোরম লাবণ্যে ঝকমক করে_লোকটির হাল্কা অথচ সবল দৃঢ় শরীরে তেমনই একটি লাবণ্য আছে। রং কালোই, নাকটি লম্বা টিকালো, চোখ দুইটি সাধারণ, পাতলা ঠোঁট দুইটির উপর তুলি দিয়া আঁকা গোঁফের মতো এক জোড়া গোঁফ-সূচাগ্র করিয়া পাক দেওয়া, মাথায় বাবরি চুল, গলায় ঝুলানো একটি সোনার ছোট চৌকা তক্তি,_সে আসিয়া শম্ভুর সম্মুখে দাঁড়াইল!
দুজনেই দুইজনকে দেখিতেছিল।
কি চাই?_নূতন বাজিকর আবার প্রশ্ন করিল, কথার সঙ্গে সঙ্গে মদের গন্ধে শম্ভুর নাকের নিচের বায়ুস্তর ভুরভুর করিয়া উঠিল।
শম্ভু খপ করিয়া ডান হাত দিয়া তাহার বাঁ হাতটা চাপিয়া ধরিল, বলিল, এ জায়গা আমার।
আমি আজ পাঁচ বৎসর এইখানে বসছি।
ছোকরাটিও খপ করিয়া আপন ডান হাতে শম্ভুর বাঁ হাত চাপিয়া ধরিয়া মাতালের হাসি হাসিল, বলিল, সে হবে, আগে মদ খাও টুকটা।
শম্ভুর পিছনে জলতরঙ্গ বাদ্যযন্ত্রে দ্রুততম গতিতে যেন গৎ বাজিয়া উঠিল, রাধিকা কখন আসিয়া শম্ভুর পিছনে দাঁড়াইয়াছিল, সে খিল খিল করিয়া হাসিয়া উঠিল, বলিল, কটি বোতল আছে তুমার নাগর_মদ খাওয়াইবা?
ছোকরাটি শম্ভুর মুখ হইতে পিছনের দিকে চাহিয়া রাধিকাকে দেখিয়া বিস্ময়ে মোহে কথা হারাইয়া নির্বাক হইয়া গেল। কালো সাপিনীর মতো ক্ষীণতনু দীর্ঘাঙ্গিনী বেদেনীর সর্বাঙ্গে যেন মাদকতা মাখা; তাহার ঘন কুঞ্চিত কালো চুলে, চুলের মাঝখানে সাদা সুতার মতো সিঁথিতে, তাহার ঈষৎ বঙ্কিম নাকে, টাকা অর্ধ-নিমীলিত ভঙ্গির মদিরদৃষ্টি দুটি চোখে, সূচালো চিবুকটিতে_সর্বাঙ্গে মাদকতা। সে যেন মদিরার সমুদ্রে সদ্য স্নান করিয়া উঠিল; মাদকতা তাহার সর্বাঙ্গ বাহিয়া ঝরিয়া ঝরিয়া পড়িতেছে। মহুয়াফুলের গন্ধ যেমন নিশ্বাসে ভরিয়া দেয় মাদকতা, বেদেনীর কালো রূপও চোখে তেমনই একটা ধরাইয়া দেয় নেশা। শুধু রাধিকাই নয়, এই বেদেজাতের মেয়েদের এটা একটা জাতিগত রূপবৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্য রাধিকার রূপের মধ্যে একটা যেন প্রতীকের সৃষ্টি করিয়াছে; কিন্তু মোহময় মাদকতার মধ্যে আছে ক্ষুরের মতো ধার, মোহমত্ত পুরুষকেও থমকিয়া দাঁড়াইতে হয়, মোহের মধ্যে ভয়ের চেতনা জাগাইয়া তোলে, বুকে ধরিলে হৃৎপিণ্ড পর্যন্ত ছিন্নবিচ্ছিন্ন হইয়া যাইবে।
রাধিকার খিল খিল হাসি থামে নাই, সে নূতন বাজিকরের বিস্ময়বিহ্বল নীরব অবস্থা দেখিয়া আবার বলিল, বাক হর‌্যা গেল যে নাগরের?
বাজিকর এবার হাসিয়া বলিল, বেদের বাচ্চা গো আমি। বেদের ঘরের মদের অভাব! এস। কথা সত্য, এই অদ্ভুত জাতটি মদ কখন কিনিয়া খায় না। উহারা লুকাইয়া চোলাই করে, ধরাও পড়ে, জেলেও যায়। কিন্তু তা বলিয়া স্বভাব কখন ছাড়ে না। শাসন-বিভাগের নিকট পর্যন্ত ইহাদের এ অপরাধটা অতি সাধারণ হিসাবে লঘু হইয়া দাঁড়াইয়াছে।
শম্ভুর বুকখানা নিশ্বাসে ভরিয়া এতখানি হইয়া উঠিল। আহ্বানকারীও তাহার স্বজাতি, নতুবা_। সে রাধিকার দিকে ফিরিয়া কঠিন দৃষ্টিতে চাহিয়া বলিল, তুই আইলি কেনে এখেনে?
রাধিকা এবারও খিল খিল করিয়া হাসিয়া বলিল, মরণ তুমার! আমি মদ খাব নাই?
তাঁবুর ভিতরে ছোট একটা প্রকোষ্ঠের মধ্যে মদের আড্ডা বসিল। চারদিকে পাখির মাংসের টুকরা টুকরা হাড়ের কুচি ও একরাশি মুড়ি ছড়াইয়া পড়িয়া আছে; একটা পাতায় এখনও খানিকটা মাংস, আর একটায় কিছু মুড়ি, পেঁয়াজ, লঙ্কা, খানিকটা নুন, দুইটি খালি বোতল গড়াইতেছে, একটা বোতল অর্ধসমাপ্ত। বিস্রস্তবসনা একটি বেদের মেয়ে পাশেই নেশায় অচেতন হইয়া পড়িয়া আছে, মাথার চুল ধুলায় রুক্ষ, হাত দুইটি মাথার উপর দিয়া ঊর্ধ্ববাহুর ভঙ্গিতে মাটির উপর লুণ্ঠিত, মুখে তখনও মদের ফেনা বুদ্বুদের মতো লাগিয়া রহিয়াছে। হৃষ্টপুষ্ট শান্তশিষ্ট চেহারার মেয়েটি।
রাধিকা তাহাকে দেখিয়া আবার খিল খিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। বলিল, তুমার বেদেনী? ই যি কাটা কলাগাছের পারা পড়েছে গো!
নূতন বাজিকর হাসিল, তারপর সে স্খলিতপদে খানিকটা অগ্রসর হইয়া একটা স্থানের আলগা মাটি সরাইয়া দুইটা বোতল বাহির করিয়া আনিল।
মদ খাইতে খাইতে কথা যাহা বলিবার বলিতেছিল নূতন বাজিকর আর রাধিকা।
শম্ভু মত্ততার মধ্যেও গম্ভীর হইয়া বসিয়া ছিল। প্রথম পাত্র পান করিয়াই রাধিকা বলিল, কি নাম গো তুমার বাজিকর?
নূতন বাজিকর কাঁচা লঙ্কা খানিকটা দাঁতে কাটিয়া বলিল, নাম শুনলি গালি দিবা আমাকে বেদেনী।
কেনে?
নাম বটে কিষ্টো বেদে।
তা গালি দিব কেনে?
তুমার নাম যে রাধিকা বেদেনী, তাই বুলছি।
রাধিকা খিল খিল করিয়া হাসিয়া গড়াইয়া পড়িল। পরক্ষণেই সে কাপড়ের ভিতর হইতে ক্ষিপ্রহস্তে কি বাহির করিয়া নূতন বাজিকরের গায়ে ছুড়িয়া দিয়া বলিল, কই, কালিয়দমন কর দেখি কিষ্টো, দেখি!
শম্ভু চঞ্চল হইয়া পড়িল; কিন্তু কিষ্টো বেদে ক্ষিপ্র হাতে আঘাত করিয়া সেটাকে মাটিতে ফেলিয়া দিল। একটা কালো কেউটের বাচ্চা। আহত সর্পশিশু হিস গর্জন করিয়া ফণা তুলিয়া দংশনোদ্যত হইয়া উঠিল : শম্ভু চিৎকার করিয়া উঠিল, আ-কামা! অর্থাৎ বিষ দাঁত এখনও ভাঙা হয় নাই। কিষ্টো কিন্তু ততক্ষণে তাহার মাথাটা বাঁ হাতে চাপিয়া ধরিয়া হাসিতে আরম্ভ করিয়া দিয়াছে। হাসিতে হাসিতে সে ডান হাতে ট্যাঁক হইতে ছোট একটা ছুরি বাহির করিয়া দাঁত দিয়া খুলিয়া ফেলিল এবং সাপটার বিষদাঁত ও বিশেষ থলি দুইই কাটিয়া ফেলিয়া রাধিকার গায়ে আবার ছুড়িয়া দিল। রাধিকাও বাঁ হাতে সাপটাকে ধরিয়া ফেলিল; কিন্তু রাগে সে মুহূর্ত পূর্বের ঐ সাপটার মতোই ফুলিয়া উঠিল, বলিল_আমার সাপ তুমি কামাইলা কেনে?
কিষ্টো বলিল, তুমি যে বলল্যা গো দমন করতে।_বলিয়া সেও একবার হা হা করিয়া হাসিয়া উঠিল।
রাধিকা মুহূর্তে আসন ছাড়িয়া উঠিয়া তাঁবু হইতে বাহির হইয়া গেল।
সন্ধ্যার পূর্বেই।
নূতন তাঁবুতে আজ হইতেই খেলা দেখানো হইবে, সেখানে সমারোহ পড়িয়া গিয়াছে।
বাহিরে মাচা বাঁধিয়া সেটার উপর বাজনা বাজিতে আরম্ভ করিয়াছে, একটা প্রেট্রোম্যাঙ্ আলো জ্বালিবার উদ্যোগ হইতেছে। রাধিকা আপনাদের ছোট তাঁবুটির বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল। তাহাদের খেলার তাঁবু এখনও খাটানো হয় নাই। রাধিকার চোখ দুইটি হিংস্রভাবে যেন জ্বলিতেছিল।
শম্ভু নিকটেই একটা গাছতলায় নামাজ পড়িতেছিল; আরও একটু দূরে আর একটা গাছের পাশে নামাজ পড়িতেছিল কিষ্টো। বিচিত্র জাত বেদেরা। জাতি জিজ্ঞাসা করিলে বলে, বেদে। তবে ধর্মে ইসলাম। আচারে পুরা হিন্দু, মনসাপূজা করে, মঙ্গলচণ্ডী, যষ্ঠীর ব্রত করে, কালী দুর্গাকে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করে, নাম রাখে শম্ভু শিব কৃষ্ণ হরি, কালী দুর্গা রাধা লক্ষ্মী। হিন্দু পুরাণ কথা ইহাদের কণ্ঠস্থ। এমনই আরো একটি সম্প্রদায় পট দেখাইয়া হিন্দু পৌরাণিক গান করে, তাহারা নিজেদের বলে পটুয়া, পট তাহারা নিজেরাই আঁকে। বিবাহ আদান প্রদান সমগ্রভাবে ইসলাম ধর্মসম্প্রদায়ের সঙ্গে হয় না, নিজেদের এই বিশিষ্ট সম্প্রদায়ের মধ্যেই আবদ্ধ। বিবাহ হয় মোল্লার নিকট ইসলামীয় পদ্ধতিতে, মরিলে পোড়ায় না, কবর দেয়। জীবিকায় বাজিকর, সাপ ধরে, সাপ নাচাইয়া গান করে, বাঁদর ছাগল লইয়া খেলা দেখায়, অতি সাহসী কেহ কেহ এমনই তাঁবু খাটাইয়া বাঘ লইয়া খেলা দেখায়। কিন্তু এই নূতন তাঁবুর মতো সমারোহ করিয়া তাহাদের সম্প্রদায়ের কেহ কখন খেলা দেখায় নাই। রাধিকার চোখ ফাটিয়া জল আসিতেছিল। তাহার মনশ্চক্ষে কেবল ভাসিয়া উঠিতেছিল উহাদের সবল তরুণ বাঘটির কথা। ইহার মধ্যে লুকাইয়া সে বাঘটাকে কাঠের ফাঁক দিয়া দেখিয়া আসিয়াছে। সবল দৃঢ় ক্ষিপ্রতাব্যঞ্জক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, চকচকে চিকন লোম, মুখে হিংস্র হাসির মতো ভঙ্গি যেন অহরহই লাগিয়া আছে! আর তাহাদের বাঘটা স্থবির শিথিলদেহ, কর্কশলোম, খসখসে লোমগুলো দেখিলে রাধিকার শরীর ঘিনঘিন করিয়া উঠে। কতবার সে শম্ভুকে বলিয়াছে একটা নূতন বাঘ কিনিবার জন্য, কিন্তু শম্ভুর যে কি মমতা ঐ বাঘটির প্রতি, যাহার হেতু সে কিছুতেই খুঁজিয়া পায় না।
নামাজ সারিয়া শম্ভু আসিতেই সে গভীর ঘৃণা ও বিরক্তির সহিত বলিয়া উঠিল, তুর ঐ বুড়া বাঘের খেলা কেউ দেখতে আসবে নাই।
ক্রুদ্ধস্বরে শম্ভু বলিল, তু জানছিস সব!
রাধিকা নাসিকা কুঞ্চিত করিয়া কহিল, না জেনে না আমি! তু-ই জানছিস সব!
শম্ভু চুপ করিয়া রহিল, কিন্তু রাধিকা থামিল না, কয়েক মুহূর্ত চুপ করিয়া থাকিয়া সে বলিয়া উঠিল, ওরে মড়া, বুড়ার নাচন দেখতে কার কবে ভালো লাগে রে? আমারে বলে, তু জানছিস সব!
শম্ভু মুহূর্তে ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিল, পরিপূর্ণভাবে তাহার সিংস্র দুই পাটি দাঁত ঐ বাঘের ভঙ্গিতেই বাহির করিয়া সে বলিল, ছোকরার উপর বড় টান দেখি তুর!
রাধিকা সর্পিণীর মতো গর্জন করিয়া উঠিল, কি বুললি বেইমান?
শম্ভু আর কোনো কথা বলিল না, অঙ্কুশভীত মাঘের মতো ভঙ্গিতেই সেখান হইতে চলিয়া গেল।
ক্রোধে অভিমানে রাধিকার চোখ ফাটিয়া জল আসিল। বেইমান তাহাকে এতবড় কথাটা বলিয়া গেল? সব ভুলিয়া গিয়াছে সে? নিজের বয়সটাও তাহার মনে নাই? চলি্লশ বৎসরের পুরুষ, তুই তো বুড়া! রাধিকার বয়সের তুলনায় তুই বুড়া ছাড়া আর কি? রাধিকা এই সবে বাইশে পা দিয়েছে। সে কি দায়ে পড়িয়া শম্ভুকে বরণ করিয়াছে? রাধিকা তাড়াতাড়ি আপনাদের তাঁবুর ভিতরে ঢুকিয়া গেল।
সত্য কথা। সে আজ পাঁচ বৎসর আগের ঘটনা। রাধিকার বয়স তখন সতেরো। তাহারও তিন বৎসর পূর্বে শিবপদ বেদের সহিত তাহার বিবাহ হইয়াছিল। শিবপদ ছিল রাধিকার চেয়ে বৎসর তিনেকের বড়। আজও তাহার কথা মনে করিয়া রাধিকার দুঃখ হয়। শান্ত প্রকৃতির মানুষ, কোমল মুখশ্রী, বড় বড় চোখ, সে চোখের দৃষ্টি যেন মায়াবীর দৃষ্টি! সাপ, বাঁদর, ছাগল এ সবে তাহার আসক্তি ছিল না। সে করিত বেতের কাজ, ধামা বুনিত, চেয়ার পাল্কির ছাউনি করিত, ফুলের সৌখিন সাজি তৈয়ারি করিত, তাহাতে তাহার উপার্জন ছিল গ্রামের সকলের চেয়ে বেশি। তাহারা স্বামী-স্ত্রীতে বাহির হইত, সে কাঁধে ভার বহিয়া লইয়া যাইত তাহার বেতের জিনিস; রাধিকা লইয়া যাইত তাহার সাপের ঝাঁপি, বাঁদর, ছাগল। শিবপদর সঙ্গে আরো একটি যন্ত্র থাকিত, তাহার কোমরে গোঁজা থাকিত বাঁশের বাঁশি। রাধিকা যখন সাপ নাচাইয়া গান গাহিত, শিবপদ রাধিকার স্বরের সহিত মিলাইয়া বাঁশি বাজাইত। ইহা ছাড়াও শিবপদর আর একটা কত বড় গুণ ছিল। তাহাদের সামাজিক মজলিসে বৃদ্ধদের আসরেও তাহার ডাক পড়িত। অতি ধীর প্রকৃতির লোক শিবপদ এবং লেখাপড়াও কিছু কিছু নিজের চেষ্টায় শিখিয়াছিল, এই জন্য তাহার পরামর্শ প্রবীণরাও গ্রহণ করিত। গ্রামের মধ্যে সম্মান কত তাহার! আর সেই শিবপদ ছিল রাধিকার ক্রীতদাসের মতো। টাকা-কড়ি সব থাকিত রাধিকার কাছে। তাঁতে বোনা কালো রঙের জমির উপর সাদা সুতার খুব ঘন ঘন ঘরকাটা শাড়ি পরিতে রাধিকা খুব ভালোবাসিত, শিবপদ বারো মাস সেই কাপড়ই তাহাকে পরাইয়াছে।
এই সময় কোথা হইতে দশ বৎসর নিরুদ্দেশ থাকার পর আসিল এই শম্ভু, সঙ্গে এই বাঘটা, একটা ছেঁড়া তাঁবু, আর এক বিগতযৌবনা বেদেনী। বাঘ ও তাঁবু দেখিয়া সকলের তাক লাগিয়া গেল। প্রথম যেদিন রাধিকা শম্ভুকে দেখিল, সেই দিনের কথা আজও তাহার মনে আছে! সে এই উগ্র পিঙ্গলবর্ণ, উদ্ধতদৃষ্টি, কঠোর বলিষ্ঠ দেহ মানুষটিকে দেখিয়া বিস্মিত হইয়া গিয়াছিল।
শম্ভু তাহাকে দেখিতেছিল মুগ্ধ বিস্ময়ের সহিত; সেই প্রথম ডাকিয়া বলিল, এই বেদেনী, দেখি তুর সাপ কেমন?
রাধিকার কি যে হইয়াছিল, সে ফিক করিয়া হাসিয়া বলিয়াছিল, নাগরের সখ যে দেখি খুব! পয়সা দিবা?
বেশ মনে আছে, শম্ভু বলিয়াছিল, পয়সা দিব না, তু সাপ দেখাবে আমি বাঘ দেখাব। বাঘ! রাধিকা বিস্ময়ে স্তম্ভিত হইয়া গিয়াছিল। কে লোকটা? যেমন অদ্ভুত চেহারা; তেমনি অদ্ভুত কথা; বলে বাঘ দেখাইবে! সে তাহার মুখের দিকে তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে চাহিয়া বলিয়াছিল, সত্যি বলছ?
বেশ, দেখ, আগে আমার বাঘ দেখ! সে তাহাকে তাঁবুর ভিতরে লইয়া গিয়া সত্যই বাঘ দেখাইয়াছিল। রাধিকা সবিস্ময়ে তাহাকে প্রশ্ন করিয়াছিল, ই বাঘ নিয়া তুমি কি কর?
লড়াই করি, খেলা দেখাই।
হাঁ?
হাঁ, দেখবি তু?_বলিয়া সঙ্গে সঙ্গেই খাঁচা খুলিয়া বাঘটাকে বাহির করিয়া তাহার সামনের দুই থাবা দুই হাতে ধরিয়া তুলিয়া বাঘের সহিত মুখোমুখি দাঁড়াইয়াছিল। বেশ মনে আছে, রাধিকা বিস্ময়ে হতবাক হইয়া গিয়াছিল। শম্ভু বাঘটাকে খাঁচায় ভরিয়া রাধিকার সম্মুখে দাঁড়াইয়া বলিয়াছিল, তু এইবার সাপ দেখা আমাকে!
রাধিকা সে কথার উত্তর দেয় নাই, বলিয়াছিল, উটা তুমার পোষ মেনেছে?
হি হি করিয়া হাসিয়া শম্ভু সবলে তাহাকে জড়াইয়া ধরিয়া বলিয়াছিল, হিঁ, বাঘিনী পোষ মানাইতে আমি ওস্তাদ আছি।
কি যে হইয়াছিল রাধিকার এক বিন্দু আপত্তি পর্যন্ত করে নাই। দিনকয়েক পরেই সে শিবপদর সমস্ত সঞ্চিত অর্থ লইয়া সম্ভুর তাঁবুতে উঠিয়াছিল। শিবপদর চোখের জলে বুক ভাসিয়া গিয়াছিল, কিন্তু রাধিকার মমতা হওয়া দূরের কথা, লজ্জা হওয়া দূরে থাক, ঘৃণায় বীতরাগে তাহার অন্তর রি-রি করিয়া উঠিয়াছিল। রাধিকার মা-বাপ, গ্রামের সকলে তাহাকে ছি-ছি করিয়াছিল, কিন্তু রাধিকা সে গ্রাহ্যই করে নাই।
সেই রাধিকার আনীত অর্থে শম্ভুর এই তাঁবু ও খেলার অন্য সরঞ্জাম কেনা হইয়াছিল, সে অর্থ আজ নিঃশেষিত হইয়া আসিয়াছে, দুঃখেই দিন চলে আজকাল, শম্ভু যাহা রোজগার করে, সবই নেশায় উড়াইয়া দেয়, কিন্তু রাধিকা একটি দিনের জন্যেও দুঃখ করে নাই। আর সেই বেইমান কিনা এই কথা বলিল? সে একটা মদের বোতল বাহির করিয়া বসিল।
ওদিকে নূতন তাঁবুতে আবার বাজনা বাজিতেছে! দোসরা দফায় খেলা আরম্ভ হইবে। মদ খাইয়া রাধিকা হিংস্র হইয়া উঠিয়াছিল, ঐ বাজনার শব্দে তাহার সমস্ত অন্তরটা যেন রি-রি করিয়া উঠিল। উহাদের তাঁবুতে নিশীথ রাত্রে আগুন ধরাইয়া দিলে কেমন হয়? সহসা তাহাদের তাঁবুর বাহিরে শম্ভুর ক্রুদ্ধ উচ্চ কণ্ঠস্বর শুনিয়া সে মত্ততার উপর উত্তেজিত হইয়া বাহির হইয়া আসিল। দেখিল, শম্ভুর সম্মুখে দাঁড়াইয়া কিষ্টো। তাহার পরনে ঝকঝকে সাজ-পোশাক, চোখ রাঙ্গা, সেই তখন কথা বলিতেছিল, কেনে, ইথে দোষটা কি হলো? তুমরা ব'সে রইছ, আমাগোর খেলা হচ্ছে। খেলা দেখবার নেওতা দিলাম, তা দোষটা কি হলো?
শম্ভু চিৎকার করিয়া উঠিল, খেল দেখাবেন খেলোয়াড়ি আমার! অপমান করতে আসছিস ত!
কিষ্টো কি বলিতে গেল, কিন্তু তাহার পূর্বেই উত্তেজিত রাধিকা একটা ইট কুড়াইয়া লইয়া সজোরে তাহাকে লক্ষ্য করিয়া মারিয়া বসিল। অব্যর্থ লক্ষ্য, কিন্তু কিষ্টো অদ্ভুত, সে বলের মতো সেটাকে লুফিয়া ধরিয়া ফেলিল, তাহার পর ইটটাকে লুফিতে লুফিতে চলিয়া গেল। রাধিকা বিস্ময়ে সামান্য কয়েকটি মুহূর্ত যেন স্তম্ভিত হইয়া গিয়াছিল, সে ঘোর কাটাইতে সে বর্ধিত উত্তেজনায় আবার একটা ইট কুড়াইয়া লইল; কিন্তু শম্ভু তাহাকে নিবৃত্ত করিল, সে সাদরে তাহার হাত ধরিয়া তাঁবুর মধ্যে লইয়া গেল। রাধিকা বিপুল আবেগে শম্ভুর গলা জড়াইয়া ধরিয়া ফোঁপাইয়া ফোঁপাইয়া কাঁদিতে আরম্ভ করিল।
শম্ভু বলিল, এই মেলার বাদেই বাঘ কিনে লিয়ে আসব।
ওদিকের তাঁবু হইতে কিষ্টোর কণ্ঠস্বর ভাসিয়া আসিল, খোল কানাৎ, ফেলে দে খুল্যে। তাঁবুর একটা ছেঁড়া ফাঁক দিয়া রাধিকা দেখিল, তাঁবুর কানাৎ খুলিয়া দিতেছে, অর্থাৎ ভিতরে না গেলেও তাহারা যেন দেখিতে বাধ্য হয়। সে ক্রোধে গর্জন করিয়া উঠিল, দিব আগুন ধরাইয়া তাঁবুতে।
শম্ভু গম্ভীর হইয়া ভাবিতেছিল। কিষ্টো চলন্ত ঘোড়ার পিঠে দাঁড়াইয়া কসরৎ দেখাইতেছে। রাধিকা একটা গভীর দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, নতুন খেলা কিছু বার কর তুমি, নইলে বদনামি হবে, কেউ দেখবে না খেলা আমাগোর।
শম্ভু দাঁতে দাঁত চাপিয়া বলিল, কাল পুলিশে ধরাইয়া দিব শ্যালাকে। মদের সন্ধান দিয়া দিব।
ওদিকে টিয়াপাখিতে কামান দাগিল, সেই মেয়েটা তারের উপর ছাতা মাথায় দিয়া নাচিল, বাঘটার সহিত কিষ্টো লড়াই করিল, ইঃ_একটা থাবা বসাইয়াছে বাঘটা।
রাধিকা আপনাদের খেলার দৈন্যের কথা ভাবিয়া ঝরঝর করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল! সঙ্গে সঙ্গে আক্রোশও ফুলিতেছিল। তাঁবুটা আগুন ধরিয়া ধু-ধু করিয়া জ্বলিয়া যায়! কেরোসিন তেল ঢালিয়া আগুন ধরাইয়া দিলে কেমন হয়?
পরদিন সকালে উঠিয়া রাধিকার একটু দেরি হইয়া গিয়াছিল : উঠিয়া দেখিল শম্ভু নাই; সে বোধ হয় দুই চারজন মজুরের সন্ধানে গ্রামে গিয়াছে। বাহিরে আসিয়া সে শিহরিয়া উঠিল।
কিষ্টোর তাঁবুর চারিপাশে পুলিশ দাঁড়াইয়া আছে। দুয়ারে একজন দারোগা বসিয়া আছেন। এ কি? সে সটান গিয়া দারোগার সামনে সেলাম করিয়া দাঁড়াইল। দারোগা তাহার আপাদমস্তক দেখিয়া বলিলেন, ডাক সব, আমরা তাঁবু দেখব।
আবার সেলাম করিয়া বেদেনী বলিল, কি কসুর করলাম হুজুর?
মদ আছে কিনা দেখব আমরা। ডাক বেটাছেলেদের। এইখান থেকেই ডাক। রাধিকা বুঝিল, দারোগা তাহাকে এই তাঁবুরই লোক ভাবিয়াছেন, কিন্তু সে আর তাঁহার ভুল ভাঙিল না। সে বলিল, ভিতরে আমার কচি ছেলে রইছে হুজুর_আচ্ছা ছেলে নিয়ে আসতে পার তুমি। আর ডেকে দাও পুরুষদের। রাধিকা দ্রুত তাঁবুর মধ্যে প্রবেশ করিয়া সেই দেখা জায়গাটার আলগা মাটি সরাইয়া দেখিল, তিনটা বোতল তখনও মজুদ রহিয়াছে। সে একখানা কাপড় টানিয়া লইয়া ভাঁজ করিয়া বোতল তিনটাকে পুরিয়া ফেলিল, সুকৌশলে এমন করিয়া বুকে ধরিল শীতের দিনে সযত্নে বস্ত্রাবৃত অত্যন্ত কচি শিশু ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। তাঁবুর মধ্যেই কিষ্টো অঘোরে ঘুমাইতেছিল, পায়ের ঠেলা দিয়া তাহাকে জাগাইয়া দিয়া রাধিকা বলিল, পুলিশ আসছে, ব'সে রইছে দুয়ারে উঠ্যা যাও।
সে অকল্পিত সংযত পদক্ষেপে স্তন্যদানরত মাতার মতো শিশুকে যেন বুকে ধরিয়া বাহির হইয়া গেল। তাহার পিছনে পিছনেই কিষ্টো আসিয়া দারোগার সম্মুখে দাঁড়াইল।
দারোগা প্রশ্ন করিলেন, এ তাঁবু তোমার?
সেলাম করিয়া কিষ্টো বলিল, জি, হুজুর।
দেখব তাঁবু আমরা, মদ আছে কিনা দেখব।
মেলার ভিড়ের মধ্যে শিশুকে বুকে করিয়া বেদেনী ততক্ষণে জলরাশির মধ্যে জলবিন্দুর মতো মিশিয়া গিয়াছে। শম্ভু গুম হইয়া বসিয়া ছিল, রাধিকা উপুড় হইয়া পড়িয়া ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিতেছিল। শম্ভু তাহাকে নির্মম প্রহার করিয়াছে। শম্ভু ফিরিয়া আসিতে বিপুল কৌতুকে সে হাসিয়া পুলিশকে ঠকানোর বৃত্তান্ত বলিয়া তাহার গায়ে ঢলিয়া পড়িল, বলিল, ভেল্কি লাগায়ে দিছি দারোগার চোখে।
শম্ভু কঠিন আক্রোশভরা দৃষ্টিতে রাধিকার দিকে চাহিয়া রহিল, রাধিকার সে দিকে ভ্রূক্ষেপও ছিল না, সে হাসিয়া বলিল, খাবা, ছেলে খাবা?
শম্ভু অতর্কিতে তাহার চুলের মুঠি ধরিয়া নির্মমভাবে প্রহার করিয়া বলিল, সব মাটি ক'রে দিছিস তু; উহাকে আমি জেহেল দিয়ার লাগি, পুলিশে ব'লে এলাম, আর তু করলি ই কাণ্ড!
রাধিকা প্রথমটায় ভীষণ উগ্র হইয়া উঠিয়াছিল, কিন্তু শম্ভুর কথা সমস্তটা শুনিয়াই তাহার মনে পড়িয়া গেল গত রাত্রির কথা। সত্যই, এ কথা শম্ভু তো বলিয়াছিল! সে আর প্রতিবাদ করিল না, নীরবে শম্ভুর সমস্ত নির্যাতন সহ্য করিয়া উপুড় হইয়া পড়িয়া ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিতে লাগিল।
আজ অপরাহ্ন হইতে এ তাঁবুতেও খেলা আরম্ভ হইবে।
শম্ভু আপনার জীর্ণ পোশাকটা বাহির করিয়া পরিয়াছে, একটা কালো রঙের চোঙার মতো প্যান্টালুন, আর একটা কালো রঙেরই খাটো হাতা কোট। রাধিকার পরনের পুরনো রঙিন ঘাঘরা আর অত্যন্ত পুরনো একটা ফুলহাতা বডিস। অন্য সময় মাথার চুল সে বেণি বাঁধিয়া ঝুলাইয়া দিত; কিন্তু আজ সে বেণিই বাঁধিল না, আপনার সকল প্রকার দীনতা ও জীর্ণতার প্রতি অবজ্ঞায় ক্ষোভে তাহার যেন লজ্জায় মরিতে ইচ্ছা হইতেছিল। উহাদের তাঁবুতে কিষ্টোর সেই বিড়ালির মতো গাল মোটা, স্থবিরার মতো স্থূলাঙ্গি মেয়েটা পরিয়াছে গেঞ্জির মতো টাইট পাজামা, জামা, তাহার উপর জরিদার সবুজ সাটিনের একটা জাঙ্গিয়া ও কাঁচুলি ঢঙের বডিস। কুৎসিত মেয়েটাকেও যেন সুন্দর দেখাইতেছিল। উহাদের জয়ঢাকের বাজনার মধ্যে কাঁসা-পিতলের বাসনের আওয়াজের মতো একটা রেশ শেষকালে ঝঙ্কার দিয়া উঠে। আর এই কতকালের পুরনো একটা ঢ্যাপঢ্যাপে জয়ঢাক, ছি-!
কিন্তু তবুও সে প্রাণপণে চেষ্টা করে, জোরে জোরে করতাল পেটে।
শম্ভু বাজনা থামাইয়া হাঁকিল, ও-ই ব-ড়-বা-ঘ!
রাধিকা রুদ্ধস্বর কোনোমতে সাফ করিয়া লইয়া প্রশ্ন করিল, বড় বাঘ কি করে?
শম্ভু খুব উৎসাহভরেই বলিল, পক্ষীরাজ ঘোড়া হয়, মানুষের সঙ্গে যুদ্ধ করে, মানুষের মাথা মুখে ভরে, চিবায় না।
সে এবার লাফ দিয়া নামিয়া ভিতরে গিয়ে বাঘটাকে খোঁচা দিল, জীর্ণ বৃদ্ধ বনচারী হিংসক আর্তনাদের মতো গর্জন করিল।
সঙ্গে সঙ্গে ও-তাঁবুর ভিতর হইতে সবল পশুর তরুণ হিংস্র ক্রুদ্ধ গর্জন ধ্বনিত হইয়া উঠিল। মাচার উপরে রাধিকা দাঁড়াইয়াছিল, তার শরীর যেন ঝিমঝিম করিয়া উঠিল। ক্রূর হিংসাভরা দৃষ্টিতে সে ঐ তাঁবুর মাচানের দিকে চাহিয়া দেখিল, কিষ্টো হাসিতেছে! রাধিকার সহিত চোখাচোখি হইতেই সে হাঁকিল, ফিন একবার!
ও-তাঁবুর ভিতর হইতে দ্বিতীয়বার খোঁচা খাইয়া উহাদের বাঘটা এবার প্রবলতর গর্জনে হুঙ্কার দিয়া উঠিল। রাধিকার চোখে জ্বলিয়া উঠিল আগুন।
অল্প কয়টি লোক সস্তায় আমোদ দেখিবার জন্য শম্ভুর তাঁবুতে ঢুকিয়াছিল। খেলা শেষ হইয়া গেল, শম্ভু হিংস্র মুখ ভীষণ করিয়া বসিয়া রহিল। রাধিকা দ্রুতপদে মেলার মধ্যে বাহির হইয়া গেল। কিছুক্ষণ পরেই সে ফিরিল কিসের একটা টিন লইয়া।
শম্ভু বিরক্তি সত্ত্বেও সবিস্ময়ে প্রশ্ন করিল, কি উটা?
কেরাচিনি। আগুন লাগায়ে দিব উয়াদের তাঁবুতে। পুরা পেলম নাই, দু সের কম রইছে।
শম্ভুর চোখ হিংস্র দীপ্তিতে জ্বলিয়া উঠিল। সে বলিল, লিয়ে আয় মদ।
মদ খাইতে খাইতে রাধিকা বলিল, দাউ দাউ ক'রে জ্বলবেক যখন! সে খিল খিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। সে অন্ধকারের মধ্যে বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল, ঐ তাঁবুতে তখনো খেলা চলিতেছে। তাঁবুর ছেঁড়া মাথা দিয়া দেখা যাইতেছিল, কিষ্টো দড়িতে ঝুলানো কাঠের লাঠিতে দোল খাইতে খাইতে কসরৎ দেখাইতেছে।
উঃ, একটা ছাড়িয়া আর একটা ধরিয়া দুলিতে লাগিল! দর্শকেরা করতালি দিতেছে।
শম্ভু তাহাকে আকর্ষণ করিয়া বলিল, এখুনলয়, সে-ই নিশুত-রাতে!
তাহারা আবার মদ লইয়া বসিল।
সমস্ত মেলাটা শান্ত স্তব্ধ; অন্ধকারে সব ভরিয়া উঠিয়াছে। বেদেনী ধীরে ধীরে উঠিল, এক মুহূর্তের জন্য তাহার চোখে ঘুম আসে নাই। বুকের মধ্যে একটা অস্থিরতায়, মনের একটা দুর্দান্ত জ্বালায় সে অহরহ যেন পীড়িত হইতেছে। সে বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল। গাঢ় অন্ধকার থমথম করিতেছে। সমস্ত নিস্তব্ধ। সে খানিকটা এদিক হইতে ওদিক পর্যন্ত ঘুরিয়া আসিল, কেহ কোথাও জাগিয়া নাই। সে আসিয়া তাঁবুতে ঢুকিল, ফস করিয়া একটা দেশলাই জ্বালাইল, ঐ কেরাসিনের টিনটা রহিয়াছে। তারপর শম্ভুকে ডাকিতে গিয়া দেখিল, সে শীতে কুকুরের মতো কুণ্ডলী পাকাইয়া অঘোরে ঘুমাইতেছে। তাহার উপর ক্রোধে ঘৃণায় রাধিকার মন ছি-ছি করিয়া উঠিল। অপমান ভুলিয়া গিয়াছে, ঘুম আসিয়াছে! সে শম্ভুকে ডাকিল না, দেশলাইটা চুলের খোঁপায় গুঁজিয়া, টিনটা হাতে লইয়া একাই বাহির হইয়া গেল।
ঐ পিছন দিক হইতে দিতে হইবে। ওদিকটা সমস্ত পুড়িয়া তবে এদিকে মেলাটার লোকে আলোর শিখা দেখিতে পাইবে। ক্রূর হিংস্র সাপিনীর মতো সে অন্ধকারের মধ্যে মিশিয়া শনশন করিয়া চলিয়াছিল। পিছনে আসিয়া টিনটা নামাইয়া সে হাঁপাইতে আরম্ভ করিল।
চুপ করিয়া বসিয়া সে খানিকটা বিশ্রাম করিয়া লইল। বসিয়া থাকিতে থাকিতে তাঁবুর ভিতরটা একবার দেখিয়া লইবার জন্য সে কানাতটা সন্তর্পণে ঠেলিয়া বুক পাড়িয়া মাথাটা গলাইয়া দিল। সমস্ত তাঁবুটা অন্ধকার! সরীসৃপের মতো বুকে হাঁটিয়া বেদেনী ভিতরে ঢুকিয়া পড়িল। খোঁপার ভিতর হইতে দেশলাইটা বাহির করিয়া ফস করিয়া একটা কাঠি জ্বালিয়া ফেলিল।
তাহার কাছেই এই যে কিষ্টো অসুরের মতো পড়িয়া অঘোরে ঘুমাইতেছে। রাধিকার হাতের কাঠিটা জ্বলিতেই লাগিল, কিষ্টোর কঠিন সুশ্রী মুখে কী সাহস! উঃ, বুকখানা কী চওড়া, হাতের পেশিগুলো কী নিটোল! তাহার আশপাশে ঘোড়ার খুরের দাগ-ছুটন্ত ঘোড়ার পিঠে কিষ্টো নাচিয়া ফেরে! ঐ যে কাঁধে সদ্য ক্ষতচিহ্নটা ঐ দুর্দান্ত সবল বাঘটার নখের চিহ্ন! দেশলাইটা নিভিয়া গেল।
রাধিকার বুকের মধ্যটা তোলপাড় করিয়া উঠিল, যেমন করিয়াছিল শম্ভুকে প্রথম দিন দেখিয়া। না, আজিকার আলোড়ন তাহার চেয়েও প্রবল। উন্মত্ত বেদেনী মুহূর্তে যাহা করিয়া বসিল, তাহা স্বপ্নের অতীত, সে উন্মত্ত আবেগে কিষ্টোর সবল বুকের উপর ঝাঁপ দিয়া পড়িল। কিষ্টো জাগিয়া উঠিল, কিন্তু চমকাইল না, ক্ষীণ নারী তনুখানি সবল আলিঙ্গনে আবদ্ধ করিয়া বলিল, কে? রাধি_
তাহার মুখ চাপিয়া ধরিয়া রাধিকা বলিল, হ্যাঁ, চুপ।
কিষ্টো চুমায় তাহার মুখ ভরিয়া দিয়া বলিল, দাঁড়াও, মদ আনি।
না। চল উঠ, এখুনই ইখান থেক্যে পালাই চল। রাধিকা অন্ধকারের মধ্যে হাঁপাইতেছিল।
কিষ্টো বলিল, কুথা?
হু-ই, দেশান্তরে।
দেশান্তরে? ই তাঁবুটাবু_
থাক পড়্যা। উ ঐ শম্ভু লিবে। তুমি উয়ার রাধিকে লিবা, উয়াকে দাম দিবা না? সে নিম্নস্বরে খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল।
উন্মত্ত বেদিয়া_তাহার উপর দুরন্ত যৌবন-কিষ্টো দ্বিধা করিল না, বলিল, চল।
চলিতে গিয়া রাধিকা থামিল, বলিল, দাঁড়াও।
সে কেরাসিনের টিনটা শম্ভুর তাঁবুর উপর ঢালিয়া দিয়া মাঠের ঘাসের উপর ছড়া দিয়া চলিতে চলিতে বলিল, চল।
টিনটা শেষ হইতেই সে দেশলাই জ্বালিয়া কেরাসিনসিক্ত ঘাসে আগুন ধরাইয়া দিল। খিলখিল করিয়া হাসিয়া বলিল_মরুক বুড়া পুড়্যা।
  প্রথম হাসিফরিদুর রেজা সাগর 
অঙ্কন : নাজমুল আলম মাসুম
¦

প্রথম হাসি
প্রথম হাসিফরিদুর রেজা সাগর
আরিফ ভাই বয়সে সবচেয়ে বড় বলে এই মুহূর্তে তাকে কমান্ডার বলে মানতে হচ্ছে। কিন্তু আমরা মেনেছি বলে তিনি সত্যি সত্যি নিজেকে পুরো কমান্ডার বলে ভেবে বসবেন এটা বুঝতে পারিনি। গত তিন মাসে আমাদের কমান্ডার আমাকে এতটা বকেননি যতটা আরিফ ভাই গত দুই ঘণ্টায় আমাকে বকেছেন। এমনি আরিফ ভাই খুবই ধীরস্থির মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যে অনার্স পড়তেন স্কাউট হিসেবে পুরো পাকিস্তানের জানুয়ারিতে শ্রেষ্ঠ স্কাউট হিসেবে পুরস্কার পেয়েছেন পরপর দুই বছর। মুক্তিযুদ্ধ শুরু না হলে এই বছরই পেতেন বিশ্ববিদ্যালয়ে 'ব্লু'র সম্মান।
তবে আরিফ ভাইয়ের দিকে তাকালে এই মুহূর্তে তার পরিচয়টা কারো কাছেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে না। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। গায়ে হাফশার্ট। পরনে লুঙ্গি। এই একই পোশাক অবশ্য আমাদের বাকি সবার। আরিফ ভাই ছাড়াও আমাদের সঙ্গে রয়েছেন স্বপন আর তপন। যমজ দুই ভাই। কে যে স্বপন আর কে যে তপন প্রায়ই ভুল করে বলি। একটা ব্যাপারেই শুধু বোঝা যায়, একজন মাঝে মাঝে নিজের আঙুল দাঁত দিয়ে কামড়াতে থাকে। আরেকজন খামাখাই মাঝে মধ্যে নিজের মাথা চুলকায়। অবশ্য স্বপন মাঝে মাঝে সব কথার মাঝখানে বলে বসে আজব। স্বপন আর তপন বয়সে আমার চেয়ে একটু বড় হলেও ওদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক হয়ে গেছে বন্ধুর মতো। ফলে ওদেরকে আমি 'তুমি' করেই বলি।
আরিফ ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
এখনো সময় আছে_তুমি সিদ্ধান্ত পাল্টাও।
আমি মুখ গম্ভীর করে হাঁটতে থাকি। আরিফ ভাই অসহায়ের মতো স্বপন আর তপনের দিকে তাকিয়ে বলে,
ওকে বোঝাও। নিজেও মরবে। আমাদেরকেও মারবে। আর যাকে বাঁচানোর জন্য চেষ্টা করছে সে তো না খেয়েই মারা যাবে।
খাবার সময় আমি কাছাকাছি একটা টম্যাটোর ক্ষেত দেখেছিলাম। টম্যাটোর ক্ষেত? এই সময় তোর টম্যাটো খাওয়ার শখ হলো।
আরিফ তাই মাঝে মাঝে রেগে গেলে আপনি-তুমি সব ব্যবহার করে। আমি বললাম, আমার নয়। তবে আমি শুনেছি টম্যাটোর রস খাওয়ানো যেতে পারে।
ওফ্...। এখনো খাওয়ানোর কথা ভাবছ তুমি। নিজেদের খাওয়া আসবে কোথা থেকে_কেমন করে ক্যাম্পে গিয়ে পেঁৗছাব সেটার ব্যাপারে কিছু ভেবেছ?
সত্যি কি আমরা ক্যাম্পে কোনো দিন পেঁৗছাতে পারব না?
কেমন করে পেঁৗছাবে? যুদ্ধের একটা নিয়ম আছে। সেই নিয়ম না মানলে যুদ্ধে হারতেই হবে।
আমরা তো সব নিয়ম মানার চেষ্টা করেছি।
হ্যাঁ, নিয়ম মেনে রেকি করতে বেরিয়েছিলে। কিন্তু তারপর তোমরা আর কেউ নিয়ম মাননি? এখন ক্যাম্পে পেঁৗছাতে না পেরে দুঃখ করে লাভ আছে?
স্বপন আর তপন আমার দিকে তাকায়। ওরাও কি আরিফ ভাইয়ের মতো সব দোষ আমাকে দিতে চায়? আজ ভোরবেলা নদীর ওপরের ক্যাম্প থেকে আমরা শিমুলিয়া গ্রামে এসেছিলাম রেকি করতে। এই গ্রামে কয়েক দিন আগে পাকিস্তানি সৈন্যরা পুরো সব বাড়িতেই আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। শিমুলিয়া গ্রামটা খুব বড় নয়। চলি্লশ থেকে পঞ্চাশটা ঘর। এই গ্রামের মধ্য দিয়ে আসলে যাওয়া যায় গঞ্জে।
নদীর পাশ দিয়ে একটা খাল রয়েছে। সেই খালের ওপর একটা বাঁশের সাঁকো আছে। এই সাঁকোটাই আসলে আমাদের ক্যাম্প আর গ্রামের মধ্যে যোগসূত্র।
ক্যাম্প থেকে বের হওয়ার সময় বারবার ক্যাম্প কমান্ডার বলে দিয়েছে এই সাঁকোটার মাঝখানে বিস্ফোরক বসানো হয়েছে। ঠিক দুপুর একটায় মুক্তিযোদ্ধারা এই বিস্ফোরকে বিস্ফোরণ ঘটাবে।
আমরা যদি সেই সময়ের মধ্যে ফিরতে না পারি।
তপনের কথা শুনে ক্যাম্প কমান্ডার বললেন,
এরকম কথা চিন্তাও করবেন না। কারণ ওই সময়ের মধ্যে ফিরতে না পারলে সত্যি সত্যি ভয়ঙ্কর ব্যাপার ঘটবে।
ব্যাপারটা আমরাও বুঝতে পারছি। বিস্ফোরণের শব্দ শুনে নিশ্চয়ই পাকিস্তান সেনাবাহিনী আশপাশ থেকে বেরিয়ে এসে সাঁকোর সামনে পাহারা বসাবে। কাকপক্ষী কেউ ওপারে যেতে দেবে না।
আমি কথাগুলো ভাবতে ভাবতে দল থেকে একটু পিছিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু সামনের দিকে তাকিয়ে দেখি, আরিফ ভাই আমার পেছন ফিরে আমার দিকে এগিয়ে আসছেন।
আর কোনো উপায় নেই। আমরা একেবারে শত্রুর হাতে আটকে গেছি।
স্বপন সঙ্গে যোগ করে বলল,
সাঁকোর চারপাশে শুধু পাকিস্তানি সৈন্য।
আমরা যদি পেছনে শিমুলিয়া গ্রামে ফিরে যাই।
আমার কথা শুনে আরিফ ভাই বললেন,
উল্টাপাল্টা কথা বলিস না। শুধু কি সাঁকোর পাশে? এখন চারদিকে ছড়িয়ে আছে পাকিস্তানি সৈন্যরা।
তাছাড়া আমরা যে শিমুলিয়া গ্রামে গিয়েছিলাম সেই খবরও এতক্ষণে তাদের কাছে পেঁৗছে গেছে।
শিমুলিয়া গ্রামে আজ যখন আমরা পেঁৗছেছিলাম তখন আমরা কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। ছোট্ট গ্রাম। কিন্তু একজন মানুষেরও দেখা পেলাম না। দেখা পাওয়ার সম্ভাবনাও ছিল না। দুদিন আগে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পুরো গ্রামটাই জ্বালিয়ে দিয়েছে। শুধু জ্বালিয়ে দেওয়া নয়, যত পুরুষ মানুষ ছিল তাদের সবাইকে পুকুর পারে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মেরেছে। আর গ্রামের মহিলা ও শিশুরা পালিয়ে গেছে কিংবা আগুনে পুড়েছে। এখনো বাতাসে ছড়িয়ে আছে আগুনের পোড়া গন্ধ।
এরই মধ্যে হঠাৎ করে বাচ্চার কান্নার শব্দ। এই প্রেতপুরীতে বাচ্চার কান্নার শব্দ এলো কোথা থেকে? শব্দ লক্ষ্য করে এগিয়ে যাই। সামনে খোলা উঠোন। চারপাশের ঘরগুলো সব আগুনে পোড়া। কিন্তু কী আশ্চর্য, উঠোনের মধ্যে একটা ছোট্ট শিশু শুয়ে শুয়ে কেঁদেই চলেছে। পাশে একটা কালো রঙের ছাগল। ড্যাবডেবে চোখে তাকিয়ে আছে। আমি শিশুটার দিকে এগিয়ে যেতে চাই। আরিফ ভাই আমার কাঁদে হাত দিয়ে ইশারায় বলে,
ওদিকে নয়। সামনে চলো।
এই শিশুটিকে ফেলে চলে যাব?
তাছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই।
কেন?
এটা যুদ্ধক্ষেত্র। এখানে কেউ কারো জন্য অপেক্ষা করে না। কেউ কারো জন্য ভালোবাসা, মায়া কিছু দেখায় না।
তাই বলে একটা অবুঝ শিশু_
আমার গলা ধরে আসে। চোখ দিয়ে আগেই পানি পড়ছিল।
আরিফ ভাই সেই চোখের পানি মুছে দিয়ে বললেন,
অবুঝ শিশু বলেই ওকে ফেলে যেতে হবে। ওকে আমাদের সঙ্গে নেওয়া মানেই আরেকটা বোঝা।
একটা শিশুকে তুমি বোঝা বলছ? যেখানে সারা দেশের মানুষের জন্য আমরা যুদ্ধ করছি_
সারা দেশের মানুষ আর একটা শিশুর মধ্যে অনেক পার্থক্য।
স্বপন-তপনও এই সময় এগিয়ে আসে সামনে। স্বপন বলে,
শিশুটিকে সঙ্গে নিয়ে গেলে খাওয়াব কী?
না, জানি না। কিন্তু এই রকম একটি শিশুকে একলা ফেলে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
পাগলামি করো না।
ততক্ষণে আমি সামনে এগিয়ে গিয়ে শিশুটিকে কোলে তুলে নিয়েছি। আর কী আশ্চর্য! কোলে তোলার সঙ্গে সঙ্গে শিশুটি একেবারে চুপ। আমার হাবভাব দেখে বাকি সবাইও চুপ।
সামনের দিকে পথ চলতে চলতে তপন বলল,
এত দেরি হচ্ছে কেন সাঁকোটা আসতে?
ঠিক সেই সময় বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শব্দ শুনতে পেলাম। শিশুটি ছোট ছোট হাত দিয়ে আমাকে আরো বেশি করে জড়িয়ে ধরে। আর আরিফ ভাই অসহায়ের মতো মাটিতে বসে পড়লেন। সাঁকোটা আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা উড়িয়ে দিল।
এরপর কী ঘটবে তা আমাদের জানা। পাকিস্তানি সৈন্যরা আশপাশ থেকে ছুটে যাবে খালের পারে। পাকিস্তানি সৈন্যদের রাইফেলের গুলির শব্দ শোনা গেল।
এই শিশুটিকে সঙ্গে না নিলে এতক্ষণে হয়তো আমরা সাঁকোটা পার হয়ে যেতাম।
খামাখা শিশুকে দোষ দিও না। গ্রামটা রেকি করতেই যথেষ্ট দেরি হয়ে গিয়েছিল।
সেটাও সত্যি। কিন্তু এখন কী হবে?
আরিফ ভাইয়ের মতো আমি নিজেও আসলে চিন্তিত। একটু পর সন্ধ্যা হয়ে যাবে। তার আগে যে করেই হোক আমাদের ক্যাম্পে গিয়ে পেঁৗছানো উচিত। সাঁকোটার খুব কাছাকাছি আমরা রয়েছি। সেটা বুঝতে পেরেছি। কিন্তু ভেঙে পড়া সাঁকোটার সামনে থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা না সরলে ওপরে ক্যাম্পে যাওয়া সম্ভব না। যে জায়গাটায় আমরা দাঁড়িয়ে এসব কথা ভাবছিলাম সেটা একটা খোলা জায়গা। হঠাৎ করেই আমাদের চোখের সামনে এই সময় একজন লোক এসে দাঁড়ায়। লোকটিও ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে। আমাদের অবস্থাও তাই। লোকটির থুতনিতে এক মুঠ দাড়ি। পরনে ঢোলা পাজামা-পাঞ্জাবি। গলায় একটা কাগজে উর্দুতে কিছু লেখা। সেটা বুঝতে পারলাম না। কিন্তু নিচে ছোট করে বাংলায় লেখা আমি বীর বদর। সেকেন্ডের মধ্যে আমরা বুঝে গেলাম, লোকটা বদর বাহিনীর একজন সদস্য। পাকিস্তানি দালাল। আর লোকটিরও বুঝতে বাকি রইল না আমরা কারা? অল্প কয়েক সেকেন্ডের ঘটনা। লোকটি মুক্তি মুক্তি বলে চিৎকার করে সাঁকোর দিকে এগিয়ে যায়। তপন ওর পিঠে রাখা রাইফেলটা ততক্ষণে হাতে নিয়েছে। আরিফ ভাই রাইফেলটা প্রায় কেড়ে নিয়ে বললেন,
এখন গুলি করলে পাকিস্তানি সৈন্যরা এদিকে ছুটে আসবে। বাঁচার কোনো উপায় থাকবে না। ততক্ষণে বদর বাহিনীর সদস্য চোখের আড়ালে চলে গেছে। আরিফ তাই বললেন, এখানে নিরাপদ কোনো জায়গায় আশ্রয় নেওয়া প্রয়োজন।
চারপাশে তাকিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের মতো কোনো জায়গা চোখে পড়ল না। বড় কোনো গাছ নেই। ফসলের ক্ষেত নেই। তারপরও যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম তার পাশের জমিটা একটু নিচু। সেখানে মাথা নামিয়ে একটু আড়াল হয়ে হয়তো থাকা যেতে পারে। আরিফ ভাই সেইভাবেই আমাদের থাকার নির্দেশ দিলেন। শিশুটা কোনো শব্দই করছে না। আমি জানি, বাকি তিনজনের মনেই প্রশ্ন, শিশুটা আদৌ বেঁচে আছে কি না? কিন্তু শিশুর হাতের আঙুলগুলোর নড়াচড়া আমি টের পাচ্ছি। তবে আশ্চর্য হয়ে আমি ভাবছি, শিশুটি এতক্ষণে একবারও কাঁদেনি। দুধ তো পাওয়া যাবে না। রাত হলে টম্যাটোর রস না পাওয়া গেলেও কোনো না কোনো গাছের পাতার রস খাইয়ে শিশুটিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। ফিসফিস করে কথাটা বললাম। আর আরিফ ভাই বেশ জোরেই বললেন, শিশুটিকে নয়। নিজেদের বাঁচার কথা ভাব। স্বপন-তপন রাইফেল হাতে নাও।
একটু আগে আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেখানে আটজন পাকিস্তানি সৈন্য দাঁড়িয়ে। সবার হাতে রাইফেল। সঙ্গে সেই পাকিস্তানি দালাল। উর্দু, বাংলা আর ইংরেজি মিলিয়ে বলছে,
স্যার বিশ্বাস করেন এইখানে চারটা মুক্তি ছিল।
এই খোলা জায়গায় মুক্তি আসবে কোথা থেকে? তুমি নিশ্চয়ই মিথ্যা কথা বলে আমাদের নিয়ে এসেছ।
স্যার বিশ্বাস করেন_ক্যাপ্টেন সাহেব, এই যে এইখানটায় উনারা দাঁড়িয়ে ছিলেন।
তাহলে এখান থেকে গেল কোথায়?
পাকিস্তানি সৈন্যরা চারদিকে তাকায়। কিন্তু ততক্ষণে আমার দৃষ্টি আটকে গেছে অন্য জায়গায়। শিশুটিকে আমি এই জায়গায় আলাদা হওয়ার সময় লুঙ্গিটা খুলে ভাঁজ করে দোলনার মতো বানিয়ে আমার হাতের সঙ্গে আটকে নিয়েছিলাম। দরকার হলে যাতে আমি স্বপন-তপনের সঙ্গে রাইফেল ব্যবহার করতে পারি। রাইফেলের কথা ভাবতে গিয়ে শিশুটার কথা বোধ হয় কয়েক সেকেন্ডের জন্য ভুলে গিয়েছিলাম। লুঙ্গি দিয়ে বানানোর দোলনার ওজন যে কমে গেছে সেটা বুঝতে পারিনি। আমার অন্যমনস্কতার সুযোগে শিশুটি হামাগুড়ি দিয়ে অনেকটা সামনে এগিয়ে গেছে। ছয় মাসের শিশুর এটাই বোধ হয় প্রথম হামাগুড়ি। আমি মাথা উঁচু করে শিশুটার দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই তপন আর স্বপন দুদিক থেকে হাত চেপে ধরে। ওদিকে শিশুটি তখন হামাগুড়ি দিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করছে। পাকিস্তানি সৈন্যরা তখনও শিশুটিকে দেখতে পায়নি। মনে মনে প্রার্থনা করছি শিশুটি যেন কোনো শব্দ না করে। কিন্তু শিশুটি শব্দ নয়_প্রচণ্ড জোরে কেঁদে ওঠে। পাকিস্তানি সৈন্যরা শুধু যে ঘুরে শিশুটিকে দেখল তাই নয় রাইফেলের নলগুলো সরাসরি তাক করল শিশুটির দিকে। শিশুটির কিন্তু রাইফেলের নলের দিকে দৃষ্টি নেই। হামাগুড়ি থেকে উঠে শুধু কেঁদেই চলেছে। পাকিস্তানি সৈন্যদের দলনেতা, দালালটি যাকে ক্যাপ্টেন বলছিল সে রাইফেল নিয়ে এসে দাঁড়ায় শিশুর সামনে। তারপরই প্রচণ্ড অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। ক্যাপ্টেনের দেখাদেখি বাকি সৈন্যরাও হাসতে থাকে। ক্যাপ্টেন হাসি থামিয়ে বলে ওঠে_
শুয়োরের বাচ্চা বাঙালি আমাদের বোকা বানিয়েছিস। এখানে মুক্তি আসবে কোথা থেকে? কাল যে গ্রামে আগুন জ্বালিয়েছি সেই গ্রামের একটা বাচ্চা হামাগুড়ি দিয়ে এত দূর এসেছে। না খেতে পেয়ে একটু পরই মারা যাবে। মুক্তিবাহিনী থাকলে এটাকে চিলের মতো ছোঁ মেরে নিয়ে যেত।
পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে ঠাট্টা!
মুহূর্তের মধ্যে ক্যাপ্টেনের হাতের রাইফেলের নলটা ঘুরে যায় 'আমি বীর বদর বাহিনী' লেখার দিকে। একসঙ্গে গর্জে ওঠে ৮টা রাইফেল।
শালা, আমাদের ঠকানোর চেষ্টা করে?
পাকিস্তানি আটজন সৈন্য একসঙ্গে ফিরে যায় গ্রামের দিকে। যাওয়ার আগে ক্যাপ্টেন বলে, যে মুক্তিরা সাঁকো উড়িয়েছে তারা অনেক দূর চলে গেছে। পাকিস্তানি সৈন্যরা দৃষ্টির বাইরে চলে যেতেই দৌড়ে ছুটে এসে আমি শিশুটিকে কোলে তুলে নিই।
রাইফেলের শব্দ শুনেই শিশুটির কান্না থেমে গিয়েছিল। পাকিস্তানি সৈন্য দেখে শিশুটা জীবনে প্রথম হামাগুড়ি দিয়েছিল। দালাল দেখে কেঁদেছিল। আর গুলির শব্দ শুনে বোধ হয় প্রথম হাসিটা শিশুর মুখে এসেছিল। সেই হাসিটা এখনো শিশুর মুখে রয়ে গেছে। আর হাসিটা দাঁড়িয়ে গেছে তপন, স্বপন আর আরিফ ভাইয়ের মুখেও। কারণ ভাঙা সাঁকোর কাছ থেকে পাকিস্তানি সৈন্য সরে যাওয়া মানে আমাদের ক্যাম্পে যাওয়ার পথ খুলে গেছে।



জিব্রাইলের ডানাশাহেদ আলী
অঙ্কন : মাহবুবুল হক
¦

জিব্রাইলের ডানা
জিব্রাইলের ডানাশাহেদ আলী
আজিমপুর হয়ে যে রাস্তাটি সোজা পিলখানা রোডের দিকে চলে গেছে, তারই বাঁ-পাশে, গাছপালার ভেতর এগিয়ে গিয়ে একখানি ছোট্ট কুটির। ঘরের মেটে দেয়ালগুলোর উপরিভাগ গলে গেছে অনেক দিন_রোদ-বৃষ্টি আর হাওয়ার অবারিত যাতায়াত এই ঘরের মধ্যে। মরচে-ধরা বহু পুরনো টিনের সুরাখ দিয়ে দেখা যায় নীল আসমানের ছিটেফোঁটা।
মা ও ছেলে শুয়ে আছে চাটাই বিছিয়ে।
সন্ধেবেলা হালিমা খুবই মেরেছিল নবীকে। আট বছর গিয়ে ন'বছরে পা দিয়েছে নবী। কাজ না শিখলে দিন গুজরানের উপায় থাকবে না। নবীকে দুধের বাচ্চা রেখেই বাপ তার ইন্তেকাল করেছে। একা হালিমা কী-ইবা করতে পারে তার জন্য?_নিজের পেট পালতেই সাতবাড়ি ঘুরতে হয় তার; কাজ না পেলে ভিক্ষে করতে হয় এবং সন্ধেবেলা গিয়ে বসতে হয় গোরস্তানের গেটের কাছে। কবর জেয়ারত করতে এসে অনেকেই দান-খয়রাত করে, তাদের কাছ থেকে দু-চার পয়সা হালিমার বরাতে জুটে যায় কখনো কখনো। নবী অবশ্যি বিনে মাইনেই বিড়ির দোকানে কাজ করে, দোকানি শুধু দুপুরবেলা একবার খেতে দেয় নবীকে। এখনো সে পাকা হয়ে ওঠেনি বিড়ি বাঁধায়। কাজ সম্পূর্ণ শেখা হয়ে গেলেই সে মাস মাস পাঁচ টাকা করে পাবে দোকানির কাছ থেকে।
কিন্তু নবী ফাঁকি দিতে শুরু করেছে আজকাল, কোনো অছিলায় দোকান থেকে বেরিয়েই সে যে কোথায় চলে যায় কেউ বলতে পারে না। সন্ধে পর্যন্ত আর দেখাই মেলে না তার। এ নিয়ে দোকানের মালিক তিন দিন নালিশ করেছে হালিমার কাছে_আজ তাকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে, সে কাজ ছাড়িয়ে দেবে নবীর_অমন দুষ্টু ছেলেকে দিয়ে দরকার নেই তার।
সারাটা বিকেল গোস্বায় আগুন হয়েছিল হালিমা_ছেলে যদি কোনো কাজ না শেখে, তার কি কোনো ভবিষ্যৎ আছে আজকের দুনিয়ায়? অথচ ছেলে এমনি মগড়া যে এদিকে মনই বসে না তার। মন বসবেই বা কেন? মা তো রয়েছে তার জন্য ভিক্ষা করতে_বাঁদিগিরি করতে! সন্ধেয় নবী বাড়ি ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই হালিমা ধুম ধুম করে কতকগুলো কিল বসিয়ে দেয় নবীর পিঠে। সারাদিন কাটায় কোথায় নবী?_জানতে পীড়াপীড়ি করেছিল হালিমা, কিন্তু নবীর কাছ থেকে জওয়াব পাওয়া কঠিন, সে শুধু ফুলে ফুলে কেঁদেছে। কাঁদতে কাঁদতে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ে নবী।
হালিমা খেতে বসেছিল, কিন্তু দু-এক লোকমা গিলেই সে উঠে পড়ে_তার পেটেও ভাত গেল না আজ! কত অনুনয়-বিনয় করেছে হালিমা, কিন্তু তাতে মন গলল না অভিমানী শিশুর, শুধু দু-একবার চোখ মেলে হালিমার দিকে তাকিয়েছিল। তারপর মুখ গম্ভীর করে সে নিজেকে সঁপে দেয় ঘুমের কোলে।
গলে যাওয়া দেয়ালের ওপর দিয়ে হালিমা তাকিয়ে আছে আসমানের দিকে। একটা হাত তার নবীর ওপর রাখা। নবীর পিঠে কঞ্চি ভেঙেও কোনোদিনই খুব ব্যথা পায় না হালিমা, কিন্তু আজ এই মুহূর্তে ঘুমিয়ে পড়া ছেলের ওপর হাত রেখেই তার মনটা হু হু করে ওঠে দুঃখে। সত্যি, এতটুকু ছেলে, কী-ইবা বোঝে? বাপ তো মরে গিয়ে রেহাই পেয়েছে চিরদিনর জন্য, বাপ-মার যুগল দায়িত্ব নিয়ে বেঁচে আছে হতভাগিনী হালিমা। এভাবে যখন-তখন ওকে মারপিট করা সত্যি অন্যায়। কিন্তু কাজ যদি কিছুই না শেখে, ও বাঁচবে কী করে সংসারে? হালিমা তো আর চিরদিন বেঁচে থাকবে না যে নিজের দিন-গুজরানের কথা নবীর না ভাবলেও চলবে।
হালিমার চোখ আঁসুতে ভরে আসে, আসমান থেকে নজর ফিরিয়ে নিয়ে সে চুমো খায় নবীর কপালে!
নবী আস্তে আস্তে চোখ মেলে চায়_আর হঠাৎ একবার দরজার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে ওঠে_মা, এইডা কে?
কই রে? বিস্মিত হালিমা প্রশ্ন করে।
উই যে গেল, ডান হাত বাড়িয়ে নবী দেখিয়ে দেয় অপরিচিতের যাওয়ার পথটি।
_কেউ না, নিঃসন্ধিগ্ধ উত্তর দেয় হালিমা।
_তুমি লুকাইবার চাও?_নবীর অভিমান যেন ফুলে ওঠে_খুব ছুন্দর একটা মানুছ গেছে না? রাঙা ধবধবা_আর পিন্দনে সুন্দর কাপড়?
_ছুন্দর মানুছ? হালিমার বিস্ময় এবার আরো বেড়ে যায়।
_ হ, চোখদুটো বড়ো বড়ো করে নবী বলে_মিঠাই লিয়া আইছিল_তোমার কাছে দিয়া গেছে না মা?
_হ, দিয়া গেছে, একটা করুণ হাসিতে প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে হালিমা; তারপর একটু শান্ত হয়ে বলে, নবী এখন তুই ঘুমা_বিহান বেলা খাবিনে মিঠাই।
লোকটা কোনখান থেকে আইছিল মা? নবী আবার প্রশ্ন করে_দুইটা পাখনা দেখছ পিঠে?
পাখনা?_হালিমার আক্কেল সত্যি হার মানে এবার। আধো-আলো আধো-অন্ধকারের মধ্যে দৃষ্টিতে তীক্ষ্নতর করে সে তাকায় নবীর মুখের দিকে, কিছুই ঠাহর করে উঠতে পারে না হালিমা।
নবী আবার বলে_হ, পাখনা।_মউরের পেখমের মতো ছুন্দর।
হালিমা আরো কাছে টেনে নেয় নবীকে, পিঠের ওপর হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে_ফিরিছতা আইছিল রে_ফিরিছতা। আজ ছবেবরাত না! ঘরে ঘরে আইয়া খোঁজ-খবর নিছে মানছের! ফিরিছতা গো আজ ছুটি।
ফেরেশতা এসেছিল! নবীর সারা গা রেমাঞ্চিত হয়ে ওঠে। এক দারুণ উত্তেজনায় সে উঠে পড়ে বিছানা ছেড়ে। রাতটা কী চমৎকার! রুপা-গলা জোছনায় ধুয়ে ঢল ঢল করছে সারা পৃথিবীর গা। সন্ধেয় ঘরে ফেরার সময় সে দেখেছে মসজিদে কোরআন-তেলাওয়াতরত ছেলেমেয়েদের। এখন রাত হয়েছে অনেক, তবু শাহ বাড়ির মসজিদ থেকে কোরআন তেলাওয়াতের শিরীন আওয়াজ ভেসে আসছে এখনো_গোরস্তান গমগম করছে মানুষে! আজ ঘুমিয়ে নেই কেউই, ফেরেশতার সঙ্গে, মৃতদের রূহের আজ মোলাকাত করবে সবাই, নিজেদের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা ফেরেশতা মারফত জানাবে আল্লাহর কাছে। শুধু নবী আর হালিমাই ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে নষ্ট করেছে এ সুযোগটা। তাদেরই দুয়ারের সুমুখ দিয়ে চলে গেছে আল্লাহর ফেরেশতা, অথচ তাদের চাওয়ার কথা_জীবন-পিপাসার কথা কিছুই জেনে যায়নি সে_কিছুই জানানো হলো না তাকে।
বাতি ধরিয়ে হালিমা পরীক্ষা করে ছেলের হাবভাব। একবার বলে_কিরে তোর খিদা লাগছে খুব? ভাত খাবি এখন? নবী কোনো জবাব দেয় না তার, খিদের কথা ভুলেই গেছে একদম। মন তার আচ্ছন্ন হয়ে আছে এক মধুর কঠিন ভাবনায়। ফেরেশতারা খবর নিয়ে যায় আল্লাহর কাছে। তাদের খবরও কি নিয়ে গেছে ফেরেশতা? সে কি গিয়ে বলবে না বরাতের রাতেও সে ঘুমে দেখে গেছে নবী আর হালিমাকে।
_ফিরিশতারে কিছু কইয়া দিছ মা? আবার জিজ্ঞাসু হয় নবী। কিছু বুঝতে না পেরে চুপ করে থাকে হালিমা।
_আরে পাগলা, হালিমা তার জ্বালা চেপে রাখতে পারে না।_ফিরিশতা আমাগো কতা ছুনবো ক্যান? বড়লোক গো খোঁজখবর করবার লাইগা আইছে! আমাগো দুয়ারের কাছ দে তাগো বাড়িই হে গেছে।
নবী চুপ করে থাকে অনেকক্ষণ, তারপর হঠাৎ প্রশ্ন করে_তুমি নামাজ পড়ো না ক্যান মা? অসহ্য মুরবি্বয়ানার সুর বেজে ওঠে তার প্রশ্নে।
_কী অইব নামাজ পইড়া? একটা পরম বিতৃষ্ণা প্রকাশ পায় হালিমার কণ্ঠে।
_কী, অইব কী? এতটুকু নবী জ্বলে ওঠে বিরক্তিতে, যারা নামাজ পড়ে তাগো বাড়িতেই না ফিরিছতারা আহে, আল্লাহ তো তাগো কতাই ছোনে।
_নারে না, হালিমা এক রকম চিৎকার করে ওঠে এবার, আল্লা তো ঘুমাইয়া রইছে কেঁতা গায় দিয়া। ছুনা-রুপা দিয়া ছেজদা করলেই হে চায়। গরিবের সোদা নামাজে হের মন ভেজে না।
আল্লাহর এই মহৎ গুণের কথা ভেবে একান্তভাবেই ঘাবড়ে যায় নবী। কাঙাল যারা, মিসকিন যারা, তাদের আর কোনো ভরসাই নেই তাহলে। এত সোনা-রুপাও তারা পাবে না, তাদের দিলের আরজুও গিয়ে পেঁৗছাবে না খোদার কাছে। আর তাই তো, গরিবদের যারা নামাজ পড়ে তাদের তো মালদার হতে দেখা যায় না; দুঃখ তাদের ঘুচছে কই?_সোনা-রুপার শিরীন আওয়াজেই তাহলে ঘুম ভাঙে খোদার! সে জন্যই বুঝি মালদাররা আরো মালদার হয়, এক গুণ দিয়ে পায় সত্তর গুণ।
কিন্তু খোদা তো পয়দা করেছেন সবাইকে। তিনি কেন তার রহমত একতরফা বিলিয়ে দেবেন মালদারদের মধ্যে? কোনোদিন কি ঘুমের ঘোরেও দরিদ্র বান্দার দুঃখে অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে না তার চোখ? সত্যি কি গরিবরা ঘুম ভাঙাতে পারে না তার?
হতাশার আঁধারে হাতড়ে ফিরতে থাকে নবীর মন। দুয়ারের সুমুখ দিয়ে চলে গেছে ফেরেশতা, দবদবে আগুনের মতো রং, ময়ূরের পেখমের মতো বিচিত্র বর্ণের দুটো ডানা তার পিঠে, আর গায়ে সে কী খোশবু! সাদা ধবধবে তাজি ঘোড়া কোমর নাচিয়ে চলছে ফেরেশতাকে নিয়ে। নবী জেগে থাকলে আজ শুয়ে পড়ত ফেরেশতার পথে, আর মিনতি করে বলে যেত তার রক্তের ঢেউ ওঠা অফুরন্ত দুঃখের কাহিনী। কথা না শুনলে সে ঝুলে পড়ত ডানা ধরে_ ফেরেশতার সঙ্গে সঙ্গে উড়ে উড়ে সেও চলে যেত একেবারে আল্লার কাছে। অমনি চোখ মেলে নবী চিৎকার করত গলা ফাটিয়ে, খামচিয়ে রক্তাক্ত করে ঘুম ভাঙাত আল্লার!
কিন্তু তা তো আর হলো না। অথচ সব কিছুরই চাবি রয়েছে খোদার হাতে। তার ঘুম ভাঙাতে না পারলে কে-ইবা আর খুলে দেবে ভাগ্যের মণিকোঠা?
বিছানায় গিয়ে আবার শুয়ে পড়ে নবী। রাজ্যের যত চিন্তা এসে জটলা পাকায় তার মনে। হালিমাও বাতি নিভিয়ে গা এলিয়ে দেয় নবীর কাছে। ছেলে দু চোখ মেলে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে, হালিমা তো দেখছে না, শুধু বুক দিয়ে অনুভব করছে নবীর বুকভরা অস্বস্তি। একবার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে হালিমা বলে, নবী, অনেক রাত অইছে_তুই ঘুমা।
নবী আসমানের দিকে চেয়ে থাকে চুপ করে, আর একটা পথের খোঁজে কল্পনা তার হয়রান হয়ে যায়। আকাশ ভরে, পৃথিবী ভরে এত জোছনা_তবু যেন কত অন্ধকার, চোখের সঙ্গে মনও হারিয়ে যায় সে অন্ধকারে।
হঠাৎ একবার বিজলি ঝিলিক দিয়ে যায় তার চোখে, অকূল দরিয়ায় যেন নারিকেলকুঞ্জ-ছাওয়া উপকূলের আভাস পেয়েছে নবী। খুশিতে-আবেগে রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে তার সারা দেহ। হয়েছে, আর ভাবতে হবে না! আরশের পায়ায় রশি লাগিয়ে টান দেবে সে। রশি তো হাতেই রয়েছে তার। এবার থেকে নির্বিকার ভাব ঘুচে যাবে খোদার।
পরদিন। আগের দিনকার পানিভাত দুটো খেয়ে দোকানে কাজ করতে যায় নবী_যাওয়ার ইচ্ছে তার মোটেই ছিল না, হালিমাই তাকে পাঠিয়েছে অনেক শাসিয়ে। হালিমা বলে নিজের হাতে আজ গড়তে হবে কপাল, আল্লার কাছে আরজি পেশ করলেই চলবে না।
কয়েকটা ছেলের সঙ্গে নবী বিড়ি বাঁধছে; কিন্তু তার মন পড়ে আছে পিলখানার ওপাশে ফণিমনসায় ঘেরা নির্জন জায়গাটুকুতে। দোকান পালিয়ে লোকচক্ষুর আড়ালে ওইখানে সে রোজই ঘুড়ি ওড়ায় আপন মনে। এ খবর সে ছাড়া আর কেউ জানে না সংসারে। পৃথিবীকে লুকিয়ে শিশু তার কচি হাতদুটো বাড়িয়ে দেয় আসমানের দিকে। কিন্তু হাত আর কদ্দূরই বা ওঠে? নবীকে তাই নিতে হয়েছে ঘুড়ি_ঘুড়ি উড়িয়ে সে তার বাণী এত দিনে অজান্তে ওপর হতে আরো ওপরে আরশের দিকেই পাঠিয়েছে।
পেট ব্যথার অজুহাত তুলে নবী বেরিয়ে পড়ে দোকান থেকে। মুহূর্তের জন্যও সে স্থির হতে পারছে না আজ। অতি সন্তর্পণে বাড়ি পেঁৗছে নবী। মা বাড়ি নেই। আনন্দের সীমা থাকে না নবীর! তিনটা পাতিল তছনছ করে সে বার করে দু-আনা পয়সা_ওহ! দুই আনার পয়সা তো নয়, সাত রাজার ধন! পয়সাগুলো বার করে মুঠোয় পুরে নবী ছুটে যায় নবাবগঞ্জে। সুতো কিনে আবার সে দৌড়াতে শুরু করে দেয়। এক নতুন অভিযানের নেশায় বুক তার কাঁপছে। জঙ্গলের ভেতরকার এক পরিত্যক্ত ভাঙা মসজিদের অন্ধকার গুহা থেকে বের করে একটা ঘুড়ি আর লাটাই। এই ঘুড়ি তাকে রোজ বের করে আনে কাজ ভুলিয়ে, এই ঘুড়িই তাকে পৃথিবীর সীমানা ছাড়িয়ে আসমানের পথে নিয়ে যায়। আর সব ব্যাপারেই খই ফোটে নবীর মুখে, কিন্তু এই ঘুড়ির কথা কারো কাছে সে বলে না। এ যেন তার নেহাত পুশিদা খেলা, একান্তভাবেই নিজস্ব।
একসময় নবী চলে যায় পিলখানার ওপাশে সেই ফণিমনসায় ঘেরা নির্জন জায়গাটুকুতে। পুরনো সুতোটার সঙ্গে নতুন সুতোটা গেরো দিয়ে সে ঘুড়ি উড়িয়ে দেয় আসমানে। ঘুড়ি যতই ওপরে উঠতে থাকে উল্লাস-অধীরতায় ততই বিচলিত হয়ে ওঠে নবী, একটা স্মিতহাস্য তার মুখ থেকে চোখ পর্যন্ত ঝিলিক দিয়ে ওঠে বারবার। আরশের পায়ে রশি লাগিয়ে আজ সজোরে টান দেবে নবী।
ক্রমইে ছোট হয়ে আসে ঘুড়িটা। একসময় যখন হাতের সুতো শেষ হয়ে গেল, নবীর দুঃখের সীমা থাকে না। সুতো শেষ হয়ে গেছে কিন্তু ঘুড়ি যে দেখা যাচ্ছে এখনো। খোদা কি এত কাছে? তা তো নয়, মানুষের দৃষ্টিসীমার বাইরে অনেক-অনেক দূরে আরশের ওপর ঘুমিয়ে আছেন তিনি। এত কাছে হলে তো খালি চোখেই দেখা যেত আল্লাকে। সুতো চাই তার আরো, অনেক সুতো_যেন তার ঘুড়িকে নিয়ে যায় মেঘের ওপারে, আরশের একেবারে কাছটিতে। কিন্তু এখানেও দরকার পয়সার। সে যে সুতো কিনবে সে পয়সাই বা কই নবীর? তাদের দুর্দশা তাহলে আর ঘুচবে না। নবী আসমানের দিকে চেয়ে নিজের ব্যর্থতায় আর্তনাদ করে ওঠে। ঘুড়ি ওড়ানো যতদিন একটা শখ ছিল, নেশা ছিল, ততদিন শুধু ঘুড়ি উড়িয়েই আনন্দ পেয়েছে। কিন্তু আজ যখন এই ঘুড়ি একটি গভীর অর্থ নিয়ে তার কাছে ধরা দিয়েছে সহস্র বেদনার সম্ভাবনার পথও অবারিত হয়ে গেছে তার জন্য।
কিছুক্ষণ ঘুড়ি উড়িয়েই বাড়ি চলে আসে নবী। এই সুতোয় হবে না, আরো আরো অনেক সুতো চাই। বামনের হাত বাড়িয়ে আরশের পায়া ধরা অসম্ভব। পরম যত্নে সে ঘুড়িটা লুকিয়ে রাখে ভাঙা মসজিদের অন্ধকারে।
বেলা চলে যাচ্ছে, ঘরেও পয়সা নেই। মার কাছে পয়সা চাইতে গেলে হালিমা কঞ্চি দিয়ে তার পিঠের ছাল না তুলে ছাড়বে না। যে দুই আনা পয়সা আজ সে চুরি করেছে, তার জন্যই তার বরাতে কী আছে, কে জানে? তবুও লোভ সামলাতে পারে না নবী। আজলের লেখা পাল্টাতে হলে কিছু খরচ-কিছু ক্ষতি স্বীকার করতে হবে বৈ কি। মার অবর্তমানে নবী উল্টেপাল্টে দেখে ঘরের সব কটা হাঁড়ি-পাতিল, ছেঁড়া কাপড়ের বোচকাগুলো খোঁজে তন্ন তন্ন করে। একটা পয়সা নেই কোথাও। পয়সা থাকবেই বা কী করে? ভিক্ষা করে, পরের বাড়িতে কাজ করে যা দু-চার পয়সা পায় তাতে করে মা-ছেলের আধপেটা খাবারই হয় না কোনোদিন, তারা আবার জমাবে পয়সা!
হঠাৎ নবীর মনে পড়ে, ইস্টিশনে গেলে দু-চার পয়সা পাওয়া যেতে পারে। তার বয়সের ছেলেদের সে কুলিগিরি করতে দেখেছে অনেকদিন। নবী আর ভাবতে পারে না, একপেট খিদে নিয়েই সে ছুটে যায় ইস্টিশনের দিকে। অনেকক্ষণ বসে থাকতে হয় তাকে! তারপর গাড়ি যখন এলো, তাজ্জব বনে যায় নবী_কত বিচিত্র রকমের মানুষ, আর কত রংবেরঙের পোশাক। বাক্স-বিছানা, পেটরা প্রভৃতিতে স্তূপীকৃত হয়ে ওঠে লাইনের কাছটুকু।
'মুটে চাই'_চিৎকারে হারিয়ে যায় আর সব আওয়াজ।
সবার বরাতেই একটা-না-একটা কিছু জুটে যায়; কিন্তু নবীর কপাল বড় খারাপ, 'মুটে চাই' বলে চিৎকার করতে গিয়ে আওয়াজ এলো না তার গলায়_হাত দুটো চাওয়ার ভঙ্গিতে ওপর দিয়ে উঁচিয়ে সে ছুটে যায় এক কামরার সুমুখ থেকে আরেক কামরার সুমুখে_চোখ তার করুণ আঁসুতে টলমল। ভিক্ষুক মনে করে কেউ কেউ তাকে নসিহত করল শ্রমের মর্যাদা সম্বন্ধে, আর অতি আধুনিক কেউ কেউ দিল গলাধাক্কা। কারো কাছ থেকেই নবী কিছু পেল না।
ট্রেন চলে গেছ। ইস্টিশনে বসে বসে নিজের বদনসিবের জন্য বেদনায় ভরে আসে নবীর মন। দুঃখটা এবার আরো বড় হয়ে দেখা দেয় নবীর কাছে। মায়ে-বেটায় কোনোদিন একবেলা পেট ভরে খেতে পায় না তারা। কোনোদিন একেবারে উপোস করতে হয় তাদের। বছরে একবার করেও যদি কাপড় কিনতে পারত তারা! সেই তার বাপ ছেঁড়া শততালি দিয়ে যে কাপড়গুলো রেখে গিয়েছিল, সেগুলোই আরো তালি দিয়ে এবং গেরোর ওপর গেরো দিয়ে পরছে তারা দুজনে। ঘরের মেটে দেয়াল তো প্রায় সবটাই গলে গেছে, বৃষ্টি হলেই টিনের সুরাখ দিয়ে 'উসলিয়া' পড়ে পড়ে ঘর ভেসে যায় পানিতে। দুর্দশার আর সীমা-পরিসীমা নেই তাদের। আল্লার কাছে তাদের দিলের আরজ পেঁৗছাতে পারলেই অবসান ঘটত দুঃখ-রাত্রির। কিন্তু হালিমা নামাজ পড়ে না, নবীও আরবি সুরা এবং রাকাতগুলো শেখার সুযোগ পায়নি কখনো। আল্লা কেন-ইবা শুনবেন তাদের কথা।
ঘণ্টাখানেক পরে আর একটা ট্রেন যখন এলো, নবীর আনন্দ দেখে কে! ট্রেন থামার আগেই 'মুটে চাই'-'কুলি চাই' বলে সে চিৎকার শুরু করে দেয় প্রাণপণে। ট্রেন থামলে একটা ঘড়ি পরা বলিষ্ঠ হাতের ইশারায় নবী এসে দাঁড়ায় এক প্রথম শ্রেণীর কামরার সুমুখে। ভদ্রলোক একটা অ্যাটাচি ও হোল্ডঅল দেখিয়ে দিয়ে বললেন_ওয়েটিং রুমে নিতে পারবি?
_ক্যান্ পারুম না? তাচ্ছিল্যের সঙ্গে জবাব দেয় নবী, দেন আমার ঘাড়ে তুইলা।
_কত নিবি? ভদ্রলোকের ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে।
_আমার বহুত পইছার দরকার, চোখ দুটো বড় বড় করে উচ্চারণ করে নবী_আপনে কত দিতে পারবেন?
ভদ্রলোক এবার দৃষ্টি প্রখরতর করে নবীর মুখের দিকে তাকান; অদ্ভুত ছেলে তো! বলেন_এত পয়সা দিয়ে কী করবি?
_বারে, পইছার বুঝি কাজ নাই। নবী রীতিমতো বিস্ময় প্রকাশ করে, ঘুড়ির রছি কিনুম যে_অনেক রছি।
ভদ্রলোক এবার সত্যিই হেসে ফেলেন এবং হোল্ডঅলটা নবীর মাথায় দিয়ে অ্যাটাচিটা হাতে করে নেমে পড়েন গাড়ি থেকে; ওয়েটিং রুমে এসে চার পয়সার জায়গায় চার আনা দিয়ে বলেন_এই নে, অনেক সুতো হবে।
নবী সিকিটা ছুড়ে মারে ওয়েটিংরুমের মেঝেয়_না, আমি নিমু না। চার আনায় আমি কী করুম? আমার অনেক রছি লাগব। আমার ঘুড়ি আছমান ছুঁইব গিয়া।
সবাই অবাক হয়ে যায় নবীর মেজাজ দেখে। ভদ্রলোক সিকিটা হাতে নিয়ে হাসতে হাসতে বলেন_ঘুড়ি আসমান ছুঁলে তোর কী হবে?
_ক্যান্, আরছের পায়ায় বাঁধাইয়া টান দিমু, এক স্বপি্নল নেশা আর শক্তির স্ফূর্তিতে নবী মুহূর্তে যেন বিরাট কিছু হয়ে ওঠে_আল্লা খালি আপনাগো কতাই ছুনব, আমাগো কতা বুঝি ছুনোন লাগব না হের?
এবার সবাই এ-ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে। পরিবেশটা মূহূর্তে যেন কেমন থমথমে বিষণ্ন হয়ে ওঠে। কারো মুখে টু শব্দটি নেই। রাজভক্তদের সামনে যেন রাজদ্রোহের বাণী উচ্চারিত হয়েছে শিশুর মুখে। ভদ্রলোক পকেট হতে একটা আধুলি বের করে বলেন_এই নে, এখন হবে তো?
আধুলিটা হাতে নিয়ে কৃতজ্ঞতায় আঁখি ছলছল করে ওঠে নবীর। আন্তরিকতা মিশিয়ে বলে, আমাগো যখন অনেক পইছা অইব, আমাগো বাড়ি তখন আইয়েন_আপনের জেব ভইরা দিয়া দিব হেদিন।
নবীর কথায় হেসে ফেলে সবাই। যিনি আধুলিটা দিয়েছেন তিনি তো উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন হাসিতে। তাঁর আজকের এই মেহেরবানির কথা ভুলতে পারবে না নবী_দিন যখন ফিরবে, নবী দুই জেব ভর্তি করে পয়সা দিয়ে শোধ করবে তাঁর ঋণ। হাসতে হাসতেই বলেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই আসব, আমরা সবাই আসব সেদিন।
নবী এসব শোনার জন্যে অপেক্ষা করে না। সে সোজা চলে যায় চকের দিকে। অনেকটা সুতো কিনে যখন বাড়ি ফিরল তখন সন্ধ্যা মিলিয়ে গেছে। সুতোটা সে লুকিয়ে রেখে আসে মসজিদে_তার ঘুড়ির পাশে।
হালিমা ভিক্ষা করে আনা চালগুলো জ্বাল দিচ্ছে আর সুরবুর হচ্ছে ধুয়োয়। গাছতলা থেকে ভিজে বন কুড়িয়ে এনেছে আগুন ধরাবার জন্যে, নবীকে দেখেই চোখ কচলাতে কচলাতে বলে_কিরে, অতোক্ষণে কোত্থে আইলি?
মার দরদভরা প্রশ্নে অত্যন্ত খুশি হয় নবী; তার মেজাজ তাহলে বিগড়ে যায়নি আজ। হয়তো পাতিল তছনছ করে পয়সা নেওয়ার খবরটি সে জানতেই পারেনি এখনো। মনে মনে আল্লাকে সে শুকরিয়া জানায়।_দোকান তে বার অইয়া একটু ঘুইরা আইলাম, মা। মার দিকে চেয়ে সে বলে সহজভাবে!
চুলোয় বন ঠেলতে ঠেলতে হালিমার কণ্ঠে দরদ ভেঙে পড়ে_দোকান তে পালাস নে যেন!_কাজটা ছিখে ফেললে অনেক পইছা আইব ঘরে_কাজ না জানলে কি আর ভাত-কাপড় জুটে?_আমাগো মা-পুতের কি এ ছাড়া আর উপায় আছে?
এবার ছেলের মুখের দিকে চেয়ে হালিমা প্রশ্ন করে_হারে নবী, তোর খিদা লাগছে না?
মায়ের আন্তরিকতায় নবী এক রকম ভুলেই যায় তার খিদের কথা। তা ছাড়া একদিকে রশি কেনার আনন্দ, অন্যদিকে মার স্নেহ_দুটোতে মিলে আজকের দিনটি অপূর্ব হয়ে উঠেছে নবীর কাছে। হেসে সে বলে_না, মা, আমার খিদা লাগছে না। দোকানে আমাগোরে খাওয়ায় কিনা দুপুরবেলা।
_তাই ভালা, হালিমা সায় দেয়_ভিক্ষার ভাত যত কম পেটে দেওয়া যায় ততই ভালো। এ ভাতে ছেলে-মাইয়া গো বাইড় থাকে না।
রান্না হলে নবী ও হালিমা, দুজনেই কিন্তু ভিক্ষার ভাত পেটে ঢেলে স্বস্তিবোধ করে কিছুটা।
পরদিন দোকানের কথা বলে নবী একটু সকাল সকালই বেরিয়ে পড়ে ঘর থেকে। আজ আবহাওয়া খুবই অনুকূল এবং নবীর হাতে অনেক সুতো। পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে অনায়াসে আজ সে তার হাত পেঁৗছে দিতে পারবে আসমানে।
নবী ঘুড়িটাকে পয়লা বুকের কাছে চেপে ধরে_বুক তার টিপটিপ করছে। কিছুক্ষণ পরেই ঘুড়ি উড়ল আসমানে, হাওয়ার ভরে নেচে নেচে দুঃসাহসের দোলায় কেঁপে কেঁপে ঘুড়ি উঠে যায় ওপর হতে ওপরে_আরো ওপরে_সুতো আজ ফুরোতে চায় না_ঘুড়ি ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে_অই বুঝি ঘুড়ি হারিয়ে যায় দৃষ্টির ওপারে, অসীম শূন্যতায়!
আবেগে, ঔৎসুক্যে, বড় হয়ে এলো নবীর চোখ দুটো। তার বুকের শ্বাস দীর্ঘ হতে দীর্ঘতর হয়ে আসে, ঠোটের বাঁধন খুলে গিয়ে একটা অদ্ভুত হাসির আমেজ লাগে তার সারা মুখে। ঘুড়ির নাচের সঙ্গে একটা অপূর্ব চঞ্চলতায় নাচতে থাকে তার বড় হয়ে আসা চোখের চকচকে তারা দুটো।
একসময় টের পায় নবী_লাটাই আর ঘুরছে না_সুতো শেষ হয়ে গেছে। সেই নির্জন ফণিমনসায় ঘেরা জায়গাটুকুতে নবীর চোখ পানিতে ভরে আসে। ঘুড়ি এখনো দৃষ্টিসীমার ভেতরেই।
নবী ঘুড়ি নামিয়ে আনল। আরো রশি চাই তার_অনেক রশি। খোদা তাঁর আসন এত দূরে পেতেছেন কেন? বুঝতে পারে না নবী। কিন্তু আসন দূরে পাতলেই কি আরশে বসে ঘুমানো এত নিরাপদ? সংসারে কি রশি নেই যে তার আরশ ছোঁওয়া যাবে না, টলিয়ে দেওয়া যাবে না পায়ায় রশি লাগিয়ে? নবীর আকাঙ্ক্ষা আরো প্রবল হয়ে ওঠে বাধা পেয়ে।
চিরদিনকার মতো মসজিদে ঘুড়ি আর লাটাই লুকিয়ে রেখে, আজও সে চলে ইস্টিশনে! পয়সা চাই তার, রশি কেনার পয়সা_যে রশি সে আরশের পায়ায় বেঁধে খোদাকে নামিয়ে আনবে মাটির মানুষের মধ্যে!
শেষ পর্যন্ত দুই আনার বেশি আর জুটে না। কতটুকু সুতোই বা আর কেনা যায় এ দিয়ে।
এমনি করে রোজ কিছু কিছু পয়সা আয় করে নবী_আর তাই দিয়ে সুতো কিনে পুরনো সুতোটার সঙ্গে জুড়ে দিয়ে ঘুড়ি উড়িয়ে দেয় আসমানে।
হালিমা নবীর এ কথায় সায় দিতে পারত না কোনোদিনই। কিন্তু এই মুহূর্তে সে সায় না দিয়ে পারে না। নবীর চোখে যেন সে পরিচয় পেয়েছে_তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের।
জমিদারবাড়ির দেওয়া পয়সা আর চালে দুদিন ভালোই যায় তাদের। আবার শুরু হয় আধপেটা খাওয়া আর উপোসের পালা। নবীর মন ভেঙে পড়ে_রাগে জ্বালা ধরে যায় তার সমস্ত সত্তায়। একি ছলনা_একি ছিনিমিনি খেলা বান্দার জীবন নিয়ে? তাদের আরজ তাহলে এখনো গিয়ে পেঁৗছায়নি খোদার কাছে!
নবী রোজ ঘুড়ি ওড়ায় আর মনে মনে বলে_আল্লাহর আরশ পর্যন্ত পেঁৗছতে পারে এত সুতো যদি সে কিনতে না-ই পারে, এত ফেরেশতা রয়েছে কী জন্য? তারাই তো মানুষের দিলের আরজ পেঁৗছায় নিয়ে খোদার কাছে। তাঁর কাছ থেকে তারাই তো পয়গাম নিয়ে আসে মানুষের কাছে! আজকাল এত নিষ্ক্রিয় কেন এই ফেরেশতারা? কেন তারা নবীর ঘুড়িকে নিয়ে যায় না আল্লাহর কাছে?
সেদিন সোমবার। নবী না খেয়েই ঘুড়ি আর লাটাই নিয়ে বেরিয়ে পড়ে চুপিচুপি। সেই ফণিমনসায় ঘেরা নির্জন জায়গাটুকু। নবী দুর্বার ওপর বসে নতুন সুতোটাকে জুড়ে দেয় পুরনো সুতোটার সঙ্গে। আসমান কেমন যেন মেঘলা মেঘলা। সূর্যের আলো পরে মেঘগুলো সাদা হয়ে গেছে আর ফাঁকে ফাঁকে চকচক করছে গাঢ় নীল আসমান। একসময় নবী ঘুড়িটাকে উড়িয়ে দেয় আসমানে_হাতে তার লাটাই ঘুরছে আর শনশন করে ধাওয়া করছে ঊর্ধ্বদিকে। নবী অপলক চেয়ে আছে ঘুড়ির পানে, আর রশিতে টান পড়ে পড়ে ঝিনঝিন করে উঠছে তার সারা শরীর। অকারণ উল্লাসে ভরে উঠছে নবীর মন! নবী কিছুই বুঝে উঠতে পারে না! মন তার আবেগে-উৎসাহে থরথর করে কেঁপে উঠছে, কল্পনা স্বর্ণ-ঈগলের মতো ডানা মেলেছে আসমানে!
ঘুড়ি ক্রমেই ছোট হয়ে এলো! একসময় নবী বিস্মিত হয়ে দেখতে পায়, তার ক্ষুদ্র ঘুড়িটার চারপাশে একটা বৃহৎ পাখি উড়ছে আর ঘুরছে। মাঝেমধ্যে পাখিটা হারিয়ে যাচ্ছে মেঘের আড়ালে, আবার দেখা যাচ্ছে। বৃহৎ ডানা মেলে ঘুরছে ঘুড়িটাকে কেন্দ্র করে আশ্চর্য, একবার ঘুড়ির রশি আটকে যায় পাখির গায়, নবীর হাতে টান পড়ে আর তাতেই সারা দেহ অজানা আশঙ্কায় দুলে ওঠে_পাখিটা ঘুড়ি নিয়েই ঘুরতে থাকে আরো দ্রুতবেগে। রশি আরো প্যাঁচ খেয়ে লাগে পাখির ডানায় আর গায়ে। হঠাৎ একসময় নবী টের পায়, সুতো ঢিল হয়ে গিয়ে নেমে আসছে আর ঘুড়ি ঘুরছে পাখির পিছে পিছে। নবীর এতদিনের অহংকার মাটি হয়ে যায় আজ! আরশের পায়ায় রশি লাগিয়ে আরশকে টলিয়ে দেওয়া আর সম্ভব হলো না জীবনে!
একাকী শূন্য মাঠে ডুকরে কেঁদে ওঠে নবী। দুই চোখ ভরা আঁসু নিয়ে একবার সে তাকায় ঘুড়ির দিকে। একটা কালো বিন্দুর মতো পাখির পিছে পিছে ঘুরছে ঘুড়ি; আর পাখিটা শুধু ঘুরে ঘুরে ওপরের দিকেই উঠছে। আচমকা নবীর মনে হলো_এ তো পাখি নয়_এ যে ফেরেশতা_জিবরাইল এসেছে পাখির সুরত ধরে তার ঘুড়িকে আল্লার কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্যে! দুই চোখ ফেটে এবার কৃতজ্ঞতার আঁসু গড়িয়ে পড়ছে নবীর গাল বেয়ে; তার আঁসু ধোয়া মুখে ফুটে ওঠে একটা অপূর্ব হাসি_বেদনা আর আনন্দে ঝলঝল করা।
নিজের বোকামির কথা ভেবে শরম হয় নবীর। এতদিন পরে ফেরেশতা এসেছে তার দিলের আরজ আল্লার কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য! আর সে কি না কাঁদছে পাখি তার ঘুড়ি নিয়ে গেল বলে! চোখ মুছে সে তাকায় আসমানের দিকে_দেখে পাখিও নেই_ঘুড়িও নেই, শুধু সাদা মেঘ, আর তারি ফাঁকে ফাঁকে চকচক করা গাঢ় নীল আসমান! অনেকক্ষণ নবী চেয়ে থাকে আসমানের দিকে, আবার তার চোখ ফেটে দরদর করে বেরিয়ে আসে কৃতজ্ঞতার আঁসু। আজকে সে সার্থক_আজকে সে জয়ী! আর কোনো ভাবনা নেই তার, জিবরাইল এসে নিয়ে গেছে তার ঘুড়ি_নতুন পাতা খুলবে এবার জীবনের।
আবার আসমানের দিকে চেয়ে, এক ঝলক হেসে নবী বাড়ি ফিরে আসে। খুশিতে তার সারা শরীর আজ নেচে উঠছে। হালিমা উঠানে বসে শাক বাছছিল। 'মা-মা_হুনছ' বলে নবী ঝাঁপিয়ে পড়ে হালিমার কোলে।
হালিমা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে পড়ে_তারপর রাগে ঠোঁট কামড়ে; টিপে ধরে নবীর ঘাড়_গরগর করে বলে_কোত্থে আইলিরে হারামজাদা? আইজ তোর রং আমি না বাইর কইরা ছাড়ুম না!
নবী তার মার রাগের কারণ বুঝতে পারে না, তবু তার খুশির খবরটুকু সে না দিয়ে পারছে না তার মাকে_মা আইজ জিবরাইলরে দেখছি_আমগো খবর...
নবী কথা শেষ করতে পারে না_ধুম ধুম করে হালিমার শক্ত হাতের কিল পড়তে থাকে তার পিঠে। কিলোতে কিলোতেই বলে_ওরা দিব আর আমরা খামু বইয়া বইয়া? ঝাঁটা মার জিবরাইলের মুখে শতবার!
_মা মা_তুমি গাল দিও না, চিৎকার করে ওঠে নবী_গুনা অইব মা, আল্লা রাগ করব।
হালিমার রাগ আরো বেড়ে যায়_গালের ফোয়ারা থামতে চায় না তার। নিরুপায় নবী কামড়ে ধরে তার মায়ের হাত।
এবার যেন আগুন লেগে যায় হালিমার গায়। বিড়ির দোকানে মালিক আজকে বলে গেছে_নবী দোকানে যায় না কোনোদিনই; সুতরাং কাজ তার ছাড়িয়ে দেওয়া হলো আজ থেকে। দোকানির কাছেই শুনেছে হালিমা_নবী নাকি কোথায় ঘুড়ি উড়ায় সারাদিন, আর সময় সময় ছুটে বেড়ায় বাজারে, আর ইস্টিশনে। খবরটা পেয়ে অবধি গোস্বায় আগুন হয়ে ছিল হালিমা। এমন অবাধ্য শয়তান ছেলেকে দিয়ে কাজ কী? হালিমা এবার কঞ্চি হাতে নিয়ে সপাং সপাং মারতে থাকে নবীর পিঠে, হাতে, মাথায়।_হারামজাদা, তোর ভালার লাইগাই না আমার মাথা-বিষ, আর তুই কি না ফাঁকি দেছ আমারে! আমি মরলে জিবরাইল খাঞ্চা খাঞ্চা ভাত লইয়া আইব না তোর লাগি।
আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় নবীর পিঠ_চিৎকার করে সে কাঁদে এবং কামড়ে রক্তাক্ত করে দেয় হালিমাকে। একসময় প্রায় বেহুঁশ হয়ে সে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে।
রাতের বেলা হালিমার গায়ে জ্বর এসে যায়। নবী তার মার দিকে একবার চায় এবং কিছু না বলে ঘরের এক কোণে শুয়ে পড়ে মাটির ওপর। কিছুই পেটে পড়ল না তার। শুয়ে শুয়ে, কপাল কুঁচকে ঠোঁট ফুলিয়ে সে কটমট করে। তাকিয়ে থাকে হালিমার দিকে।
তারপর, কখন যে সে ঘুমিয়ে পড়ল, সে নিজেই জানে না।
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে নবী স্বপ্ন দেখল, জিবরাইল তার ঘুড়ি নিয়ে মেঘের ফাঁকে ফাঁকে আসমানের দিকে ধাওয়া করছে। একসময় নীল আসমান দুদিকে সরে গিয়ে পথ করে দিল জিবরাইলের জন্য। মেঘের ফাঁকে ফাঁকে আবার যাত্রা শুরু হলো_আবার একটা আসমান ফাঁক হয়ে গেল_আবার আরেকটা_ষষ্ঠ আসমান খোলার সঙ্গে সঙ্গে আগুন লেগে গেল জিবরাইলের ডানায়। জিবরাইল তবু এগোচ্ছে নবীর ঘুড়ি নিয়ে! তারপর একসময় খুলে গেল সপ্তম আসমানের দরজা আর তার ফাঁক দিয়ে একটা তীব্র আলোকচ্ছটা এসে ঝলসে দিল নবীর চোখ দুটোকে। আর চাইতে পারল না নবী_দুই চোখে হাত দিয়ে চিৎকার করে ওঠে ঘুমের ঘোরে_মাগো, আমার চোখ দুইটা পুইড়া গেল!
চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে বসে নবী_গলে যাওয়া দেয়ালের ওপর দিয়ে সূর্যের প্রখর আলো তার নাকে-মুখে এসে লাগছে।
  
অঙ্কন : চিন্ময় দেবর্ষি
¦

ক্লাস ফ্রেন্ড
ক্লাস ফ্রেন্ডসত্যজিৎ রায়
সকাল সোয়া নটা।
মোহিত সরকার সবেমাত্র টাইয়ে ফাঁসটা পরিয়েছেন, এমন সময় তাঁর স্ত্রী অরুণা ঘরে ঢুকে বললেন, 'তোমার ফোন।'
'এই সময় আবার কে?'
কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে নটায় অফিসে পেঁৗছানোর অভ্যাস মোহিত সরকারের; ঠিক বেরোনোর মুখে ফোন এসেছে শুনে স্বভাবতই তাঁর কপালে ভাঁজ পড়ল।
অরুণাদেবী বললেন, 'বলছে তোমার সঙ্গে ইস্কুলে পড়ত।'
'ইস্কুলে? বোঝ!_নাম বলেছে?'
'বলল, জয় বললেই বুঝবে!'
ত্রিশ বছর আগে ইস্কুল ছেড়েছেন মোহিত সরকার। ক্লাসে ছিল জনাচলি্লশেক ছেলে। খুব মন দিয়ে ভাবলে হয়তো তাদের মধ্যে জনাবিশেকের নাম মনে পড়বে, আর সেই সঙ্গে চেহারাও। জয় বা জয়দেবের নাম ও চেহারা দুটোই ভাগ্যক্রমে মনে আছে। কারণ সে ছিল ক্লাসে সেরা ছেলেদের মধ্যে একজন। পরিষ্কার ফুটফুটে চেহারা, পড়াশোনায় ভালো, ভালো হাইজাম্প দিত, ভালো তাসের ম্যাজিক দেখাত, ক্যাসাবিয়াঙ্কা আবৃত্তি করে একবার মেডেল পেয়েছিল। স্কুল ছাড়ার পর তার আর কোনো খবর রাখেননি মোহিত সরকার। তিনি এখন বুঝতে পারলেন যে এককালে বন্ধুত্ব থাকলেও এতকাল ছাড়াছাড়ির পর তিনি আর কোনো টান অনুভব করছেন না তাঁর ইস্কুলের সহপাঠীর প্রতি।
মোহিত অগত্যা টেলিফোনটা ধরলেন।
'হ্যালো!'
'কে, মোহিত? চিনতে পারছ ভাই? আমি সেই জয়_জয়দেবস বোস। বালিগঞ্জ স্কুল।'
'গলা চেনা যায় না, তবে চেহারাটা মনে পড়ছে। কী ব্যাপার?'
'তুমি তো এখন বড় অফিসার ভাই; নামটা যে মনে রেখেছ এটাই খুব!'
'ওসব থাক_এখন কী ব্যাপার বল।'
'ইয়ে, একটু দরকার ছিল। একবার দেখা হয়?'
'কবে?'
'তুমি যখন বলবে। তবে যদি তাড়াতাড়ি হয় তাহলে...'
'তাহলে আজই করো। আমার ফিরতে ফিরতে ছয়টা হয়। সাতটা নাগাদ আসতে পারবে?'
'নিশ্চয়ই পারব। থ্যাঙ্ক ইউ ভাই। তখন কথা হবে।'
হালে কেনা হালকা নীল স্ট্যান্ডার্ড গাড়িতে আপিস যাবার পথে মোহিত সরকার ইস্কুলের ঘটনা কিছু মনে আনার চেষ্টা করলেন। হেডমাস্টার গিরীন সুরের ঘোলাটে চাহনি আর গুরুগম্ভীর মেজাজ সত্ত্বেও স্কুলের দিনগুলি ভারি আনন্দের ছিল। মোহিত নিজেও ভালো ছাত্র ছিলেন। শঙ্কর, মোহিত আর জয়দেব_এই তিনজনের মধ্যেই রেষারেষি ছিল। ফার্স্ট সেকেন্ড থার্ড তিনজনে যেন পালা করে হতো। ক্লাস সিঙ্ থেকে মোহিত সরকার আর জয়দেব বোস একসঙ্গে পড়েছেন। অনেক সময় এক বেঞ্চিতেই পাশাপাশি বসতেন দুজন। ফুটবলেও পাশাপাশি স্থান ছিল দুজনের; মোহিত খেলতেন রাইট-ইন, জয়দেব রাইট-আউট; তখন মোহিতের মনে হতো এই বন্ধুত্ব বুঝি চিরকালের। কিন্তু ইস্কুল ছাড়ার পরেই দুজনের রাস্তা আলাদা হয়ে গেল। মোহিতের বাবা ছিলেন অবস্থাপন্ন লোক, কলকাতার নামকরা ব্যারিস্টার। ইস্কুল শেষ করে মোহিত ভালো কলেজে ঢুকে ভালো পাস করে দু'বছরের মধ্যেই ভালো সদাগরী আপিসে চাকরি পেয়ে যায়। জয়দেব চলে যায় অন্য শহরের অন্য কলেজে, কারণ তার বাবার ছিল বদলির চাকরি। তারপর আশ্চর্য ব্যাপার, মোহিত দেখেন যে তিনি আর জয়দেবের অভাব বোধ করছেন না; তার জায়গায় নতুন বন্ধু জুটেছে কলেজে। তারপর সেই বন্ধু বদলে গেল যখন ছাত্রজীবন শেষ করে মোহিত চাকরির জীবনে প্রবেশ করলেন। এখন তিনি তাঁর আপিসের চারজন মাথার মধ্যে একজন; এবং তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হলো তাঁরই একজন সহকর্মী। স্কুলের সহপাঠীদের মধ্যে একমাত্র প্রজ্ঞান সেনগুপ্তের সঙ্গে মাঝে মাঝে ক্লাবে দেখা হয়; সেও ভালো আপিসে বড় কাজ করে। আশ্চর্য, ইস্কুলের স্মৃতির মধ্যে কিন্তু প্রজ্ঞানের কোনো স্থান নেই। অথচ জয়দেব_যার সঙ্গে ত্রিশ বছর দেখাই হয়নি_স্মৃতির অনেকটা জায়গা দখল করে আছে। এই সত্যটা মোহিত পুরনো কথা ভাবতে ভাবতে বেশ ভালো করে বুঝতে পারলেন।
মোহিতের অফিসটা সেন্ট্রাল এভিনিউতে। চৌরঙ্গী আর সুরেন ব্যানার্জির সংযোগস্থলের কাছাকাছি আসতেই গাড়ির ভিড়, মোটরের হর্ন আর বাসের ধোঁয়া মোহিত সরকারকে স্মৃতির জগৎ থেকে হুড়মুড়িয়ে বাস্তব জগতে এনে ফেলল। হাতের ঘড়িটার দিকে চোখ পড়াতে মোহিত বুঝলেন যে তিনি আজ মিনিট তিনেক লেট হবেন।
অফিসের কাজ সেরে সন্ধ্যায় তাঁর লি রোডের বাড়িতে যখন ফিরলেন মোহিত, তখন তাঁর মনে বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলের স্মৃতির কণামাত্র অবশিষ্ট নেই। সত্যি বলতে কী, তিনি সকালের টেলিফোনের কথাটাও বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন; সেটা মনে পড়ল যখন বেয়ারা বিপিন বৈঠকখানায় এসে তাঁর হাতে রুলটানা খাতার পাতা ভাঁজ করে ছেঁড়া একটা চিরকুট দিল। তাতে ইংরেজিতে লেখা_'জয়দেব বোস, অ্যাজ পার অ্যাপয়েন্টমেন্ট'।
রেডিওতে বিবিসির খবরটা বন্ধ করে মোহিত বিপিনকে বললেন, 'ভেতরে আসতে বল'_আর বলেই মনে হলো, জয় এতকাল পরে আসছে, তার জন্য কিছু খাবার আনিয়ে রাখা উচিত ছিল। আপিস-ফেরতা পার্ক স্ট্রিট থেকে কেক-পেস্ট্রিজাতীয় কিছু কিনে আনা তাঁর পক্ষে খুবই সহজ ছিল, কিন্তু খেয়াল হয়নি। তাঁর স্ত্রী কি আর নিজে খেয়াল করে এ কাজটা করেছেন?
'চিনতে পারছ?'
গলার স্বর শুনে, আর সেই সঙ্গে কণ্ঠস্বরের অধিকারীর দিকে চেয়ে মোহিত সরকারের যে প্রতিক্রিয়াটা হলো সেটা সিঁড়ি উঠতে গিয়ে শেষ ধাপ পেরোনোর পরেও আরেক ধাপ আছে মনে করে পা ফেললে হয়।
চৌকাঠ পেরিয়ে যিনি ঘরের ভেতর এসে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁর পরনে ছাই রঙের বেখাপ্পা ঢলঢলে সুতির প্যান্টের ওপর হাতকাটা সস্তা ছিটের শার্ট দুটির কোনোটিও কস্মিনকালে ইস্তিরির সংস্পর্শে এসেছে বলে মনে হয় না। শার্টের কলারের ভিতর দিয়ে যে মুখটি বেরিয়ে আছে তার সঙ্গে অনেক চেষ্টা করেও মোহিত তাঁর স্মৃতির জয়দেবের সঙ্গে কোনো সাদৃশ্য খুঁজে পেলেন না। আগন্তুকের চোখ কোটরে বসা, গায়ের রঙ রোদে পুড়ে ঝামা, গাল তোবড়ানো, থুতনিতে অন্তত তিন দিনের কাঁচা-পাকা দাড়ি, মাথার উপরাংশ মসৃণ, কানের পাশে কয়েক গাছা অবিন্যস্ত পাকা চুল। প্রশ্নটা হাসিমুখে করায় ভদ্রলোকের দাঁতের পাটিও দেখতে পেরেছেন মোহিত সরকার, এবং মনে হয়েছে পান-খাওয়া ক্ষয়ে-যাওয়া অমন দাঁত নিয়ে হাসতে হলে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে হাসা উচিত।
'অনেক বদলে গেছি, না?'
'বোসো।'
মোহিত এতক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছেন। সামনের সোফায় আগন্তুক বসার পর মোহিতও তাঁর নিজের জায়গায় বসলেন। মোহিতের নিজের ছাত্রজীবনের কয়েকটা ছবি তাঁর অ্যালবামে আছে; সেই ছবিতে চোদ্দ বছর বয়সের মোহিতের সঙ্গে আজকের মোহিতের আদল বার করতে অসুবিধা হয় না। তাহলে এঁকে চেনা এত কঠিন হচ্ছে কেন? ত্রিশ বছরে একজনের চেহারায় এত পরিবর্তন হয় কি?
'তোমাকে কিন্তু বেশ চেনা যায়। রাস্তায় দেখলেও চিনতে পারতাম'_ভদ্রলোক কথা বলে চলেছেন_'আসলে আমার ওপর দিয়ে অনেক ঝড় বয়ে গেছে। কলেজে পড়তে পড়তে বাবা মারা গেলেন, আমি পড়া ছেড়ে চাকরির ধান্দায় ঘুরতে শুরু করি। তারপর, ব্যাপার তো বোঝই। কপাল আর ব্যাকিং এ দুটোই যদি না থাকে, তাহলে আজকের দিনে একজন ইয়ের পক্ষে...'
'চা খাবে?'
'চা? হ্যাঁ, তা....
মোহিত বিপিনকে ডেকে চা আনতে বললেন, আর সেই সঙ্গে এই ভেবে আশ্বস্ত হলেন যে কেক মিষ্টি যদি নাও থাকে, তাহলেও ক্ষতি নেই; এনার পক্ষে বিস্কুটই যথেষ্ট।
'ওঃ।' _ভদ্রলোক বলে চলেছেন, 'আজ সারা দিন ধরে কত পুরনো কথাই না ভেবেছি, জান মোহিত!'
মোহিত নিজেরও যে কিছুটা সময় তাই করেছেন সেটা আর বললেন না।
'এল সি এম, জি সি এম-কে মনে আছে?'
মোহিতের মনে ছিল না, কিন্তু বলতেই মনে পড়ল। এল সি এম হলেন পি-টির মাস্টার লালচাঁদ মুখুজ্যে। আর জি সি এম হলেন অঙ্কের স্যার গোপেন মিত্তির।
'আমাদের খাবার জলের ট্যাঙ্কের পেছনটায় দুজনকে জোর করে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে কে বঙ্ ক্যামেরায় ছবি তুলেছিল মনে আছে?'
ঠোঁটের কোণে একটা হাল্কা হাসি এনে মোহিত বুঝিয়ে দিলেন যে তাঁর মনে আছে। আশ্চর্য, এগুলো তো সবই সত্যি কথা। ইনি যদি জয়দেব না হন, তাহলে এত কথা জানলেন কী করে?'
'স্কুল লাইফের পাঁচটা বছরই আমার জীবনের বেস্ট টাইম, জান ভাই,' বললেন আগন্তুক, 'তেমন দিন আর আসবে না।'
মোহিত একটা কথা না বলে পারলেন না।
'তোমার তো মোটামুটি আমারই বয়স ছিল বলে মনে পড়ে'_
'তোমার চেয়ে তিন মাসের ছোট।'
'_তাহলে এমন বুড়োলে কী করে? চুলের দশা এমন হলো কী করে?'
'স্ট্রাগ্ল, ভাই স্ট্রাগল,' বললেন আগন্তুক। 'অবিশ্যি টাকটা আমাদের ফ্যামিলির অনেকেরই আছে। বাপ-ঠাকুরদা দুজনেরই টাক পড়ে যায় পঁয়ত্রিশের মধ্যে! গাল ভেঙেছে হাড়ভাড়া খাটুনির জন্য, আর প্রপার ডায়েটের অভাবে। তোমাদের মতো তো টেবিল-চেয়ারে বসে কাজ নয় ভাই। কারখানায় কাজ করেছি সাত বছর, তারপর মেডিক্যাল সেলসম্যান, ইনশিওরেন্সের দালালি, এ দালালি, সে দালালি! এক কাজে টিকে থাকব সে তো আর কপালে লেখা নেই। তাঁতের মাকুর মতো একবার এদিক একবার ওদিক। কথায় বলে_শরীরের নাম মহাশয়, যা সওয়াবে তাই সয়_অথচ তাতে শেষ অবধি শরীরটা গিয়ে কী দাঁড়ায় তা তো আর বলে না। সেটা আমায় দেখে বুঝতে হবে।'
বিপিন চা এনে দিল। সঙ্গে প্লেটে সন্দেশ আর শিঙাড়া। গিনি্নর খেয়াল আছে বলতে হবে। ক্লাস ফ্রেন্ডের এই ছিরি দেখলে কী ভাবতেন সেটা মোহিত আন্দাজ করতে পারলেন না।
'তুমি খাবে না?' আগন্তুক প্রশ্ন করলেন। মোহিত মাথা নাড়লেন।_'আমি এইমাত্র খেয়েছি।'
'একটা সন্দেশ?'
'নাঃ, আপ_তুমিই খাও।'
ভদ্রলোক শিঙাড়ায় কামড় দিয়ে চিবোতে চিবোতেই বললেন, 'ছেলেটার পরীক্ষা সামনে। অথচ এমন দশা, জানো মোহিত ভাই, ফির টাকাটা যে কোত্থেকে আসবে, তা তো বুঝতে পারছি না।'
আর বলতে হবে না। মোহিত বুঝে নিয়েছেন। আগেই বোঝা উচিত ছিল এঁর আসার কারণটা। সাহায্য প্রার্থনা। আর্থিক সাহায্য। কত চাইবেন? বিশ-পঁচিশ হলে দিয়ে দেওয়াই হবে বুদ্ধিমানের কাজ, কারণ না দিলেই যে উৎপাতের শেষ হবে এমন কোনো ভরসা নেই।
'আমার ছেলেটা খুব ব্রাইট, জানো ভাই। পয়সার অভাবে তার পড়াশোনা মাঝপথে বন্ধ হয়ে যেতে পারে, এ কথাটা ভেবে আমার রাতে ঘুম হয় না।'
দ্বিতীয় শিঙাড়াটাও উঠে গেল প্লেট থেকে। মোহিত সুযোগ পেলেই জয়দেবের সেই ছেলে বয়সের চেহারাটার সঙ্গে আগন্তুকের চেহারা মিলিয়ে দেখছেন, আর ক্রমেই তাঁর বিশ্বাস বদ্ধমূল হচ্ছে যে সেই বালকের সঙ্গে এই প্রৌঢ়ের কোনো সাদৃশ্য নেই।
'তাই বলছিলাম, ভাই', চায়ে সশব্দ চুমুক দিয়ে বললেন আগন্তুক, 'অন্তত শ'খানেক কি শ' দেড়েক যদি এই পুরনো বন্ধুর হাত তুলে দিতে পারো, তাহলে_'
'ভেরি স্যরি।'
'অ্যাঁ?'
টাকার কথাটা উঠলেই সরাসরি না করে দেবেন এটা মোহিত মনে মনে স্থির করে ফেলেছিলেন। কিন্তু এখন মনে হলো ব্যাপারটা এতটা রূঢ়ভাবে না করলেও চলত। তাই নিজেকে খানিকটা শুধরে নিয়ে গলাটাকে আরেকটু নরম করে বললেন, 'স্যরি ভাই। আমার কাছে জাস্ট নাউ ক্যাশের একটু অভাব।'
'আমি কাল আসতে পারি। এনি টাইম। তুমি যখনই বলবে।'
'কাল আমি একটু কলকাতার বাইরে যাব। ফিরব দিন তিনেক পরে। তুমি রোববার এসো।'
'রবিবার...'
আগন্তুক যেন খানিকটা চুপসে গেলেন। মোহিত মনস্থির করে ফেলেছেন। ইনিই যে জয়, চেহারায় তার কোনো প্রমাণ নেই। কলকাতার মানুষ ধাপ্পা দিয়ে টাকা রোজগারের হাজার ফিকির জানে। ইনি যদি জালিয়াত হন? হয়তো আসল জয়দেবকে চেনেন। তার কাছ থেকে ত্রিশ বছর আগের বালিগঞ্জ স্কুলের কয়েকটা ঘটনা জেনে নেওয়া আর এমন কী কঠিন কাজ?
'রবিবার কখন আসব?' আগন্তুক প্রশ্ন করলেন।
'সকালের দিকেই ভালো। এই নটা সাড়ে নটা।'
শুক্রবার ঈদের ছুটি। মোহিতের আগে থেকেই ঠিক আছে বারুইপুরে এক বন্ধুর বাগানবাড়িতে সস্ত্রীক গিয়ে উইক-এন্ড কাটিয়ে আসবেন। দুদিন থেকে রবিবার রাতে ফেরা; সুতরাং ভদ্রলোক সকালে এলে তাঁকে পাবেন না। এই প্রতারণাটুকুরও প্রয়োজন হতো না যদি মোহিত সোজাসুজি মুখের ওপর না করে দিতেন। কিন্তু কিছু লোক আছে যাদের দ্বারা এ জিনিসটা হয় না। মোহিত এই দলেই পড়েন। রবিবার তাঁকে না পেয়ে যদি আবার আসেন ভদ্রলোক, তাহলে তাঁর সঙ্গে দেখা না করার কোনো অজুহাত বার করবেন মোহিত সরকার। তারপর হয়তো আর বিরক্ত হতে হবে না।
আগন্তুক চায়ের কাপে শেষ চুকুম দিয়ে সেটা নামিয়ে রাখতেই ঘরে আরেকজন পুরুষ এসে ঢুকলেন। ইনি মোহিতের অন্তরঙ্গ বন্ধু বাণীকান্ত সেন। আরো দুজন আসার কথা আছে, তারপর তাসের আড্ডা বসবে। এটা রোজকার ঘটনা। বাণীকান্ত ঘরে ঢুকেই যে আগন্তুকের দিকে একটা সন্দিগ্ধ দৃষ্টি দিলেন সেটা মোহিতের দৃষ্টি এড়াল না। আগন্তুকের সঙ্গে বন্ধুর পরিচয়ের ব্যাপারটা মোহিত অম্লান বদনে এড়িয়ে গেলেন।
'আচ্ছা, তাহলে আসি...' আগন্তুক উঠে দাঁড়িয়েছেন। 'তুই এই উপকারটা করলে সত্যিই গ্রেটফুল থাকব ভাই, সত্যিই।'
ভদ্রলোক বেরিয়ে যাবার পর মুহূর্তেই বাণীকান্ত বন্ধুর দিকে ফিরে ভ্রুকুঞ্চিত করে বললেন, 'এই লোক তোমাকে তুই করে বলছে_ ব্যাপারটা কী?'
'এতক্ষণ তুমি বলছিল, শেষে তোমাকে শুনিয়ে হঠাৎ তুই বলল।'
'লোকটা কে?'
মোহিত উত্তর না দিয়ে বুকশেল্ফ থেকে একটা পুরনো ফোটো অ্যালবাম বার করে তার একটা পাতা খুলে বাণীকান্তর দিকে এগিয়ে দিল।
'একি তোমার ইস্কুলের গ্রুপ নাকি?'
'বোট্যানিক্সে পিকনিকে গিয়েছিলাম,' বললেন মোহিত সরকার।
'কারা এই পাঁচজন?'
'আমাকে চিনতে পারছ না?'
'দাঁড়াও, দেখি।'
অ্যালবামের পাতাটাকে চোখের কাছে নিয়ে বাণীকান্ত সহজেই তাঁর বন্ধুকে চিনে ফেললেন।
'এবার আমার ডানপাশের ছেলেটিকে দেখ তো ভালো করে।'
ছবিটাকে আরো চোখের কাছে এনে বাণীকান্ত বললেন, 'দেখলাম।'
মোহিত বললেন, 'ইনি হচ্ছেন যিনি এইমাত্র উঠে গেলেন।'
'ইস্কুল থেকেই কি জুয়া ধরেছিলেন নাকি?'_অ্যালবামটা সশব্দে বন্ধ করে পাশের সোফায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে প্রশ্ন করলেন বাণীকান্ত। _'ভদ্রলোককে অন্তত বত্রিশবার দেখেছি রেসের মাঠে।'
'সেটাই স্বাভাবিক', বললেন মোহিত সরকার। তারপর আগন্তুকের সঙ্গে কী কথা হলো সেটা সংক্ষেপে বললেন।
'পুলিশে খবর দে', বললেন বাণীকান্ত, 'চোর জোচ্চোর জালিয়াতের ডিপো হয়েছে কলকাতা শহর। এই ছবির ছেলে আর ওই জুয়াড়ি এক লোক হওয়া ইম্পসিবল।'
মোহিত হালকা হাসি হেসে বললেন, 'রোববার এসে আমাকে না পেলেই ব্যাপারটা বুঝবে। তারপর আর উৎপাত করবে বলে মনে হয় না।'
বারুইপুরে বন্ধুর পুকুরের মাছ, পোলট্রির মুরগির ডিম, আর গাছের আম জাম ডাব পেয়ারা খেয়ে, বুকল গাছের ছায়ায় সতরঞ্চি পেতে বুকে বালিশ নিয়ে তাস খেলে শরীর ও মনের অবসাদ দূর করে রবিবার রাত এগারোটায় বাড়ি ফিরে মোহিত সরকার বিপিন বেয়ারার কাছে শুনছেন যে সেদিন যে ভদ্রলোকটি এসেছিলেন তিনি আজ সকালে আবার এসেছিলেন।_'যাবার সময় কিছু বলে গেছেন কি?'
'আজ্ঞে না,' বলল বিপিন।
যাক্, নিশ্চিন্ত! একটা সামান্য কৌশল, কিন্তু তাতে কাজ দিয়েছে অনেক। আর আসবে না। আপদ গেছে।
কিন্তু না। আপদ সেদিনের জন্য গেলেও পরের দিন সকাল আটটা নাগাদ মোহিত যখন বৈঠকখানায় বসে খবরের কাগজ পড়ছেন, তখন বিপিন আবার একটি ভাঁজ করা চিরকুট এনে দিল তাঁকে। মোহিত খুলে দেখলেন তিন লাইনের একটি চিঠি।
ভাই মোহিত,
আমার ডান পা-টা মচকেছে, তাই ছেলেকে পাঠাচ্ছি। সাহায্যস্বরূপ সামান্য কিছুও এর হাতে দিলে অশেষ উপকার হবে। আশা করি হতাশ করবে না।_
ইতি জয়
মোহিত বুঝলেন এবার আর রেহাই নেই। তবে সামান্য মানে সামান্যই, এই স্থির করে তিনি বেয়ারাকে বললেন, 'ডাক ছেলেটিকে।'
মিনিট খানেকের মধ্যেই একটি তেরো-চোদ্দ বছর বয়সের ছেলে দরজা দিয়ে ঢুকে মোহিতের দিকে এগিয়ে এসে তাঁকে প্রণাম করে আবার কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
মোহিত তার দিকে মিনিট খানেক চেয়ে থাকলেন। তারপর বললেন, 'বোস।'
ছেলেটি একটু ইতস্তত ভাব করে একটি সোফার এক কোণে হাত দুটোকে কোলের ওপর জড়ো করে বসল।
'আমি আসছি এক্ষুনি।'
মোহিত দোতলায় গিয়ে স্ত্রীর আঁচল থেকে চাবির গোছাটা খুলে নিয়ে আলমারি খুলে দেরাজ থেকে চারটে পঞ্চাশ টাকার নোট বার করে একটা খামে পুরে আলমারি বন্ধ করে আবার নিচের বৈঠকখানায় ফিরে এলেন।
'কী নাম তোমার?'
'শ্রী সঞ্জয়কুমার বোস।'
'এতে টাকা আছে। সাবধানে নিতে পারবে?'
ছেলেটি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।
'কোথায় নেবে?'
'বুক পকেটে।'
'ট্রামে ফিরবে, না বাসে?'
'হেঁটে।'
'হেঁটে? কোথায় বাড়ি তোমার?'
'মির্জাপুর স্ট্রিট।'
'এত দূর হাঁটবে?'
'বাবা বলেছেন হেঁটে ফিরতে।'
'তার চেয়ে এক কাজ করো। ঘণ্টাখানেক বোস, চা-মিষ্টি খাও, অনেক বইটই আছে, দেখো_আমি নটায় অফিসে যাব, আমায় নামিয়ে দিয়ে আমার গাড়ি তোমার বাড়ি পেঁৗছে দেবে। তুমি বাড়ি চিনিয়ে দিতে পারবে তো?'
ছেলেটি আবার মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।
মোহিত বিপিনকে ডেকে ছেলেটির জন্য চা দিতে বলে আপিসে যাবার জন্য তৈরি হতে দোতলায় রওনা হলেন।
ভারি হালকা বোধ করছেন তিনি, ভারি প্রসন্ন।
জয়কে দেখে না চিনলেও তিনি তার ছেলে সঞ্জয়ের মধ্যে তাঁর ত্রিশ বছর আগের ক্লাস ফ্রেন্ডটিকে ফিরে পেয়েছেন।
    ক্লাস ফ্রেন্ডসত্যজিৎ রায়
অঙ্কন : চিন্ময় দেবর্ষি
¦

ক্লাস ফ্রেন্ড
ক্লাস ফ্রেন্ডসত্যজিৎ রায়
সকাল সোয়া নটা।
মোহিত সরকার সবেমাত্র টাইয়ে ফাঁসটা পরিয়েছেন, এমন সময় তাঁর স্ত্রী অরুণা ঘরে ঢুকে বললেন, 'তোমার ফোন।'
'এই সময় আবার কে?'
কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে নটায় অফিসে পেঁৗছানোর অভ্যাস মোহিত সরকারের; ঠিক বেরোনোর মুখে ফোন এসেছে শুনে স্বভাবতই তাঁর কপালে ভাঁজ পড়ল।
অরুণাদেবী বললেন, 'বলছে তোমার সঙ্গে ইস্কুলে পড়ত।'
'ইস্কুলে? বোঝ!_নাম বলেছে?'
'বলল, জয় বললেই বুঝবে!'
ত্রিশ বছর আগে ইস্কুল ছেড়েছেন মোহিত সরকার। ক্লাসে ছিল জনাচলি্লশেক ছেলে। খুব মন দিয়ে ভাবলে হয়তো তাদের মধ্যে জনাবিশেকের নাম মনে পড়বে, আর সেই সঙ্গে চেহারাও। জয় বা জয়দেবের নাম ও চেহারা দুটোই ভাগ্যক্রমে মনে আছে। কারণ সে ছিল ক্লাসে সেরা ছেলেদের মধ্যে একজন। পরিষ্কার ফুটফুটে চেহারা, পড়াশোনায় ভালো, ভালো হাইজাম্প দিত, ভালো তাসের ম্যাজিক দেখাত, ক্যাসাবিয়াঙ্কা আবৃত্তি করে একবার মেডেল পেয়েছিল। স্কুল ছাড়ার পর তার আর কোনো খবর রাখেননি মোহিত সরকার। তিনি এখন বুঝতে পারলেন যে এককালে বন্ধুত্ব থাকলেও এতকাল ছাড়াছাড়ির পর তিনি আর কোনো টান অনুভব করছেন না তাঁর ইস্কুলের সহপাঠীর প্রতি।
মোহিত অগত্যা টেলিফোনটা ধরলেন।
'হ্যালো!'
'কে, মোহিত? চিনতে পারছ ভাই? আমি সেই জয়_জয়দেবস বোস। বালিগঞ্জ স্কুল।'
'গলা চেনা যায় না, তবে চেহারাটা মনে পড়ছে। কী ব্যাপার?'
'তুমি তো এখন বড় অফিসার ভাই; নামটা যে মনে রেখেছ এটাই খুব!'
'ওসব থাক_এখন কী ব্যাপার বল।'
'ইয়ে, একটু দরকার ছিল। একবার দেখা হয়?'
'কবে?'
'তুমি যখন বলবে। তবে যদি তাড়াতাড়ি হয় তাহলে...'
'তাহলে আজই করো। আমার ফিরতে ফিরতে ছয়টা হয়। সাতটা নাগাদ আসতে পারবে?'
'নিশ্চয়ই পারব। থ্যাঙ্ক ইউ ভাই। তখন কথা হবে।'
হালে কেনা হালকা নীল স্ট্যান্ডার্ড গাড়িতে আপিস যাবার পথে মোহিত সরকার ইস্কুলের ঘটনা কিছু মনে আনার চেষ্টা করলেন। হেডমাস্টার গিরীন সুরের ঘোলাটে চাহনি আর গুরুগম্ভীর মেজাজ সত্ত্বেও স্কুলের দিনগুলি ভারি আনন্দের ছিল। মোহিত নিজেও ভালো ছাত্র ছিলেন। শঙ্কর, মোহিত আর জয়দেব_এই তিনজনের মধ্যেই রেষারেষি ছিল। ফার্স্ট সেকেন্ড থার্ড তিনজনে যেন পালা করে হতো। ক্লাস সিঙ্ থেকে মোহিত সরকার আর জয়দেব বোস একসঙ্গে পড়েছেন। অনেক সময় এক বেঞ্চিতেই পাশাপাশি বসতেন দুজন। ফুটবলেও পাশাপাশি স্থান ছিল দুজনের; মোহিত খেলতেন রাইট-ইন, জয়দেব রাইট-আউট; তখন মোহিতের মনে হতো এই বন্ধুত্ব বুঝি চিরকালের। কিন্তু ইস্কুল ছাড়ার পরেই দুজনের রাস্তা আলাদা হয়ে গেল। মোহিতের বাবা ছিলেন অবস্থাপন্ন লোক, কলকাতার নামকরা ব্যারিস্টার। ইস্কুল শেষ করে মোহিত ভালো কলেজে ঢুকে ভালো পাস করে দু'বছরের মধ্যেই ভালো সদাগরী আপিসে চাকরি পেয়ে যায়। জয়দেব চলে যায় অন্য শহরের অন্য কলেজে, কারণ তার বাবার ছিল বদলির চাকরি। তারপর আশ্চর্য ব্যাপার, মোহিত দেখেন যে তিনি আর জয়দেবের অভাব বোধ করছেন না; তার জায়গায় নতুন বন্ধু জুটেছে কলেজে। তারপর সেই বন্ধু বদলে গেল যখন ছাত্রজীবন শেষ করে মোহিত চাকরির জীবনে প্রবেশ করলেন। এখন তিনি তাঁর আপিসের চারজন মাথার মধ্যে একজন; এবং তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হলো তাঁরই একজন সহকর্মী। স্কুলের সহপাঠীদের মধ্যে একমাত্র প্রজ্ঞান সেনগুপ্তের সঙ্গে মাঝে মাঝে ক্লাবে দেখা হয়; সেও ভালো আপিসে বড় কাজ করে। আশ্চর্য, ইস্কুলের স্মৃতির মধ্যে কিন্তু প্রজ্ঞানের কোনো স্থান নেই। অথচ জয়দেব_যার সঙ্গে ত্রিশ বছর দেখাই হয়নি_স্মৃতির অনেকটা জায়গা দখল করে আছে। এই সত্যটা মোহিত পুরনো কথা ভাবতে ভাবতে বেশ ভালো করে বুঝতে পারলেন।
মোহিতের অফিসটা সেন্ট্রাল এভিনিউতে। চৌরঙ্গী আর সুরেন ব্যানার্জির সংযোগস্থলের কাছাকাছি আসতেই গাড়ির ভিড়, মোটরের হর্ন আর বাসের ধোঁয়া মোহিত সরকারকে স্মৃতির জগৎ থেকে হুড়মুড়িয়ে বাস্তব জগতে এনে ফেলল। হাতের ঘড়িটার দিকে চোখ পড়াতে মোহিত বুঝলেন যে তিনি আজ মিনিট তিনেক লেট হবেন।
অফিসের কাজ সেরে সন্ধ্যায় তাঁর লি রোডের বাড়িতে যখন ফিরলেন মোহিত, তখন তাঁর মনে বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলের স্মৃতির কণামাত্র অবশিষ্ট নেই। সত্যি বলতে কী, তিনি সকালের টেলিফোনের কথাটাও বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন; সেটা মনে পড়ল যখন বেয়ারা বিপিন বৈঠকখানায় এসে তাঁর হাতে রুলটানা খাতার পাতা ভাঁজ করে ছেঁড়া একটা চিরকুট দিল। তাতে ইংরেজিতে লেখা_'জয়দেব বোস, অ্যাজ পার অ্যাপয়েন্টমেন্ট'।
রেডিওতে বিবিসির খবরটা বন্ধ করে মোহিত বিপিনকে বললেন, 'ভেতরে আসতে বল'_আর বলেই মনে হলো, জয় এতকাল পরে আসছে, তার জন্য কিছু খাবার আনিয়ে রাখা উচিত ছিল। আপিস-ফেরতা পার্ক স্ট্রিট থেকে কেক-পেস্ট্রিজাতীয় কিছু কিনে আনা তাঁর পক্ষে খুবই সহজ ছিল, কিন্তু খেয়াল হয়নি। তাঁর স্ত্রী কি আর নিজে খেয়াল করে এ কাজটা করেছেন?
'চিনতে পারছ?'
গলার স্বর শুনে, আর সেই সঙ্গে কণ্ঠস্বরের অধিকারীর দিকে চেয়ে মোহিত সরকারের যে প্রতিক্রিয়াটা হলো সেটা সিঁড়ি উঠতে গিয়ে শেষ ধাপ পেরোনোর পরেও আরেক ধাপ আছে মনে করে পা ফেললে হয়।
চৌকাঠ পেরিয়ে যিনি ঘরের ভেতর এসে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁর পরনে ছাই রঙের বেখাপ্পা ঢলঢলে সুতির প্যান্টের ওপর হাতকাটা সস্তা ছিটের শার্ট দুটির কোনোটিও কস্মিনকালে ইস্তিরির সংস্পর্শে এসেছে বলে মনে হয় না। শার্টের কলারের ভিতর দিয়ে যে মুখটি বেরিয়ে আছে তার সঙ্গে অনেক চেষ্টা করেও মোহিত তাঁর স্মৃতির জয়দেবের সঙ্গে কোনো সাদৃশ্য খুঁজে পেলেন না। আগন্তুকের চোখ কোটরে বসা, গায়ের রঙ রোদে পুড়ে ঝামা, গাল তোবড়ানো, থুতনিতে অন্তত তিন দিনের কাঁচা-পাকা দাড়ি, মাথার উপরাংশ মসৃণ, কানের পাশে কয়েক গাছা অবিন্যস্ত পাকা চুল। প্রশ্নটা হাসিমুখে করায় ভদ্রলোকের দাঁতের পাটিও দেখতে পেরেছেন মোহিত সরকার, এবং মনে হয়েছে পান-খাওয়া ক্ষয়ে-যাওয়া অমন দাঁত নিয়ে হাসতে হলে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে হাসা উচিত।
'অনেক বদলে গেছি, না?'
'বোসো।'
মোহিত এতক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছেন। সামনের সোফায় আগন্তুক বসার পর মোহিতও তাঁর নিজের জায়গায় বসলেন। মোহিতের নিজের ছাত্রজীবনের কয়েকটা ছবি তাঁর অ্যালবামে আছে; সেই ছবিতে চোদ্দ বছর বয়সের মোহিতের সঙ্গে আজকের মোহিতের আদল বার করতে অসুবিধা হয় না। তাহলে এঁকে চেনা এত কঠিন হচ্ছে কেন? ত্রিশ বছরে একজনের চেহারায় এত পরিবর্তন হয় কি?
'তোমাকে কিন্তু বেশ চেনা যায়। রাস্তায় দেখলেও চিনতে পারতাম'_ভদ্রলোক কথা বলে চলেছেন_'আসলে আমার ওপর দিয়ে অনেক ঝড় বয়ে গেছে। কলেজে পড়তে পড়তে বাবা মারা গেলেন, আমি পড়া ছেড়ে চাকরির ধান্দায় ঘুরতে শুরু করি। তারপর, ব্যাপার তো বোঝই। কপাল আর ব্যাকিং এ দুটোই যদি না থাকে, তাহলে আজকের দিনে একজন ইয়ের পক্ষে...'
'চা খাবে?'
'চা? হ্যাঁ, তা....
মোহিত বিপিনকে ডেকে চা আনতে বললেন, আর সেই সঙ্গে এই ভেবে আশ্বস্ত হলেন যে কেক মিষ্টি যদি নাও থাকে, তাহলেও ক্ষতি নেই; এনার পক্ষে বিস্কুটই যথেষ্ট।
'ওঃ।' _ভদ্রলোক বলে চলেছেন, 'আজ সারা দিন ধরে কত পুরনো কথাই না ভেবেছি, জান মোহিত!'
মোহিত নিজেরও যে কিছুটা সময় তাই করেছেন সেটা আর বললেন না।
'এল সি এম, জি সি এম-কে মনে আছে?'
মোহিতের মনে ছিল না, কিন্তু বলতেই মনে পড়ল। এল সি এম হলেন পি-টির মাস্টার লালচাঁদ মুখুজ্যে। আর জি সি এম হলেন অঙ্কের স্যার গোপেন মিত্তির।
'আমাদের খাবার জলের ট্যাঙ্কের পেছনটায় দুজনকে জোর করে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে কে বঙ্ ক্যামেরায় ছবি তুলেছিল মনে আছে?'
ঠোঁটের কোণে একটা হাল্কা হাসি এনে মোহিত বুঝিয়ে দিলেন যে তাঁর মনে আছে। আশ্চর্য, এগুলো তো সবই সত্যি কথা। ইনি যদি জয়দেব না হন, তাহলে এত কথা জানলেন কী করে?'
'স্কুল লাইফের পাঁচটা বছরই আমার জীবনের বেস্ট টাইম, জান ভাই,' বললেন আগন্তুক, 'তেমন দিন আর আসবে না।'
মোহিত একটা কথা না বলে পারলেন না।
'তোমার তো মোটামুটি আমারই বয়স ছিল বলে মনে পড়ে'_
'তোমার চেয়ে তিন মাসের ছোট।'
'_তাহলে এমন বুড়োলে কী করে? চুলের দশা এমন হলো কী করে?'
'স্ট্রাগ্ল, ভাই স্ট্রাগল,' বললেন আগন্তুক। 'অবিশ্যি টাকটা আমাদের ফ্যামিলির অনেকেরই আছে। বাপ-ঠাকুরদা দুজনেরই টাক পড়ে যায় পঁয়ত্রিশের মধ্যে! গাল ভেঙেছে হাড়ভাড়া খাটুনির জন্য, আর প্রপার ডায়েটের অভাবে। তোমাদের মতো তো টেবিল-চেয়ারে বসে কাজ নয় ভাই। কারখানায় কাজ করেছি সাত বছর, তারপর মেডিক্যাল সেলসম্যান, ইনশিওরেন্সের দালালি, এ দালালি, সে দালালি! এক কাজে টিকে থাকব সে তো আর কপালে লেখা নেই। তাঁতের মাকুর মতো একবার এদিক একবার ওদিক। কথায় বলে_শরীরের নাম মহাশয়, যা সওয়াবে তাই সয়_অথচ তাতে শেষ অবধি শরীরটা গিয়ে কী দাঁড়ায় তা তো আর বলে না। সেটা আমায় দেখে বুঝতে হবে।'
বিপিন চা এনে দিল। সঙ্গে প্লেটে সন্দেশ আর শিঙাড়া। গিনি্নর খেয়াল আছে বলতে হবে। ক্লাস ফ্রেন্ডের এই ছিরি দেখলে কী ভাবতেন সেটা মোহিত আন্দাজ করতে পারলেন না।
'তুমি খাবে না?' আগন্তুক প্রশ্ন করলেন। মোহিত মাথা নাড়লেন।_'আমি এইমাত্র খেয়েছি।'
'একটা সন্দেশ?'
'নাঃ, আপ_তুমিই খাও।'
ভদ্রলোক শিঙাড়ায় কামড় দিয়ে চিবোতে চিবোতেই বললেন, 'ছেলেটার পরীক্ষা সামনে। অথচ এমন দশা, জানো মোহিত ভাই, ফির টাকাটা যে কোত্থেকে আসবে, তা তো বুঝতে পারছি না।'
আর বলতে হবে না। মোহিত বুঝে নিয়েছেন। আগেই বোঝা উচিত ছিল এঁর আসার কারণটা। সাহায্য প্রার্থনা। আর্থিক সাহায্য। কত চাইবেন? বিশ-পঁচিশ হলে দিয়ে দেওয়াই হবে বুদ্ধিমানের কাজ, কারণ না দিলেই যে উৎপাতের শেষ হবে এমন কোনো ভরসা নেই।
'আমার ছেলেটা খুব ব্রাইট, জানো ভাই। পয়সার অভাবে তার পড়াশোনা মাঝপথে বন্ধ হয়ে যেতে পারে, এ কথাটা ভেবে আমার রাতে ঘুম হয় না।'
দ্বিতীয় শিঙাড়াটাও উঠে গেল প্লেট থেকে। মোহিত সুযোগ পেলেই জয়দেবের সেই ছেলে বয়সের চেহারাটার সঙ্গে আগন্তুকের চেহারা মিলিয়ে দেখছেন, আর ক্রমেই তাঁর বিশ্বাস বদ্ধমূল হচ্ছে যে সেই বালকের সঙ্গে এই প্রৌঢ়ের কোনো সাদৃশ্য নেই।
'তাই বলছিলাম, ভাই', চায়ে সশব্দ চুমুক দিয়ে বললেন আগন্তুক, 'অন্তত শ'খানেক কি শ' দেড়েক যদি এই পুরনো বন্ধুর হাত তুলে দিতে পারো, তাহলে_'
'ভেরি স্যরি।'
'অ্যাঁ?'
টাকার কথাটা উঠলেই সরাসরি না করে দেবেন এটা মোহিত মনে মনে স্থির করে ফেলেছিলেন। কিন্তু এখন মনে হলো ব্যাপারটা এতটা রূঢ়ভাবে না করলেও চলত। তাই নিজেকে খানিকটা শুধরে নিয়ে গলাটাকে আরেকটু নরম করে বললেন, 'স্যরি ভাই। আমার কাছে জাস্ট নাউ ক্যাশের একটু অভাব।'
'আমি কাল আসতে পারি। এনি টাইম। তুমি যখনই বলবে।'
'কাল আমি একটু কলকাতার বাইরে যাব। ফিরব দিন তিনেক পরে। তুমি রোববার এসো।'
'রবিবার...'
আগন্তুক যেন খানিকটা চুপসে গেলেন। মোহিত মনস্থির করে ফেলেছেন। ইনিই যে জয়, চেহারায় তার কোনো প্রমাণ নেই। কলকাতার মানুষ ধাপ্পা দিয়ে টাকা রোজগারের হাজার ফিকির জানে। ইনি যদি জালিয়াত হন? হয়তো আসল জয়দেবকে চেনেন। তার কাছ থেকে ত্রিশ বছর আগের বালিগঞ্জ স্কুলের কয়েকটা ঘটনা জেনে নেওয়া আর এমন কী কঠিন কাজ?
'রবিবার কখন আসব?' আগন্তুক প্রশ্ন করলেন।
'সকালের দিকেই ভালো। এই নটা সাড়ে নটা।'
শুক্রবার ঈদের ছুটি। মোহিতের আগে থেকেই ঠিক আছে বারুইপুরে এক বন্ধুর বাগানবাড়িতে সস্ত্রীক গিয়ে উইক-এন্ড কাটিয়ে আসবেন। দুদিন থেকে রবিবার রাতে ফেরা; সুতরাং ভদ্রলোক সকালে এলে তাঁকে পাবেন না। এই প্রতারণাটুকুরও প্রয়োজন হতো না যদি মোহিত সোজাসুজি মুখের ওপর না করে দিতেন। কিন্তু কিছু লোক আছে যাদের দ্বারা এ জিনিসটা হয় না। মোহিত এই দলেই পড়েন। রবিবার তাঁকে না পেয়ে যদি আবার আসেন ভদ্রলোক, তাহলে তাঁর সঙ্গে দেখা না করার কোনো অজুহাত বার করবেন মোহিত সরকার। তারপর হয়তো আর বিরক্ত হতে হবে না।
আগন্তুক চায়ের কাপে শেষ চুকুম দিয়ে সেটা নামিয়ে রাখতেই ঘরে আরেকজন পুরুষ এসে ঢুকলেন। ইনি মোহিতের অন্তরঙ্গ বন্ধু বাণীকান্ত সেন। আরো দুজন আসার কথা আছে, তারপর তাসের আড্ডা বসবে। এটা রোজকার ঘটনা। বাণীকান্ত ঘরে ঢুকেই যে আগন্তুকের দিকে একটা সন্দিগ্ধ দৃষ্টি দিলেন সেটা মোহিতের দৃষ্টি এড়াল না। আগন্তুকের সঙ্গে বন্ধুর পরিচয়ের ব্যাপারটা মোহিত অম্লান বদনে এড়িয়ে গেলেন।
'আচ্ছা, তাহলে আসি...' আগন্তুক উঠে দাঁড়িয়েছেন। 'তুই এই উপকারটা করলে সত্যিই গ্রেটফুল থাকব ভাই, সত্যিই।'
ভদ্রলোক বেরিয়ে যাবার পর মুহূর্তেই বাণীকান্ত বন্ধুর দিকে ফিরে ভ্রুকুঞ্চিত করে বললেন, 'এই লোক তোমাকে তুই করে বলছে_ ব্যাপারটা কী?'
'এতক্ষণ তুমি বলছিল, শেষে তোমাকে শুনিয়ে হঠাৎ তুই বলল।'
'লোকটা কে?'
মোহিত উত্তর না দিয়ে বুকশেল্ফ থেকে একটা পুরনো ফোটো অ্যালবাম বার করে তার একটা পাতা খুলে বাণীকান্তর দিকে এগিয়ে দিল।
'একি তোমার ইস্কুলের গ্রুপ নাকি?'
'বোট্যানিক্সে পিকনিকে গিয়েছিলাম,' বললেন মোহিত সরকার।
'কারা এই পাঁচজন?'
'আমাকে চিনতে পারছ না?'
'দাঁড়াও, দেখি।'
অ্যালবামের পাতাটাকে চোখের কাছে নিয়ে বাণীকান্ত সহজেই তাঁর বন্ধুকে চিনে ফেললেন।
'এবার আমার ডানপাশের ছেলেটিকে দেখ তো ভালো করে।'
ছবিটাকে আরো চোখের কাছে এনে বাণীকান্ত বললেন, 'দেখলাম।'
মোহিত বললেন, 'ইনি হচ্ছেন যিনি এইমাত্র উঠে গেলেন।'
'ইস্কুল থেকেই কি জুয়া ধরেছিলেন নাকি?'_অ্যালবামটা সশব্দে বন্ধ করে পাশের সোফায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে প্রশ্ন করলেন বাণীকান্ত। _'ভদ্রলোককে অন্তত বত্রিশবার দেখেছি রেসের মাঠে।'
'সেটাই স্বাভাবিক', বললেন মোহিত সরকার। তারপর আগন্তুকের সঙ্গে কী কথা হলো সেটা সংক্ষেপে বললেন।
'পুলিশে খবর দে', বললেন বাণীকান্ত, 'চোর জোচ্চোর জালিয়াতের ডিপো হয়েছে কলকাতা শহর। এই ছবির ছেলে আর ওই জুয়াড়ি এক লোক হওয়া ইম্পসিবল।'
মোহিত হালকা হাসি হেসে বললেন, 'রোববার এসে আমাকে না পেলেই ব্যাপারটা বুঝবে। তারপর আর উৎপাত করবে বলে মনে হয় না।'
বারুইপুরে বন্ধুর পুকুরের মাছ, পোলট্রির মুরগির ডিম, আর গাছের আম জাম ডাব পেয়ারা খেয়ে, বুকল গাছের ছায়ায় সতরঞ্চি পেতে বুকে বালিশ নিয়ে তাস খেলে শরীর ও মনের অবসাদ দূর করে রবিবার রাত এগারোটায় বাড়ি ফিরে মোহিত সরকার বিপিন বেয়ারার কাছে শুনছেন যে সেদিন যে ভদ্রলোকটি এসেছিলেন তিনি আজ সকালে আবার এসেছিলেন।_'যাবার সময় কিছু বলে গেছেন কি?'
'আজ্ঞে না,' বলল বিপিন।
যাক্, নিশ্চিন্ত! একটা সামান্য কৌশল, কিন্তু তাতে কাজ দিয়েছে অনেক। আর আসবে না। আপদ গেছে।
কিন্তু না। আপদ সেদিনের জন্য গেলেও পরের দিন সকাল আটটা নাগাদ মোহিত যখন বৈঠকখানায় বসে খবরের কাগজ পড়ছেন, তখন বিপিন আবার একটি ভাঁজ করা চিরকুট এনে দিল তাঁকে। মোহিত খুলে দেখলেন তিন লাইনের একটি চিঠি।
ভাই মোহিত,
আমার ডান পা-টা মচকেছে, তাই ছেলেকে পাঠাচ্ছি। সাহায্যস্বরূপ সামান্য কিছুও এর হাতে দিলে অশেষ উপকার হবে। আশা করি হতাশ করবে না।_
ইতি জয়
মোহিত বুঝলেন এবার আর রেহাই নেই। তবে সামান্য মানে সামান্যই, এই স্থির করে তিনি বেয়ারাকে বললেন, 'ডাক ছেলেটিকে।'
মিনিট খানেকের মধ্যেই একটি তেরো-চোদ্দ বছর বয়সের ছেলে দরজা দিয়ে ঢুকে মোহিতের দিকে এগিয়ে এসে তাঁকে প্রণাম করে আবার কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
মোহিত তার দিকে মিনিট খানেক চেয়ে থাকলেন। তারপর বললেন, 'বোস।'
ছেলেটি একটু ইতস্তত ভাব করে একটি সোফার এক কোণে হাত দুটোকে কোলের ওপর জড়ো করে বসল।
'আমি আসছি এক্ষুনি।'
মোহিত দোতলায় গিয়ে স্ত্রীর আঁচল থেকে চাবির গোছাটা খুলে নিয়ে আলমারি খুলে দেরাজ থেকে চারটে পঞ্চাশ টাকার নোট বার করে একটা খামে পুরে আলমারি বন্ধ করে আবার নিচের বৈঠকখানায় ফিরে এলেন।
'কী নাম তোমার?'
'শ্রী সঞ্জয়কুমার বোস।'
'এতে টাকা আছে। সাবধানে নিতে পারবে?'
ছেলেটি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।
'কোথায় নেবে?'
'বুক পকেটে।'
'ট্রামে ফিরবে, না বাসে?'
'হেঁটে।'
'হেঁটে? কোথায় বাড়ি তোমার?'
'মির্জাপুর স্ট্রিট।'
'এত দূর হাঁটবে?'
'বাবা বলেছেন হেঁটে ফিরতে।'
'তার চেয়ে এক কাজ করো। ঘণ্টাখানেক বোস, চা-মিষ্টি খাও, অনেক বইটই আছে, দেখো_আমি নটায় অফিসে যাব, আমায় নামিয়ে দিয়ে আমার গাড়ি তোমার বাড়ি পেঁৗছে দেবে। তুমি বাড়ি চিনিয়ে দিতে পারবে তো?'
ছেলেটি আবার মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।
মোহিত বিপিনকে ডেকে ছেলেটির জন্য চা দিতে বলে আপিসে যাবার জন্য তৈরি হতে দোতলায় রওনা হলেন।
ভারি হালকা বোধ করছেন তিনি, ভারি প্রসন্ন।
জয়কে দেখে না চিনলেও তিনি তার ছেলে সঞ্জয়ের মধ্যে তাঁর ত্রিশ বছর আগের ক্লাস ফ্রেন্ডটিকে ফিরে পেয়েছেন।
  কোথায় পাব তারেশহীদুল জহির 
অঙ্কন : সুমন
¦

কোথায় পাব তারে
কোথায় পাব তারেশহীদুল জহির
দক্ষিণ মৈশুন্দি, ভূতের গলির লোকেরা পুনরায় এক জটিলতার ভিতর পড়ে এবং জোড়পুল ও পদ্মনিধি লেনের, ওয়ারি ও বনগ্রামের, নারিন্দা ও দয়াগঞ্জের লোকেরা তাদের এই সঙ্কটের কথা শুনতে পায়; তারা, ভূতের গলির লোকেরা বলে :
আমরা পুনরায় আব্দুল করিমের কথায় ফিরে যেতে চাই, কারণ কয়েকদিন থেকে আমরা মহল্লায় শুনতে পাচ্ছিলাম যে, সে ময়মনসিং যাচ্ছে; কিন্তু আমরা তার এই কথাকে গুরুত্ব না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিই। তখন একদিন বৃহস্পতিবার বিকালে আমাদের মহল্লা, ভূতের গলির ৬৪ নম্বর বাড়ির মালিক আব্দুল আজিজ ব্যাপারি ঠোঙ্গায় করে গরম ডালপুরি কিনে ফেরার পথে আব্দুল করিমের সঙ্গে তার দেখা হয় এবং সে বলে আহো মিঞা, ডাইলপুরি খায়া যাও।
আব্দুল করিমের হঠাৎ করে ডালপুরি খাওয়ার দাওয়াত গ্রহণ করতে লজ্জা লাগে এবং সে বলে যে, ডালপুরি খেলে তার বুক জ্বালা করে; কিন্তু আব্দুল আজিজ ব্যাপারি তার কথায় পাত্তা না দিয়ে বলে, আহো আহো, মজার জিনিস, তুমিতো খালি নিজেরে লয়া থাক!
তখন আব্দুল করিমকে মেনে নিতে হয়, সে আজিজ ব্যাপারির ঘরের ভিতরে ঢুকে ঘনায়মান অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে ডালপুরি খায় এবং বলে, ডাইলপুরির মইদ্দে ডাইল নাইকা, হুদা আলু!
আঃআঃব্যাপারি : হঁ। ডাইলের দাম বাইড়া যাইতাছে কেমুন, দেখ না!
আঃকঃ : আপনের লাইগা ডাইল লয়া আমুনে।
আঃআঃব্যাপারি : কইত্থন?
আঃকঃ : আমি মৈমনসিং যাইতাছি বেড়াইতে।
তারপর আব্দুল আজিজ ব্যাপারি যখন জিজ্ঞেস করে, ময়মনসিং তার কী কাজ, সে বলে যে, সে আসলে আকুয়া যাচ্ছে; এবং আব্দুল আজিজ ব্যাপারি যখন আকুয়া কোথায় তা বুঝতে পারে না, সে বলে যে, সে আসলে ফুলবাড়িয়া যাবে। তখন আব্দুল আজিজ ব্যাপারি যখন ফুলবাড়িয়া কোথায় তাও বুঝতে ব্যর্থ হয়, সে বলে যে, ময়মনসিংয়ের কাছেই একটা জায়গার নাম আকুয়া এবং আকুয়ার কাছেই ফুলবাড়িয়া। এই কথা শুনে আব্দুল আজিজ ব্যাপারি তাকে আর একটা ডালপুরি অথবা আলুপুরি দেয়, আব্দুল করিম দ্বিতীয় পুরিটা খায়, খেতে খেতে সে পুনরায় বলে, এই হালারা আলু দিয়া ডাইলপুরি বানায়, ডাইলের দাম বাইড়া যাইতাছে, আপনের লাইগা আমি ডাইল লয়া আমুনে।
আঃআঃব্যাপারি : মৈমনসিংথন?
আঃকঃ : হঁ, ক্যালা!
আঃআঃব্যাপারি : মৈমনসিং তুমার কী কাম?
আঃকঃ : আমার বন্দু আছে, বেড়াইবার যামু।
আঃআঃব্যাপারি : তুমার বন্দু মৈমনসিং!
আঃকঃ : ক্যালা, থাকা পারে না?
আব্দুল করিম তখন অবধারিত চক্করের মধ্যে পড়ে যায়, আব্দুল আজিজ ব্যাপারি তাকে ছাড়ে না, সে তার হাতে ঠোঙ্গার শেষ পুরিটা তুলে দিয়ে বলে, কওতো ব্যাপারটা কী?
আঃকঃ : না, এমনেই। আমারে কইলো আমাগো বাইতে বেড়াইতে যাইয়েন; ভাবলাম কইছে যখন বেড়ায়া আহি গা।
আঃআঃব্যাপারি : মৈমনসিং তুমি বন্দু পাইলা কই?
আঃকঃ : পাইলাম, একদিন মহাখালী বাসস্ট্যান্ডে গেছিলাম, বাসস্ট্যান্ডে কথা হইলো, কইলো, মৈমনসিং বেড়াইতে আইসেন।
আমরা মহল্লার লোকেরা, সেদিন রাতে আমাদের দিবসে কর্ম শেষে ক্লান্ত-অবসরে আব্দুল করিমের ময়মনসিং যাওয়ার সর্বশেষ খবর শুনি এবং বলি, পোলাটা হালার ভোদাই, এবং আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, খোরশেদ আলমের এই বেকার ছেলেটার মানুষ হতে পারার আর সম্ভাবনা নাই। পরদিন শুক্রবার জুম্মা নামাজের পর মহল্লায় আলি আকবরের সঙ্গে তার কথা হয় এবং আমরা তা জানতে পারি; আলি আকবর রহমতগঞ্জে আড়ৎদারি করে, জুম্মা নামাজ শেষে বাসায় ফেরার সময় পথে আব্দুল করিমের সঙ্গে তার দেখা হয়, এবং সে বলে, কি মিঞা আব্দুল করিম, তুমি নিহি মৈমনসিং যাইতাছ?
আঃকঃ : হঁ, চাচা_আস সালামালেকুম।
আঃআঃ : ক্যালা, কী কাম তুমার মৈমনসিং, ধান্ধা কী?
আঃকঃ : না, এমনেই, কুনো কাম নাই, মনে করলাম ঘুইরা আহি।
আঃআঃ : হুদাহুদি ঘুরবার যাইবা!
আঃকঃ : হঁ। আপনে এইবার কী রাকবেন?
আঃআঃ : কী রাখুম?
আঃকঃ : না, কইতাছি আড়তে এইবার কী বান্ধাই করবেন?
আলি আকবরের মেজাজ খারাপ হয়, সে বলে যে, তার আড়তের কারবারে গণ্ডায় গণ্ডায় জিনিস বান্ধাই করা থাকে, এবং তখন আব্দুল করিম তাকে আখের গুড় বাঁধাই করার পরামর্শ দেয়। সে বলে, গুড় বান্ধাই করেন, আমি ফুলবাইড়া যাইতাছি, আপনের লাইগা আউখা গুড় লয়া আমুনে।
আঃআঃ : তুমি না কইলা মৈমনসিং যাইতাছ?
আঃকঃ : হঁ, মৈমনসিংথন যামু আকুয়া, আকুয়াত্থন ফুলবাইড়া। ফুলবাইড়ায় ভাল গেণ্ডারি হয়, গেণ্ডারিত্থন ভাল আউখা গুড় হয়; আপনের লাইগা গুড় লয়া আমুনে।
আমাদের মনে হয় যে, আইএ পাস বেকার এবং অলসের রাজা আব্দুল করিম আসলে মহল্লার লোকের সঙ্গে খেলা করে, সে তার পিতার ক্রমাগত অভিযোগ এবং গালমন্দের মুখে দিশাহারা হয়ে এই কায়দা বের করে; তার এই সব কথার কোন মানে নাই, সে জীবনে কোথাও যায় নাই এবং যাবে না। তখন আর এক বৃহস্পতিবারে সে পুনরায় আব্দুল আজিজ ব্যাপারির দেখা পায়। আব্দুল আজিজ ব্যাপারি সন্ধ্যায় পুনরায় ডালপুরি কিনে বাড়ি ফেরার সময় আব্দুল করিমকে দেখে।
আঃআঃব্যাপারি : কি তুমি অখনতরি মহল্লায় আছ?
আঃকঃ : থাকুম না ক্যালা!
আঃআঃব্যাপারি : তুমি না মৈমনসিং যাও!
আঃকঃ : যামু।
আঃআঃব্যাপারি : আমার লাইগা ডাইল আনবা?
আঃকঃ : আপনি কইলে আনুমনে।
আঃআঃব্যাপারি : আমিতো মিঞা আড়ৎদারি করি না, দুকানদারি করি।
আঃকঃ : আড়ৎদারিকরণ লাগে নিহি? খাটের নিচে ফালায়া থুইবেন, পরে বেচবেন।
তখন আব্দুল আজিজ ব্যাপারি তাকে ডালপুরি খেয়ে যাওয়ার কথা বলে, কিন্তু আব্দুল করিমের পুনরায় লজ্জা করে এবং আব্দুল আজিজ ব্যাপারি সাধে, আহো আহো আলুপুরি হইলেও খাইতে ভাল। আব্দুল করিম তখন আব্দুল আজিজ ব্যাপারির বাসায় ঢুকে প্লাস্টিকের বেতের চেয়ারে বসে আলুপুরি খায় এবং কথা বলে।
আঃকঃ : আপনে কইলে আপনেরে ডাইল আইনা দিবার পারি, আমিতো যামুই বেড়াইবার লাইগা, আহনের সুময় লয়া আমুনে দুই/চাইর মণ।
আঃআঃব্যাপারি : তুমার বাপেরে কও না ক্যালা?
আঃকঃ : লাভ নাইকা।
আঃআঃব্যাপারি : ক্যালা?
আঃকঃ : মিল খায় না।
মহল্লায় তারপরেও আমাদের মনে হয় যে, আব্দুল করিম আসলে বদমায়েশি করছে; সে শেষ পর্যন্ত কাউকে ঠকাবে কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিতভাবে বলতে না পারলেও আমাদের মনে হয় যে, তার আচরণের ভেতর চালাকি আছে এবং আব্দুল আজিজ ব্যাপারি যখন তার পিতার প্রসঙ্গ উত্থাপন করে তখন চালাকির বিষয়টা মনে হয় পরিষ্কার হয়ে যায়, তার তখন আসলে জবাব দেয়ার মত কিছু থাকে না। কিন্তু তারপরেও আমরা সম্ভবত নিশ্চিত হতে পারি না, কারণ পরবর্তী শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর রায়সা বাজারের হোটেল মালিক বাবুল মিঞার সঙ্গে তার কথা হয়, বাবুল মিঞাই তার সঙ্গে প্রথম কথা বলে ফাঁদে পড়ে। বাবুল মিঞা যখন তার ময়মনসিং যাওয়ার কথা জানতে চায়, সে বলে যে, সে দুই/চার দিনের মধ্যেই যাবে এবং তারপর আব্দুল করিম পুরাতন প্রসঙ্গে আসে।
আঃকঃ : হুনলাম ডাইলের দাম নিকি বাইড়া গেছে, আপনেরা অখনে আলু দিয়া ডাইলপুরি বানান!
বাঃমিঞা : হঁ, আলু দিয়াই বানাই, কিন্তু আলুর দামওতো হালায় কম না!
আঃকঃ : আমিতো মৈমনসিং যাইতাছি, আপনি কইলে আপনের লাইগা আলু লইয়া আমুনে দুই/চাইর/দছ মণ।
বাঃমিঞা : আরে না, এত আলু দিয়া কী করুম!
আঃকঃ : ক্যালা, আপনের হোটেলে আলু লাগে না?
বাঃমিঞা : লাগে, আমিতো পাইকারি কিনি পড়তা পইড়া যায়।
আঃকঃ : কিন্তু আমি ফুলবাইড়া যাইতাছি, ওইখানে ভাল আলু হয়, আপনে কইলে আপনের লাইগা আমি আদ্দেক দামে আলু আইনা দিমুনে।
তখন এই চাপের মুখে বাবুল মিঞা তার কৌশল বদল করে।
বাঃমিঞা : তুমি মৈমনসিং যাইতাছ ক্যালা?
আঃকঃ : কাম নাই, বয়া রইছি, ভাবলাম ঘুইরা আহি।
বাঃমিঞা : কাম নাই! বাপের লগে দুকানে বহ না ক্যালা?
আঃকঃ : নাটবল্টুর দুকানদারি করুম না। আমি অন্য ব্যবসা করবার চাই, কিন্তু আব্বায় রাজি না।
আমরা যখন বাবুল মিঞার সঙ্গে আব্দুল করিমের এই আলাপচারিতার কথা শুনি আমাদের এই প্রথমবারের মত মনে হয় যে, আব্দুল করিম হয়তো এক ধরনের জীবিকার কথা ভাবছে; আমরা অবশ্য একেবারে নিশ্চিত হতে পারি না, কারণ, খামখেয়ালি ও অকর্মণ্য আব্দুল করিমের কিছু করতে পারার বিষয় আমাদের একেবারেই বিশ্বাস হতে চায় না। এবং দশ/পনেরো/বিশ দিন পরেও আমরা যখন তাকে মহল্লায় দেখি আমাদের পুনরায় মনে হয় যে, এটা তার এক ধরনের খেলাই; অথবা হয়তো সে এই সবকিছুর দ্বারা তার পিতাকেও বোঝানোর চেষ্টা করে যে, সে নিষ্কর্মা হয়ে থাকতে চায় না। কিন্তু তার ময়মনসিং যাওয়ার খবর আসে না, সে মহল্লাতেই থেকে যায়; আমাদের মনে হয় যে, হয়তো আব্দুল আজিজ ব্যাপারি ডাল কিনতে না চাওয়ায় এবং আলি আকবর আখের গুড় কিনতে না চাওয়ায় অথবা বাবুল মিঞা আলু কিনতে না চাওয়ায় তার ময়মনসিং যাওয়া হয় না। তখন ৬৪ নম্বর বাড়ির আব্দুল আজিজ ব্যাপারির সঙ্গে তার পুনরায় দেখা হয় এবং আব্দুল আজিজ ব্যাপারি পুনরায় তাকে ডালপুরি খাওয়ার দাওয়াত দেয়।
আঃকঃ : আপনে এত ডাইলপুরি খান ক্যালা?
আঃআঃব্যাপারি : আর কী খামু? বাপ-দাদায় খায়া গেছে, আমিও খাই!
আঃকঃ : ডাইলপুরির মইদ্দে হুদা আলু, আপনেরে কইলাম ডাইল আইনা দেই!
আঃআঃব্যাপারি : মৈমনসিং থন?
আঃকঃ : হঁ।
আঃআঃব্যাপারি : তুমি যাইবা কবে?
আঃকঃ : যামু, দেখি।
আঃআঃব্যাপারি : কবে?
আঃকঃ : যামু, মনে করছিলাম আপনেগো লাইগা কিছু জিনিসপত্র লয়া আহি, কিন্তু আপনেগোতো দেখি কিছুই দরকার নাইকা!
আমরা পুনরায় এই সকল কথা শুনি এবং বলি, হালার বলদ; কারণ, আমরা জানতে পারি যে, এত কথার পরও আব্দুল আজিজ ব্যাপারি আব্দুল করিমের সঙ্গে ডালের ব্যবসা করতে রাজি হয় না। এভাবে কতদিন কাটে তার হিসাব আমরা ভুলে যাই, কিন্তু আব্দুল করিমের ময়মনসিং এবং ফুলবাড়িয়া যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা নিবৃত হয় না। তখন কোন এক শুক্রবারে আব্দুল আজিজ ব্যাপারি তৃতীয়বারের মত ঠোঙ্গায় করে ডালপুরি নিয়ে ফেরার সময় সন্ধ্যার মুখে আব্দুল করিমের সঙ্গে তার দেখা হয় এবং পুনরায় সে তাকে ডালপুরি খেয়ে যাওয়ার জন্য ডাকে।
আঃআঃব্যাপারি : আহো।
আঃকঃ : আলুপুরি?
আঃআঃব্যাপারি : আহো, খায়া যাও।
তখন আব্দুল আজিজ ব্যাপারি তার ময়মনসিং যাওয়ার প্রসঙ্গ পুনরায় উত্থাপন করে, তুমার মৈমনসিং যাওয়ার কী হইল? আমরা মহল্লায় যখন এই কথা শুনি আমাদের সন্দেহ থাকে না যে, আব্দুল করিম আমাদের সঙ্গে মশকারিই করে এবং আমরা তার পাতা এই ইয়ার্কির ফাঁদে ক্রমাগত ফেঁসে যেতে থাকি; আমাদের মধ্যেও হয়তো ইতিমধ্যে এই খেলার প্রবৃত্তি জেগে উঠেছিল এবং এ রকম মনে হয়েছিল যে, আমাদের উচিত তাকে এখন পালাতে না দিয়ে চেপে ধরা এবং আমাদের সঙ্গে এই সব বাজে রসিকতা করার জন্য উপযুক্ত শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করা। কিন্তু আমাদের জন্য আরও বিস্ময় বাকি ছিল, তৃতীয় দিন আব্দুল করিমের হাতে হলুদ রঙের গরম এবং তেল জবজবে ডাল অথবা আলুপুরি তুলে দেয়ার পর আব্দুল আজিজ ব্যাপারি তাকে যে প্রশ্নটি করে আমরা বুঝে পাই না এই প্রশ্ন তাকে কেন আগে করা হয় নাই, অথবা আমরাও কেন একবারও এই কথাটা ভাবি নাই! তৃতীয়বারের মতো ডালপুরি খাওয়ানোর পর আব্দুল আজিজ ব্যাপারির মাথায় প্রশ্নটি আসে কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর শুনে সে বিমূঢ় হয়ে পড়ে; কারণ, সে যখন বলে, তুমার বন্দুর নাম কি? আব্দুল করিম জানায় যে, তার বন্ধুর নাম, শেফালি।
আঃকঃ : আমি মৈমনসিং এইবার যামু। আপনে চাইলে আপনের লাইগা ডাইল আইনা দিবার পারি।
আঃআঃব্যাপারি : শেপালি কে? শেপালি তুমার বন্দু হইল কেমনে?
আঃকঃ : ক্যালা, হয়া পারে না?
আঃআঃব্যাপারি : অরে পাইলা কই?
আঃকঃ : পাইলাম।
আঃআঃব্যাপারি : কই পাইলা, মহাখালী বাসস্ট্যান্ডে?
আঃকঃ : হঁ।
আঃআঃব্যাপারি : তুমারে কইলো বেড়াইতে যাওনের লাইগা!
আঃকঃ : হঁ।
আঃআঃব্যাপারি : তুমার বাপে তুমার উপরে এ্যার লাইগাই চেতে!
আঃকঃ : ক্যালা?
আঃআঃব্যাপারি : চেনা নাই জানা নাই একটা মাইয়া কইলো বেড়াইতে যাইয়েন, আর তুমি ফাল পাড়তাছ!
আঃকঃ : ক্যালা?
আঃআঃব্যাপারি : তুমি মিঞা আদতেই একটা ভোন্দা, তুমার বাপেরে এইসব কথা কইও না, কইলে তুমারে লৌড়াইবনে!
আমাদেরও মনে হয় যে, আসলেই আব্দুল করিম একটা গাধা! কিন্তু তারপর আমরা আব্দুল আজিজ ব্যাপারির মত পুনরায় বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি, কারণ, আব্দুল করিম এসব কথা এবং তিরস্কার মেনে নিতে রাজি হয় না। আব্দুল আজিজ ব্যাপারির ডাল অথবা আলুপুরি খাওয়ার জন্য সে তার বকাঝকা করতে পারার অধিকার মেনে নেয় না।
আঃকঃ : আমি এই মাসেই যামু, আপনেরা যাই কন।
আঃআঃব্যাপারি : তুমি ক্যালা যাইবা, ওই মাইয়ারে দেখনের লাইগা?
আঃকঃ : হঁ, ক্যালা?
আঃআঃব্যাপারি : তুমি ঢাকার বাইরে গেছ কুনোদিন?
আঃকঃ : হের লাইগা যায়া পারুম না?_অসুবিধা নাইকা, যায়া পারুম, ঠিকানা লেইখা লইছি।
ভূতের গলির লোকদের কাছে তখন আব্দুল করিম এবং তার ময়মনসিং যাওয়ার প্রসঙ্গের চাইতে শেফালি প্রসঙ্গ বড় হয়ে ওঠে, দক্ষিণ মৈশুন্দি এবং ভূতের গলির এই মহল্লার লোকদের দিন উত্তেজনায় ভরে যায়, হালায় প্রেম করে নিহি, তারা বলে। তাদের মনে হয় যে, আব্দুল করিম বেকার বলেই তার পক্ষে এইসব করা সম্ভব; তখন মহল্লার লোকেরা বেকার থেকে প্রেম করাকে ঘৃণা করতে শেখে; তারা ভুলতে পারে না যে, শেফালি একটা মেয়ে এবং আব্দুল করিম বলে যে সে তার বন্ধু! ফলে মহল্লার লোকদের রাতের ঘুম বিঘি্নত হয়, সারাদিনের কর্মক্লান্ত দেহ নিয়ে তারা বিছানায় জেগে থাকে, জীবনের ব্যর্থতা এবং অপচয় বোধ তাদেরকে গ্রাস করতে উদ্যত হয় এবং তারা কেমন বিষণ্ন হয়ে পড়ে; তাদের মনে হয় যে, বেকার থাকাইতো ভাল আব্দুল করিমের মত! আব্দুল করিম তার অলস সময় শুয়ে বসে কাটায় এবং দূরবর্তী শেফালির গল্প করে, তার ময়মনসিং যাওয়ার কোন লক্ষণ দেখা যায় না। আব্দুল আজিজ ব্যাপারি অথবা আলি আকবর অথবা বাবুল মিঞার সঙ্গে তার আবার দেখা হয়, তারা যখন বলে, তুমার যাওয়া হইল না? তখন সে তার এই ব্যর্থতার দায় তাদের ওপর চাপায়, বলে, যামু, কইলাম আপনেগো লাইগা কিছু লয়া আহি, আপনেরাতো রাজি হইলেন না! মহল্লার লোকেরা যখন এই কথা শোনে তারা খুব চমৎকৃত হয়, তারা বলে, খোরশেদ আলমের এই পোলাটা হালায় দেখছনি কেমুন সেয়ানা হয়া উঠছে! তখন একদিন আব্দুল আজিজ ব্যাপারি ডালপুরি কিনে বাড়ি ফেরে, পথে সে আব্দুল করিমকে খোঁজে তাকে চতুর্থ দিনের মত ডালপুরি খাওয়ানোর জন্য, কিন্তু তাকে দেখা যায় না। মহল্লার লোকেরা যখন এই কথা শোনে এবার তারা আব্দুল আজিজ ব্যাপারিকে গাধা বলে গাল দেয়, তারা বলে, এই হালায় ব্যাপারির বাচ্চা খালি ডাইলপুরি খায়, আর এই বেকার বদমাইশ পোলাটারে লয়া নাচে! কিন্তু পরবর্তী সময়ে মহল্লার লোকেরা তাদের মত বদলায় এবং আব্দুল আজিজ ব্যাপারির বুদ্ধিমত্তার বিষয়ে তাদের শ্রদ্ধা ফিরে আসে। কারণ, তারা আব্দুল আজিজ ব্যাপারির ডালপুরি খাওয়ার গল্প বিস্তারিতভাবে জানতে পারে এবং তাদের মনে হয় যে, আব্দুল করিমের চালাকির দিন এবার শেষ হবে। ভূতের গলির লোকেরা জানতে পারে যে, আব্দুল আজিজ ব্যাপারি ডালপুরি খাওয়ার জন্য আব্দুল করিমকে খোঁজে বটে তবে তাদের বাসায় গিয়ে ডেকে বের করে আনে না, তার বদলে সে প্রতীক্ষা করে; মনে হয় যেন আব্দুল আজিজ ব্যাপারি ছিপ ফেলে বসে থাকে, তবে তার প্রতীক্ষার কাল দীর্ঘ হয় না। তিন দিন পর কোন এক বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়, অথবা বুধবারও হতে পারে, সে আব্দুল করিমের দেখা পায় এবং উৎফুল্ল হয়ে ওঠে, কি মিঞা তুমারে দেখি না ক্যালা? তখন আব্দুল আজিজ ব্যাপারির বোধহয় মনে হয় যে, আসল কথায় সরাসরি না গিয়ে একটু সময় নেয়া যাক; ফলে সে আব্দুল করিমকে একটু খেলানোর সিদ্ধান্ত নেয় এবং বলে, তুমি তাইলে মৈমনসিং গেলা না? তবে সেদিন বৃহস্পতিবার কিংবা বুধবার সন্ধ্যায় ডালপুরির ঠোঙ্গা নিয়ে বসা আব্দুল আজিজ ব্যাপারি এবং আব্দুল করিমের মধ্যেকার খেলাটা হয়তো একতরফা ছিল না, পারস্পরিক ছিল। মহল্লার লোকেরা বিস্ময়ের সঙ্গে দেখে যে, আব্দুল করিমও খেলোয়াড় খারাপ না; কারণ, সেদিন আব্দুল আজিজ ব্যাপারির কথা শুনে সন্ধ্যার নরম অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে সে হাসে এবং বলে, আপনে যাইবার কন? তার এই কথা শুনে আব্দুল আজিজ ব্যাপারি হকচকিয়ে যায়, কিন্তু বুদ্ধি হারায় না, সে দ্রুত চাল বদলায় এবং এতে আব্দুল করিম ফেঁসে যায়; আব্দুল আজিজ ব্যাপারির জেরার মুখে আব্দুল করিমকে তার ময়মনসিং ভ্রমণ এবং শেফালির বৃত্তান্ত ভেঙে বলতে হয়। আব্দুল করিম বলে যে, কোন একদিন দুপুরে তার কোন এক বন্ধুর সঙ্গে মহাখালী বাসস্ট্যান্ডে বেড়াতে গেলে সেখানে তারা এই অল্প বয়স্ক গ্রামের মেয়েটিকে পায়, মেয়েটি একা এবং সম্ভবত অসুস্থ ছিল। তাদের সামনে গাড়িতে বসে মেয়েটি বাস ছাড়ার আগেই জানালা দিয়ে মুখ বের করে বমি করে, তারপর হয়তো কুলি করার জন্য অথবা পানি খাওয়ার জন্য সে যখন বাস থেকে নেমে আসে তার পা টলমল করে এবং আব্দুল করিম তা দেখে। তখন আব্দুল করিম তাকে তার বাহু ধরে নিয়ে এসে একটা কাঠের বেঞ্চে বসায়, হোটেল থেকে পানি এনে খাওয়ায় এবং তখন সে জানতে পারে যে, মেয়েটার নাম শেফালি; এবং তখন শেফালির সঙ্গে তার সব অলৌকিক কথাবার্তা হয়। আব্দুল আজিজ ব্যাপারির প্রশ্নের মুখে সে বলে যে, সে যখন দেখে বা বুঝতে পারে মেয়েটা একা বাড়ি ফিরছে এবং সে অসুস্থ তার বড় মায়া হয় এবং সে বলে, তুমি একলা যায়া পারবা? আব্দুল করিমের কথা শুনে হয়তো মেয়েটার মজা লাগে, সে বলে, কী কইন, পারতাম না ক্যারে, এল্কা কত্তো গেলাম! তখন, তারপর, বাস না ছাড়া পর্যন্ত তাদের দুজনের মধ্যে আলাপ হয় এবং তখন আব্দুল করিম জানতে পারে যে, ময়মনসিং ছাড়িয়ে আকুয়া যেতে হয়, তারপর আকুয়া থেকে ফুলবাড়িয়া; সেখানে কত চাল, কত ডাল, কত আখ এবং গুড় হয়, সেখানে কত আলু শিম এবং বেগুন জন্মে, এবং এসব জিনিস কত সস্তা দামে ফুলবাড়িয়া হাটে বিক্রি হয়। তখন কোন এক সময় মেয়েটা হয়তো তাকে বলে, আমরার বাইত বেড়াইবার যাইন যে; এবং আব্দুল করিম একটা কাগজে মেয়েটার ঠিকানা লিখে নেয় এবং বলে, মৈমনসিং যাইনিকা কুনো দিন, যুদি যাইবার কও যামুনে একদিন, দেইখা আমুনে তুমারে! সেদিন এটুকু শোনার পর আব্দুল আজিজ ব্যাপারির কাছে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায় এবং তার মনে হয় যে, এটা আব্দুল করিমের একটা খেলাই, এবং সে হয়তো নিজের সঙ্গেই খেলে, শেফালি এবং ময়মনসিং বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে সে হয়তো তার জীবনের কর্মহীনতার ভেতর এই এক অবলম্বন গড়ে তোলে। তখন আব্দুল আজিজ ব্যাপারি তার নিষ্ঠুর সিদ্ধান্তটি নেয়, তার বোধহয় মনে হয় যে, চালাকি করার রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলে হয়তো তার চাপা মারার এই প্রবণতা দূর হবে; ফলে সে বলে, তুমি যাও, আমার লাইগা পাঁচ কেজি ডাইল লয়া আইয়ো, যুদি দেখি যে পড়তা ভালা পড়তাছে পরে বিশি কইরা আনামুনে। কিন্তু মহল্লার লোকেরা বলে যে, আব্দুল আজিজ ব্যাপারির মত তারাও আব্দুল করিমকে বুঝতে পারে নাই, কারণ, আব্দুল আজিজ ব্যাপারির কথা শুনে সে বলে যে, সে ডাল কিংবা আলু কিংবা গুড় এনে ব্যবসা করার পরিকল্পনা বাদ দিয়েছে, সে এখন এমনি বেড়াতে যাবে। তার এই কথা শুনে আব্দুল আজিজ ব্যাপারির হয়তো ভাল লাগে না, পরাজিত এবং অপমানিত লাগে, এবং তার আর কিছু বলার থাকে না; সে একটা ডালপুরি আব্দুল করিমের হাতে তুলে দিয়ে বলে, ঠিক আছে, লও খাও, এবং আব্দুল করিম শেষ পুরিটাও মজা করে খায়।
ভূতের গলির লোকদের কাছে তখন ব্যাপারটা রহস্যজনক হয়ে দাঁড়ায়, তাদের মনে হয় যে, আব্দুল করিম হয়তো মহল্লার মানুষদের এবং নিজেকেও বোকা বানায় মাত্র; তাদের সন্দেহ যায় না, ফলে আব্দুল আজিজ ব্যাপারি পুনরায় ডালপুরি অথবা আলুপুরি কিনে আব্দুল করিমকে খোঁজে, তারপর তাকে যখন পুনরায় একদিন রাস্তায় পায় তাকে সে তার বাড়িতে নিয়ে যায়, বলে, আহো তুমিতো ডাইল আইনা দিবা না, আহো আলুপুরি খায়া যাও! সেদিন আব্দুল আজিজ ব্যাপারি তাকে বলে, তুমি তাইলে মৈমনসিং এমনেই বেড়াইবার লাইগা যাইতাছ? মহল্লার লোকেরা বলে যে, অবশেষে আব্দুল আজিজ ব্যাপারি হয়তো বিষয়টি বুঝতে পেরেছিল এবং আব্দুল করিম যখন নমুনা হিসাবে পাঁচ কেজি ডাল এনে দিতে পুনরায় অস্বীকার করে তখন সে খেলাটা জারি রাখার চেষ্টা করে, যাতে আব্দুল করিম এখন ভেগে যেতে না পারে। তার কথা শুনে আব্দুল করিম যখন ঘাড় নাড়ে এবং বলে, হঁ এমনেই যামু, তখন সে বলে, তুমি তুমার লগে আমার দুলাল মিঞারে লয়া যাও না ক্যালা, তুমি শেপালিরে দেইখা আইলা, অয় হাট বাজারে কী পাওন যায় দেইখা আইলো। আব্দুল আজিজ ব্যাপারির হয়তো মনে হয়েছিল যে, আব্দুল করিম তার এ প্রস্তাবে রাজি হবে না; কারণ, এত কথার পর তার হয়তো মনে হয়েছিল যে, আব্দুল করিমের ময়মনসিং যাওয়ার এসব কথাবার্তা তারপরেও হয়তো ভুয়া এবং শেফালিও কাল্পনিক। কিন্তু মনে হয় যে, তার ধারণা পুনরায় ভুল ছিল, আব্দুল করিম তার কথায় রাজি হয়ে যায় এবং বলে, তাইলেতো খুবই ভাল হয়, দুইজনে গপসপ মাইরা যাওন যায়_অসুবিধা হইব না, শেপালিগো বাইতে বড় টিনের ঘর আছে, আরামে থাকন যাইবনে; দুইজনে বেড়ায়া বুড়ায়া আমুনে।
ভূতের গলির লোকেরা এই গল্প করে :
আমরা তখন সব জানতে পারি, আব্দুল করিম ময়মনসিং রওনা হয়, সঙ্গে যায় আব্দুল আজিজ ব্যাপারির বড় ছেলে দুলাল মিঞা; ভূতের গলিতে একমাত্র আলি আকবর এবং বাবুল মিঞা ছাড়া আমরা সকলেই এই ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট হই_আব্দুল করিমের পিতা খোরশেদ আলমও অবশ্য খুশি হয় না। যাহোক আমরা খুশি হই, কারণ আমাদের মনে হয় যে, সঙ্গে দুলাল মিঞা থাকায় পরে আমরা সব ঘটনা বিশদ জানতে পারব, আব্দুল করিমের উপায় থাকবে না বানিয়ে মিথ্যা কথা বলে আমাদের ঠকানোর।
এভাবে আব্দুল করিম এবং দুলাল মিঞার যাত্রা শুরু হয়, আব্দুল আজিজ ব্যাপারির বাড়িতে শেষবার ডালপুরি খাওয়ার এক/দুই দিন পর, পরবর্তী মঙ্গলবার, দিনটা ভাল বলে, খুব সকালে তারা দুইজন সত্যি রওনা হয়; আমাদের বিশ্বাস হতে চায় না, কিন্তু তারা কাঁধে এয়ার ব্যাগ ঝুলিয়ে রিঙ্া চেপে মহল্লা থেকে বের হয়ে যায়, এবং যখন সত্যি তারা যায়, আমরা তিন/চার দিন পর তাদের প্রত্যাবর্তনের আশা করি, আমরা বলি, হয়তো পাঁচ/সাত দিনও লাগতে পারে,_কিন্তু সেদিন রাতেই তারা মহল্লায় ফিরে আসে। পরে আমরা আব্দুল করিম এবং দুলাল মিঞার কাছ থেকে এই ভ্রমণ বৃত্তান্ত শুনি।
দুলাল মিঞা বলে যে, সেদিন সকালে মহাখালী বাসস্ট্যান্ডে পেঁৗছার পর, তারা প্রথমেই এক সমস্যার মধ্যে পড়ে; কারণ, তারা দেখে যে, ফুলবাড়িয়া যাওয়ার দুই রকমের বাস রয়েছে, তারা চাইলে ময়মনসিংয়ের বাসে করে ময়মনসিং যেতে পারে, সেখান থেকে ফুলবাড়িয়া; অথবা তারা সরাসরি ফুলবাড়িয়ার বাস ধরতে পারে। কিন্তু আমরা, মহল্লার লোকেরা, তাদের সঙ্কটের বিষয়টি বুঝতে পারি না, আমরা বলি, এইটা কুনো কথা, তরা ফুলবাইড়া যাবি, ফুলবাইড়ার ডাইরেক্ট বাসে যাবি। কিন্তু দুলাল মিঞা বলে, শেফালি আব্দুল করিমকে যে ঠিকানা দেয় তাতে বলা ছিল, ঢাকা মহাখালী থেইকা বাসে চইড়া মৈমনসিং, মৈমনসিং গাঙ্গিণার পাড় থেইকা ফুলবাইড়ার বাসে কইরা ফুলবাইড়া। এ কথা শুনে সমস্যার প্রকৃতিটা আমরা বুঝতে পারি, এবং দুলাল মিঞা বলে যে, আব্দুল করিম শেফালির দেয়া নির্দেশনা অনুসরণের সিদ্ধান্ত নেয়, তারা ময়মনসিংয়ের বাসে চেপে বেলা বারটার সময় ময়মনসিং পেঁৗছায়; তারপর গাঙ্গিণার পাড়ে বাস বদল করে যখন ফুলবাইড়ার মুড়ির টিন বাসে চড়ে তাদের খুব খিদে পায় কিন্তু বাস ছেড়ে দেয়ার উপক্রম করায় তারা আপাতত ভাত খাওয়ার ইচ্ছা ত্যাগ করে ঝাল মুড়ি কিনে খায়। ময়মনসিং থেকে রওনা হওয়ার দুই ঘণ্টা পর তারা ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ডে পেঁৗছায়, দুলাল মিঞা বলে যে, এর পর তাদের আসল সঙ্কট শুরু হয়, কারণ, তারা কিছুই খুঁজে বের করতে পারে না, কেবল একটি মেয়ের নাম ছাড়া মনে হয় আব্দুল করিমের আর কিছুই জানা ছিল না, কিন্তু কেবল একটি মেয়ের নাম কি কাউকে জিজ্ঞেস করা যায়? বলা যায়, আপনেরা শেপালিরে চিনেন, অগো বাড়ি কুন দিকে?_বলা যায় না, ফলে, দুলাল মিঞা তার উপর ক্ষেপে।
দুঃমিঞা : তুমার মত এমুন ভোদাইতো হালায় আমি জিন্দেগিতে দেখিনিকা!
আঃকঃ : ক্যালা, এই কতা কচ ক্যালা?
দুঃমিঞা : নাম ছাড়া আর কিচ্ছু জান না, তুমি খুঁইজা বাইর করবা কেমনে এই শেপালিরে?
আঃকঃ : তুই আইলি ক্যালা? তরে আমি আইবার কইছিলাম!
দুঃমিঞা : আমি কি জানি নিহি যে, তুমি এমুন কাম কইরা রাখচো, নাম ছাড়া কিচ্ছু জান না!
কিন্তু দুলাল মিঞা বলে যে, তার কথায় আব্দুল করিম বিচলিত হয় না; সে বলে, দেখ না কেমনে বাইর করি! তারা তখন বাসস্ট্যান্ডের একটা চায়ের দোকানে বসে চা খায়, হয়তো শিঙ্গাড়া বা নিমকিও, কারণ, আব্দুল করিম তাকে বোঝায় যে, শেফালিদের বাড়ি গিয়েই এখন তারা খেতে পারবে। তখন দুলাল মিঞা এই চায়ের দোকানে বসে শেফালির বাড়ির ঠিকানা লেখা কাগজটা প্রথম দেখে, সে আমাদেরকে বলে, এমুন ঠিকানা হালায় আমি বাপের জন্মে দেখিনিকা; তখন তার কথা শুনে আমাদের মনে হয় যে, এমন অদ্ভুত বিষয় আমরাও কখনো শুনি নাই। কিন্তু দুলাল মিঞা অনেক কথা ঠিকমত বলতে পারে না, তখন আমাদের মনে হয় যে, শেফালির ঠিকানা লেখা আব্দুল করিমের কাগজটা আমাদের দেখা দরকার; ফলে আমরা তখন আব্দুল আজিজ ব্যাপারির শরণাপন্ন হই এবং তাকে বলি, আমরা কইলে আমাগো কথা হুনবো না, আপনেতো অরে ডাইলপুরি খাওয়ান, অরে কন আমাগো কাগজটা দেখাইতে। আব্দুল আজিজ ব্যাপারি আমাদের দাবির যৌক্তিকতা সম্পর্কে একমত হন এবং জানান যে, এ রকম একটি কাগজ আমাদের অবশ্যই দেখতে পারা দরকার এবং তিনি তার ব্যবস্থা করবেন। পরে আব্দুল আজিজ ব্যাপারি কাগজটা সংগ্রহ করে এবং আমরা সেটা দেখতে পাই; সে তখন আমাদেরকে বলে, পোলাটা খারাপ না, পরথম কইছিল যে কাগজটা নাইকা, ফালায়া দিছে, কিন্তু আমি যখন কইলাম, আমি তুমার বাপের বন্দু আমার কথা হুনবা না? তখন আয়া কাগজটা দিয়া গেল, কইলো, লন এইটা আপনেরে দিয়া দিলাম! তখন আমরা, ভূতের গলির লোকেরা কাগজটা দেখি।
একটা সাদা কাগজে প্রথমে ঠিকানা লেখা ছিল :
মোছাঃ শেপালি বেগম
ফুলবাইড়া
মৈমনসিং
এরপর ছিল পথের নির্দেশ :
ঢাকা মহাখালী বাসস্ট্যান
মৈমনসিং শহর, গাঙ্গিনার পাড়
গাঙ্গিনার পাড়_আকুয়া হয়া ফুলবাইড়া বাজার, থানার সামনে উল্টা দিকে হাঁটলে বড় এড়াইচ গাছের (কড়ই গাছ) সামনে টিএনউ অপিস টিএনউ অপিস সামনে রাইখা খাড়াইলে, বাম দিকের রাস্তা_নাক বরাবর হাই স্কুল ছাড়ায়া বরাবর সুজা, ধান ক্ষেত, কাঁটা গাছ, লাল মাটি, বামে মোচড় খায়া নদী
আহাইলা/আখাইলা/আখালিয়া নদী
নদী পার হয়া ব্রিজ পিছন দিয়া খাড়াইলে
দুপুর বেলা যেদিকে ছেওয়া পড়ে তার উল্টা দিকে,
ছেওয়া না থাকলে, যেদিকে হাঁটলে পায়ের তলায় আরাম লাগে সেই দিকে নদীর পাড় বরাবর এক মাইল হাঁটলে দুইটা নাইরকল গাছ দুই নাইরকল গাছের মইদ্দে খাড়ায়া গ্রামের দিকে তাকাইলে
তিনটা টিনের ঘর দেখা যাইব
তিনটা ঘরের একদম বাম দিকের ঘরের পাশ দিয়া যে রাস্তা গেছে সেই রাস্তা ধইরা
আগাইলে চাইর দিকে ধান ক্ষেত, পায়ে হাঁটা আইলের রাস্তা দূরে চাইর দিকে আরো গ্রাম
ক্ষেতে পাকা ধান যেদিকে কাইত হয়া আছে, সেই দিকে, অথবা, যুদি ধানের দিন না হয়,
যেদিকে বাতাস বয় সেই দিকে গেলে পাঁচটা বাড়ির ভিটা দেখা যাইব,
তিনটা ভিটা সামনে দুইটা পিছনে,
পিছনের দুইটা বাড়ির ডালিম গাছওয়ালা বাড়ি।
দুলাল মিঞা বলে, এই হালার মাতারি এত কথা কইছে, কিন্তু বাপের নাম, গ্রামের নাম, কিছু দেয় নাইকা; কিন্তু সে বলে যে, তারপরেও ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ডে চায়ের দোকানে বসে যখন ঠিকানার এই বর্ণনা দেখে সে চমৎকৃত হয় এবং আব্দুল করিম তার দিকে তাকিয়ে বলে, ঠিকানা ঠিক আছে না? দুলাল মিঞা আমাদেরকে বলে, তার তখন মনে হয়, ঠিকানা হয়তো ঠিক আছে, হয়তো দুই নারকেল গাছের ফাঁক দিয়ে তাকালে শেফালি বেগমদের গ্রাম দেখা যাবে, হয়তো ডালিম গাছ তলায় শেফালি বেগম উদয় হবে এবং আব্দুল করিমের মুখের দিকে তাকিয়ে বলবে, আইছুন, চিন্না আইবার পারলাইন, আহুইন! কিন্তু ধান গাছের শুয়ে থাকা এবং সূর্যের ছায়া দেখে পথ ঠিক করার প্রসঙ্গে সে বিভ্রান্ত বোধ করে, তার মনে হয় যে, এমন ঠিকানার কথা সে জীবনে শোনে নাই, তবে, তবু সে বুঝতে পারে যে, কিছুই না থাকার চাইতে হয়তো এ অনেক ভাল; এবং সে আব্দুল করিমের কথা শুনে বলে, হঁ ঠিক আছে, অখনে খুঁইজ্জা পাইলে হয়!
তখন ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ড থেকে তারা আর একবার শুরু করে, পাকা রাস্তা ধরে আলিয়া মাদ্রাসা পার হয়ে, কলেজের সামনে তারা ঝাঁকড়া প্রাচীন কড়ুই গাছের তলায় এসে হাজির হয়, এই গাছের সামনেই টিএনও-র অফিস বিল্ডিং; তারা পুরনো দিনের অভিযাত্রীদের মত কাগজে লেখা পথনির্দেশ অনুসরণ করে এগোয়; টিএনও-র অফিসের দিকে মুখ করে দাঁড়ালে তারা দেখে যে, একটি হেরিংবোন ইটের রাস্তা এই অফিসের সীমানা দেয়াল ঘেঁষে বাঁ দিক দিয়ে চলে গেছে, দুই ধারে পাকা ধানের জমি, এই পথ ধরে এগিয়ে তারা এক চৌমাথায় পেঁৗছায়, তখন ডান দিকে রোদের ভেতর কাত হয়ে থাকা সোনালী রঙের আমন ধানের বিস্তীর্ণ মাঠের পরে তারা একটা সাদা রঙের দালান দেখতে পায়, তাদের মনে হয় যে, এটা হয়তো হাইস্কুল হবে, কিন্তু এতদূর থেকে বুঝতে না পেরে তাদের মনে হয় যে, তারা কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারে, ভাই অইটা কি ইস্কুল? কিন্তু কোন লোক না পেয়ে তারা কাগজটা আবার পড়ে, হাইস্কুল ছাড়ায়া সুজা, এবং তারা বুঝতে পারে যে, তারা যে পথে এসেছে সে বরাবর সোজা হবে; তখন তারা চৌরাস্তা পার হয়ে মেঠো পথে পড়ে, এই রাস্তা ধরে কিছুক্ষণ এগোনোর পর তারা দেখে যে, মাটির রঙ এখানে লাল হয়ে উঠেছে, রাস্তার দুই পাশ ফণিমনসার ঝোপে পূর্ণ হয়ে আছে এবং তারা বুঝতে পারে যে, তারা ঠিক পথেই আছে এবং সহসাই তারা এই পথের মোচড় পার হয়ে আখালিয়া নদীর পাড়ে গিয়ে হাজির হয়। আমরা দুলাল মিঞার কাছ থেকে জানতে পারি, তারা তাদের সামনে সংকীর্ণ কিন্তু খাড়া এবং গভীর একটি নদী খাত দেখতে পায়, নদীর তলদেশ তখন ছিল প্রায় শুকনো, পানির একটি ক্ষীণধারা অতিকষ্টে টিকে ছিল। দুলাল মিঞা বলে যে, নদী পেয়ে যাওয়ায় তার উৎসাহ বাড়ে, কারণ, সে বলে যে, নদী হচ্ছে এমন এক বস্তু যা দেখলে সব সময় মনে হয়, কোথাও এসে পেঁৗছলাম। আমরা জানতে পারি যে, গজারি গাছের খুঁটি এবং তক্তা দিয়ে তৈরি একটা চওড়া সাঁকো সমর্থ সম্ভোগরত প্রেমিকের পিঠেরমত ঈষৎ বাঁকা হয়ে নদীর দুই পাড়ের লাল মাটি স্পর্শ করে পড়ে ছিল; সেই দুপুরে অথবা দুপুরের পর দুলাল মিঞার পিছনে আব্দুল করিম আখালিয়া নদীর সাঁকোর ওপর উঠে আসে। দুলাল মিঞা বলে যে, নদীর অন্য প্রান্তে পেঁৗছে তারা যখন পুনরায় পাড়ের ওপর অথবা সাঁকোর কিনারায় দাঁড়ায় তারা দেখে যে, তাদের ছায়া দেহের মায়া ত্যাগ করে দূরে যেতে চায় না, পায়ের নিচে পোষা কুকুরের মত শুয়ে থাকে। দুলাল মিঞা বলে, ছায়া দেখে যখন এগোনোর উপায় থাকে না, তারা দ্বিতীয় নিয়মটি অনুসরণ করতে চায়; তখন আব্দুল করিমের এই রকম মনে হয় যে, কোন দিকে হাঁটলে আরাম লাগবে সেটা বুঝতে হলে পায়ের জুতা খুলে ফেলা দরকার; সে দুলাল মিঞাকে বলে, খাড়া আমি খুলতাছি, তর খুলোন লাগব না। দুলাল মিঞা আমাদেরকে বলে যে, এই জুতা খুলতে গিয়েই সমস্যা দেখা দেয়, আব্দুল করিম সাঁকোর কাঠের রেলিঙের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে একটু কুঁজো হয়ে ডান পায়ের হাঁটু ভেঙে পা উঁচু করে জুতার ফিতা খোলার চেষ্টা করে, এবং ভুল প্রান্ত ধরে টেনে ফিতায় গিঁট লাগিয়ে ফেলে; তারপর টানাটানি করার ফলে গেরোটা বিষ গেরো হয়ে দাঁড়ায়। সে এবার হাঁটু গেড়ে এক পায়ের উপর বসে কিছুক্ষণ ফিতা ধরে টানাটানি করে, নখ দিয়ে খুঁটে খোলার চেষ্টা করে, এবং অনেক পরিশ্রমের পর সে যখন ফিতার জট শেষ পর্যন্ত খুলতে পারে তখনই সমস্যাটা দেখা দেয়। সে ঘাড় তুলে দুলাল মিঞার দিকে তাকায়; দুলাল মিঞা আমাদেরকে বলে, আমি ভাবলাম যে বোধহয় ঘাড় সুজা করবার লাগাইছে। কিন্তু আমরা দুলাল মিঞার কাছ থেকে জানতে পারি যে, ব্যাপারটা আসলে তা ছিল না, আব্দুল করিম উপরের দিকে তাকিয়ে যা বলে তাতে দুলাল মিঞা প্রথমে বিভ্রান্ত বোধ করে তারপর তার মেজাজ খারাপ হয়, কারণ, আখালিয়া নদীর সাঁকোর কাঠের পাটাতনের উপর এক পায়ের উপর বসে থেকে দুলাল মিঞার মুখের দিকে তাকিয়ে সে বলে, ল দুলাইলা, যাইগা।
দুঃমিঞা : কী কও!
আঃকঃ : ল ফিরা যাই।
দুঃমিঞা : ক্যালা?
আঃকঃ : এমনেই, ল যাইগা।
দুঃমিঞা : অহনে এই কথা কও, আইলা ক্যালা!
আঃকঃ : আইলাম, ল অখন যাইগা।
দুঃমিঞা : আমারে আনলা ক্যালা?
আঃকঃ : তুই আইলি ক্যালা!
আমরা দুলাল মিঞার কাছ থেকে শুনি যে, এরপর আব্দুল করিম তার জুতার ফিতা পুনরায় বেঁধে উঠে দাঁড়ায় এবং দুলাল মিঞার সকল প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে ফিরতি পথ ধরে, বস্তুত তারা হয়তো কখনোই আখালিয়া নদী অতিক্রম করে নাই; এবং দুলাল মিঞাকে বাধ্য হয়ে তার পিছনে আসতে হয়। তখন দুলাল মিঞা ফিরে যাওয়ার আগে বাজারে গিয়ে জিনিসপত্রের দরদাম যাচাই করে দেখার কথা বলে, কিন্তু আব্দুল করিম কিছু শোনে না, নদীর সাঁকোর উপরে তার কী হয়, সে বলে যে, প্রথমে তারা বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে ফিরতি বাসের খোঁজ করবে, কারণ, তাদের ঢাকা যাওয়ার শেষ বাস ধরতে হবে, তারপর সময় পেলে তারা বাজার ঘুরে দেখতে পারে। কিন্তু সেদিন তাদের ফুলবাড়িয়া বাজার ঘুরে দেখা আর হয় না, হয়তো সব ডাল, সব চাল, আলু এবং গুড় নিয়ে দোকান অথবা হাটের লোকেরা প্রতীক্ষায় থাকে, কিন্তু আব্দুল করিম এবং দুলাল মিঞার সময় হয় না। তারা যখন টিএনও অফিসের সামনে পেঁৗছায় তারা একটু দূরে কলেজের সামনে একটি বাস দেখতে পায়, বাসের হেলপার চিৎকার করে, ওই ঢাকা ঢাকা, লাস্ট বাস লাস্ট বাস, ছাইড়া গেল ছাইড়া গেল; দুলাল মিঞা বলে যে, তখন তাদের দৌড়ে গিয়ে এই বাস ধরা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না।
ভূতের গলির লোকেরা পরে বলে যে, তাদের জানা ছিল আব্দুল করিম এরকমই কিছু একটা করবে, তারপর তারা আব্দুল করিমের কথা পুনরায় ভুলে যায়; কিন্তু মহল্লায় আব্দুল আজিজ ব্যাপারি ডালপুরি খাওয়ার অভ্যাস বাদ দিতে পারে না, সে কখন কখন ডাল অথবা আলুপুরি কিনে আনে, এবং যখন আব্দুল করিমকে দেখে তাকে কখনো পুরি খেয়ে যাওয়ার কথা বলে, আহো ডাইলপুরি খায়া যাও, তখন আব্দুল করিম তার বাড়ির বৈঠকখানায় বসে ডাল অথবা আলুপুরি খায়, এবং বলে, হালারা আলু দিয়া ডাইলপুরি বানায়!
  
অঙ্কন : দেওয়ান আতিকুর রহমান
¦

বৃষ্টি
বৃষ্টিআলাউদ্দিন আল আজাদ
বৃষ্টি নামবে। ঈষৎ শিশির-ছোঁয়া বসন্ত রাত্রে দক্ষিণ থেকে বইবে যে হাওয়া, তাতে থাকবে সমুদ্রের আর্দ্রতা, ফাটল-ধরা শুকনো মাঠ আর পাতাঝরা গাছের শাখায় শিহরণ জাগিয়ে দিয়ে সেই অতি-দূরে পাহাড়ের চূড়ায় ঘনীভূত হবে, এরপর গর্জনে বজ্রে বিদ্যুতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে সারাটা আসমান, মঙ্গলসুধার মতো অজস্রধারায় নামবে বৃষ্টি। গাছের শুকিয়ে যাওয়া ডালপালাগুলি কচি পাতায় ভরে উঠবে, সারা খামার ছেয়ে যাবে সবুজে সবুজে। দুপুরের রোদে পাটক্ষেতের চারা বাছতে গিয়ে শরীর থেকে হয়তো দরদর করে ঘাম ঝরবে, কিন্তু তাতে আসবে না এতটুকু ক্লান্তি। কেননা নতুন ফসলের খোয়াব প্লাবনের মতো মিশে থাকবে রক্তের বিন্দুতে।
কিন্তু সে বছর এসব কিছুই হলো না। ফাল্গুন চলে গেল, উত্তরদিকটা কিঞ্চিৎ কালোও হলো না; চৈত্র শেষ হতে চলল, আকাশে দু-একদিন গুরু গুরু আওয়াজ হলো, গুমোট হয়ে রইল সারাটা প্রকৃতি; কিন্তু এর বেশি কিছু নয়।
এরপর এল বৈশাখ। আর এখনও সূর্য আগুনের ফুলকি উড়িয়ে তীব্র তেজে জ্বলতেই লাগল, মাটির বুক চিরে মাথা উঁচিয়ে-ওঠা পাটের চারাগুলি আস্তে আস্তে কুঁকড়ে গেল। ওপরে খাঁ-খাঁ শূন্য, নিচে আদিগন্ত মুক্ত সুদূর, তারও নিচে বাঘবন্দি নকশার মতো জমিগুলি রোদে-পোড়া, বিবর্ণ। দুপুরবেলা ক্ষেতের আলের ওপর গিয়ে দাঁড়ালে কলজেটা সহসা ছ্যাঁৎ করে ওঠে, ঝলসানো তামাটে জিহ্বা বার করে সারা মাঠটা ডাইনির মতো হাঁ করে আছে। জ্বলন্ত ক্ষুধা নিয়ে সে নিজের বুকের শিশুশস্যকে গ্রাস করেছে, আগামী বছর যে গজব নেমে আসবে তাতে সন্দেহ নেই।
কিন্তু কেন? এর পিছনে নিশ্চয় কোনো গুরুতর কারণ আছে। সেদিন জুম্মা নামাজের পর আলোচনা উঠল। মিম্বরের কাছে দাঁড়িয়ে মৌলানা মহীউদ্দিন বলতে লাগলেন, 'বেরাদরানে-ইসলাম! আমি অধম বান্দা, আপনাদের খেদমতে কী বয়ান করব, আপনারা সব বিষয়েই ওয়াকিফহাল। কিতাবে আছে, খোদার গজব নামে তখনি, যখন দুনিয়া গুনাগারিতে ভরে যায়। আমরা এখন কী দেখছি? না, ছেলে বাপের কথা শোনে না, জেনানা বেপর্দা, চুরি-ডাকাতি বদমায়েশিতে দুনিয়া পূর্ণ হয়েছে। এদিকে নামাজ নেই, রোজা নেই, হজ-জাকাত নেই। আজ চলুন, আমরা তাঁর দরবারে জার-জার হয়ে কাঁদি, মাঠে গিয়ে সবাই হাত তুলে মোনাজাত করি, তিনি রাহমানুর রহিম, ইচ্ছা করলে একটু দয়া করতেও পারেন।'
মৌলানা সাহেবের কণ্ঠস্বরে গুরুগম্ভীর ধ্বনিতরঙ্গে পাকা মসজিদের ভিতরটা গমগম করতে লাগল। মুসলি্লদের মধ্যে থেকে উঠে দাঁড়ালেন হাজি কলিমুল্লাহ। থুতনিতে একগুচ্ছ সাদা দাড়ি, মাথায় কিস্তি টুপি, নামাজ পড়তে পড়তে কপালের মাঝখানটায় দাগ পড়েছে। তিনি প্রথমে গলা খাঁকরানি দিলেন, পরে আবেগকল্পিত গলায় বলতে লাগলেন, 'মৌলানা সায়েব যা বললেন তা অবশ্যই আমরা পালন করব। কিন্তু এইসঙ্গে একটা কথা সক্কলের মনে রাখতে হবে, কুকর্মের বিচার চাই। এই অনাবৃষ্টি কেন হলো, আপনারা ভেবেছেন কি? খোলাখুলি বলতে গেলে, নিশ্চয় কোনো মেয়ে অবৈধভাবে গর্ভবতী হয়েছে, তৌবা, আস্তাক ফেরোল্লা। এই অঞ্চলে, আশেপাশের কোনো গ্রামে অথবা আমাদের গ্রামেও হতে পারে। এদের তালাশ করে বার করতেই হবে, নইলে এই আজাবের হাত থেকে ছাড়া পাওয়া যাবে না। এরে দুররা মেরে ঠাণ্ডা করতে হবে।'
ডান হাতের আঙুলগুলি দাড়িতে একবার চালিয়ে গরমে কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়লেন হাজি কলিমুল্লাহ, তাঁর মগজের কোষে কোষে সত্যিকারের অপরাধীকে খুঁজে পাওয়ার ভাবনা।
দুপুরের ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরে ফুটবল খেলার ময়দানে যেদিন 'মেঘের নামাজ' হওয়ার কথা, তার এক দিন আগেই অসুখে পড়লেন সুফি মৌলানা মহীউদ্দিন।
জামাতে ইমামতি করবার জন্য হাজি সাহেবকে গাঁয়ের তরফ থেকে অনুরোধ করা হলো। প্রথমে বিনয় করলেও, সকলের খেদমতে পরে রাজি হলেন।
সেদিন নামাজ শেষ হওয়ার পর পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে মুখ করে দাঁড়ালেন হাজি কলিমুল্লাহ, বহু দূর চাউনি বুলিয়ে দেখলেন, দুনিয়াটা এখনো জিন্দেগির অযোগ্য হয়ে ওঠেনি, এখনো ডাক দিলে আলেমুল গায়েবের দরবারে হাজিরা দিতে হাজার লোককে পাওয়া যায়। তিনি চেয়ে রইলেন, আর দেখলেন অগুনতি টুপির শোভা, হোক না সেগুলি তেল-চিটচিটে অথবা ছেঁড়াখোঁড়া। খোলা প্রান্তরে গালভাঙা তামাটে মানুষগুলি বসে আছে অসহায়ের মতো, সবারই মনে একটুখানি রহমের প্রার্থনা। হাজি কলিমুল্লাহ দুহাত তুলে দরাজ গলায় উচ্চারণ করতে লাগলেন : 'ইয়া আল্লাহ, ইয়া বারে খোদা, তুই চোখ তুলে চা, একটু দয়া কর তোর বান্দাদের। তুই আসমান-জমিন, চান-সুরুজের মালিক, তোর অঙ্গুলি হেলনে সাগর দোলে, হাওয়া ছুটে চলে, নহর বয়, তোর একটুখানি ইচ্ছায় এই দুনিয়া ফুলে-ফসলে ভরে উঠতে পারে। মেঘ দে, পানি দে, ছায়া দে, শান্তি দে তুই!'
'আল্লাহুম্মা আমিন! আল্লাহুম্মা আমিন!' সারা জামাতজোড়া একই কাতর আওয়াজ। হাজি কলিমুল্লাহর সাদা দাড়ি চোখের পানিতে ভিজে গেল। কেঁদে জার-জার হয়ে তিনি দোয়া খতম করলেন, 'সোবহানাকা রাবি্বকা রাবি্বল ইজ্জাতে আম্মাইয়াসসেফুন, আসসালামু আলাল মুরসালিনা, আলহামদু লিল্লাহে রাবি্বল আলামিন!'
একইভাবে এক দিন, দুই দিন, তিন দিন ময়দানে গিয়ে জামাতে শামিল হলো ছেলে-বুড়ো-জোয়ানেরা। তাদের এক চোখ আকাশের দিকে, আরেক চোখ ফসল কুঁকড়ে যাওয়া খামারের দিকে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা, এক মায়ের এক পুত্রের গায়ে চুনকালি মাখিয়ে, তার মাথার কুলোয় কোলাব্যাঙ আর বিষকাঁটালির গাছ রেখে রাতের পর রাত মেঘ-খেলা খেলল, নদীর ধারে শিনি্ন রেঁধে কলাপাতায় ফকির-ফকরাকে খাওয়াল। তাদের ঘাড়ে ব্যথা হয়ে গেল ওপরের দিকে চেয়ে থাকতে; কিন্তু সেই রোদ-চুয়ানো কাকচক্ষু নীল একখণ্ড মেঘের আভাসও দেখা গেল না।
মাগরিবের নামাজের পর পাটিতে বসে তসবিহ জপতে জপতে এসব কথাই ভাবছিলেন হাজি কলিমুল্লাহ। তাঁর চোখের পুতুলিতে অবসাদের ছায়া। গভীর ভাবনার কারণ আছে বৈকি! সুতোর চোরাকারবার থেকে যে কয়েক হাজার টাকা পেয়েছিলেন, তার অর্ধেক দিয়ে গুদাম কিনেছেন মেঘনার বন্দরে, বাকি অর্ধেক দিয়ে কিনেছেন দুন দেড়েক জমি। নিজে পাট কিনে মজুদ করতে না পারলে গুদাম কেনার ফায়দা নেই। মাসিক দেড় শ টাকা ভাড়ায় আর কী হয়! অথচ এ বছর গুদামটাকে নিজে ব্যবহার করতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে না। এদিকে সবগুলি জমি নিজে চাষ করেছেন। এখানটায়ই হয়েছে চরম বোকামি। যদি পত্তনি দিতেন, তাহলে হাজার দেড়েক টাকা নগদ পাওয়া যেত, কিন্তু মুনি-মজুর ও জমির তদারক করতে জান বেরিয়ে যাচ্ছে। বীজ বোনা থেকে এক নিড়ি পর্যন্ত পয়সাকড়ি কম খরচ হয়নি, ভবিষ্যতে আরো হবে, অথচ এদিকে আকাশের যা হাল, তাতে ফসল পাওয়ার বিশেষ আশা নেই।
সুতোর কারবার ছেড়ে দিয়েও ভালো কাজ করেননি। গত বছর হাওয়াগাড়িতে চড়ে গিয়ে হজ করে এসেছেন; ভেবেছিলেন, অতঃপর সংসারের ঝামেলাতে নিজেকে এতটা জড়াবেন না, গুদামটা ছেলেদের হাতে ছেড়ে দিয়ে নিজে জমিজমা নিয়েই থাকবেন। কিন্তু টাকার অভাবে সব ভেস্তে গেল। আসলে ব্যবসা ব্যবসাই, এতে সৎ-অসৎ-এর প্রশ্ন নেই, নিয়ত ভালো থাকলে দান-খয়রাত করলেই হলো।
জানালার বাইরে আমের বোলের তীব্র গন্ধ ভেসে আসছিল, বাঁশঝাড়ে শালিকের কিচিরমিচির অনেকটা মন্দীভূত। তসবিহর গুটিগুলি চঞ্চল হয়ে ঘুরছে হাজি কলিমুল্লাহর আঙুলে আঙুলে, এই সঙ্গে তাঁর মনটা ক্রমেই আচ্ছ হয়ে যাচ্ছে।
জৈগুন ঘরে বাতি দিতে এসে যেন চমকে উঠল। বলল, 'মিয়াসাব এখানে? মসজিদে যাননি?'
'না, শরীরটা খুব ভালো নয়।' হাজি সাহেব ওর মুখের দিকে চেয়ে বললেন, 'তা ছাড়া তোর গিনি্নমা বোধ হয় একখুনি এসে পড়বেন।'
দিন-পনেরো হলো নতুন গিনি্ন বাপের বাড়ি গিয়েছিল নাইওর করতে, আজকে তার আনবার তারিখ। হাজি নিজে যেতে পারেননি, প্রথম তরফের তৃতীয় ছেলে খালেদকে পাঠিয়েছিলেন সকালবেলায়। আসলে বৌকে বাপের বাড়িতে বেশিদিন থকতে দিতে তিনি সব সময়ই নারাজ। প্রথম স্ত্রীকে দশ দিন থাকতে দিয়েছিলেন, তাও একেবারে নতুন অবস্থায়। দ্বিতীয় স্ত্রীর বেলায় দিনের সংখ্যা আরো কিছুটা বেড়েছিল। তবে এখন পড়তি বয়েস, সব ব্যাপারে কড়াকড়ি চলে না। দুবছর আগে দ্বিতীয় স্ত্রী মারা যাওয়ার পর সংসার থেকে তাঁর মন একেবারে উঠেই গিয়েছিল। কিন্তু খোদার কুদরত, কার সাধ্য তার কিনারা করে? তিনি কপালে যা লিখে রেখেছেন, তা একদিন ফলবেই। গতবার যখন হজে গিয়েছিলেন, তার মাসখানেক আগে সবাই ধরে বসল, এমন সোনার সংসার, একজন গৃহিণী না থাকলে কোনো কিছুই ঠিক থাকবে না।
কিন্তু পাত্রী? বয়েস ষাট পুরো হতে চলল, এখন হাতে ধরে কে নিজের মেয়ে দিতে যাবে?
'হাসালেন হাজি সাহেব, হাসালেন। আপনার কি না পাত্রীর অভাব?' মজু প্রধান দাড়িতে হাত বুলিয়ে কন যে বিয়ে করবেন, আমি পাত্রী ঠিক করে দিচ্ছি। তাও যেমন-তেমন নয়, এমন কন্যা দেব, চোখে পলক পড়বে না।'
হাজি কলিমুল্লাহর চোখের তারা দুটো খুশিতে চকচক করে উঠল। একটা অজানা অনুভূতিতে তাঁর হৃৎপিণ্ডটা ধুক ধুক করছিল; কিন্তু বাইরে আগাগোড়া ম্লান হয়েই রইলেন, আগেকার সহধর্মিণীদের স্মৃতি এত শিগগির ভুলে যাওয়া উচিত নয়। তিনি একটা ঢোক গিলে বললেন, 'দেখুন, তিনকাল গিয়ে এককাল পড়েছি, এখন আমোদ-আহ্লাদ করার সময় নয়। ঘরের তদারক আমার ফাইফরমাশটা করতে পারলেই হলো।'
'তা তো বুঝলাম।' মজু প্রধান যুক্তি দেখালেন, 'ভাঙা নাওয়েও কাজ চলে, আবার নতুন নাওয়েও চলে; কিন্তু কোন্টা আমরা চাই? কোন্টা দিয়ে গাঙ পাড়ি দিতে সুখ?'
এর পর সাতকানি জমি সাফকাওলা করে দিয়ে যে পাত্রী ঠিক হয়েছিল, সে মজু প্রধানেরই মেয়ে-ঘরের নাতনি। বয়স একুশ-বাইশ বছর হবে। এ দেশের মেয়েরা কুড়িতেই বুড়ি হয়, সে হিসেবে হাজি সাহেবের সঙ্গে সম্বন্ধটা মোটেই বেমানান হয়নি।
রান্নাঘরের হাঁড়ি-পাতিল গুছিয়ে জৈগুন এল। অর্থপূর্ণ গাম্ভীর্যের সঙ্গে একটা পিঁড়ি টেনে নিয়ে বসল। হাজি সাহেবের ওজিফা তখনো শেষ হয়নি। মুখের বিড়বিড় খানিকক্ষণের জন্য থামিয়ে তিনি জিগগেস করলেন, 'কিরে, কিছু খবর আছে?'
জৈগুন বলল, 'আছে।'
'কী শুনি!' তসবিহর মালায় আঙুল থেমে গেল হাজি কলিমুল্লাহর, তিনি উৎসুক দৃষ্টিতে চাইলেন। কাজকর্মের ফাঁকে ফাঁকে গোপন খবর সংগ্রহের জন্য তিনি জৈগুনকে নিযুক্ত করেছিলেন, আর সে জন্যই এই আগ্রহ।
'আমি আজ গিয়েছিলাম বাতাসীর কাছে। গিয়ে দেখি, সে তার খাশিটার জন্য আমপাতা পাড়ছে। আমাকে দেখেই সে নানান কথা বলতে লাগল, কিন্তু আমি চেয়ে রইলাম ওর শরিলের দিকে।' দরজায় একবার চেয়ে নিয়ে জৈগুন বলল, 'ওর তলপেটটা বেশ ফোলা মনে হলো।'
হাজি চিন্তিতভাবে জিজ্ঞেস করলেন, 'ওর জামাই না কবে মারা গেছে?'
'তা সাত-আট মাস তো হবেই!' জৈগুন হিসাব করে বলল, 'কিন্তু ওর পেট মনে হলো চার-পাঁচ মাসের।'
'তাই নাকি? তাহলে তো বেশ অনেক দিনের ফাঁক।' হাজি কলিমুল্লাহ যেন সত্যদর্শন করেছেন, তাঁর চোখে আশার আলো ফুটে উঠল। নিচুগলায় জিগগেস করলেন, 'আচ্ছা, বাতাসীর ঘরে যে লোকটা থাকে, তাকে দেখলি?'
'হ্যাঁ, দেখলাম। অসুখ এখনো সারেনি, তবে আগের চেয়ে একটু ভালো। আমি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দেখি, সে ঘরের ভিতরে বিছানায় শুয়ে আছে।'
'তা হোক, তা হোক।' হাজি অসহিষ্ণুর মতো বললেন, 'শুয়ে থাকলে কী হবে? শুয়ে থাকলে কি আর এসব কাজ করা যায় না? নিশ্চয় যায়। তুই কী বলিস?'
'হ্যাঁ, আপনি ঠিকই কইছেন। তা ছাড়া বাতাসীর চলাফেরা আমার ভালো মনে হয় না। রজবালি বেঁচে থাকতেই এর সম্বন্ধে কত লোক কত কথা বলেছে। নামাপাড়ার ছমু যে ওর দরজা খুলেছিল, তা কি কেউ শোনেনি? রজবালি টের পেয়েছিল বলেই না দোষটা ছমুর ঘাড়ে গিয়ে পড়ল। না-হলে মেয়েমানুষের চোখঠারানি ছাড়া কি অমন কাজ কেউ করতে সাহস পায়?'
'যদি এই ঠিক হয়, তাহলে তো আর কোনো কথাই নাই। আমার বিশ্বাস, বাতাসীই এ কাম করেছে_না হলে বৃষ্টি হবে না কেন?' হাজি আবার তসবিহ জপতে লাগলেন, খানিকক্ষণ চুপ থাকার পর বললেন, 'তবু রাখ্, আমি নিজে একটু পরখ করে নিই, এর পর একটা কিছু করা যাবে।'
জৈগুন চলে গেলে আবার গভীর চিন্তামগ্ন হলেন হাজি কলিমুল্লাহ। তাঁর কপালের বলিরেখা আরো কুঁচকে গেল। তসবিহর গুটিতে ঘন ঘন আঙুল চলতে লাগল। বাতাসী, বাতাসী, বাতাসী। বাতাসী ছাড়া এ কাজ আর কারো নয়। অল্প বয়েসে স্বামী মারা যাওয়ার এই দোষ! কেননা, স্বামীসঙ্গ একবার যে পেয়েছে, সে সেই স্বাদ কি সহজে ভুলতে পারে? এ হচ্ছে আফিমের মতো, ভাত ছাড়া যায়, তবু ছাড়া যায় না এর নেশা। তা ছাড়া ওর পুরো জোয়ানী। যেমন তেমন দু-একজন পুরুষ ওর কাছে কিছু নয়, এক চোখের বাঁকা চাউনিতেই কাৎ করে ফেলতে পারবে। অথচ কথা বলার কী কায়দা। মামাতো ভাই, দিনমজুরি করত, কালাজ্বরের কবলে পড়ে বিপদ হয়েছে, কেউ নেই, না দেখলে চলে না। এসব কথা দিয়ে আর চিঁড়ে ভিজবে না। আসলে লোকটাকে এনেছে এক বিছানায় রাত কাটাবার বুঝতে বাকি নেই।
কিন্তু এর শাস্তি হবে কী? কিতাবের হুকুম মানলে, গলা-ইস্তক মাটিতে পুঁতে এর মাথায় পাথর মারতে হবে, যতক্ষণ না প্রাণটা বেরিয়ে যায়। কিন্তু এ যুগে তা কি সম্ভব? থানা আর পুলিশ রয়েছে যে। তাহলে উপায়? জুতো মারা? একঘরে করে রাখা? গ্রাম থেকে বের করে দেওয়া?
হাজি কলিমুল্লাহ যখন এসব ভাবনায় তন্ময় ছিলেন, তখন খালেদ তার নতুন মাকে নিয়ে মরা-গাঙের পানির কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।
পূর্ণিমা-চাঁদ দেখা দিয়েছিল বাড়ি থেকে রওনা দেয়ার অনেক আগেই, এইবার তো বাঁশঝাড়ের মাথা ছাড়িয়ে উঠে ঝলমল করছে। চারদিক নিঝঝুম, গাছপালায় বাতাসের নড়াচড়ার গরজ নেই।
মরা-গাঙে এখন হাঁটু পানি। দুই পাশে কাদা ঠেলে ডাঙার সঙ্গে যে সরুপথটার মিল হয়েছে তার পরিষ্কার বালুর ওপর দিয়ে ঝিলঝিল করে কেটে চলেছে ফোয়ারার স্রোত। পানির ভিতর থেকে গজিয়ে ওঠা বোরো ক্ষেতগুলিতে কচি ধান-পাতার জড়াজড়ি।
নিচু হয়ে জুতোজোড়াটা ডান হাত দিয়ে খুলে ফেলল জোহরা। তার কাঁধে ছোট ছেলেটা। আর অসুবিধা হচ্ছে দেখে পিছন থেকে খালেদ পাশে এসে বলল, 'সাজুকে আমার কাছে দিন।'
ওরা দুজনে প্রায় সমবয়সী। প্রথম প্রথম 'আপনি' বলতে লজ্জা করত খালেদের, কিন্তু এখন আর সে ভাবটা নেই।
জোছনায় আলোকিত বড় ছেলের মুখের দিকে চাইল জোহরা, টানা ভুরুর নিচে ওর সুন্দর চোখ দুটো আরো সুন্দর মনে হলো তার, একটা অব্যক্ত অনুভূতির ছলছলানিতে বনের অন্ধকারে শিহরিত নদীর মতো দুলে উঠল বুকের ভিতরটা। আচ্ছন্ন স্বরে জিজ্ঞেস করল, 'তোমার কষ্ট হবে না তো?'
খালেদ হাসল! বলল, 'না, এ আবার কষ্ট কী?'
সাজুকে পাঁচ বছরের রেখে ওর আম্মা এন্তেকাল করেছেন দুবছর আগে, আদর-যত্ন না-পাওয়ায় ওকে কান্নারোগে ধরেছিল। কিন্তু বর্তমানে তা নেই। নতুন মাকে তার এমনি ভালো লেগেছে যে সে এক মুহূর্তের জন্যও তার কাছছাড়া হয় না। জোহরা যখন নাইওর করতে যায়, তখন ও তার কোলে উঠে চলে গিয়েছিল।
অন্য কাঁধের ওপর থেকে অঘোরে ঘুমিয়ে থাকা ছোটভাইটিকে নিজের কাঁধে নিতে গিয়ে খালেদের মনে হলো, কপোতের বুকের মতো উষ্ণ, প্রবালের মতো কোমল কিসের মধ্যে যেন তার বাঁ হাতের আঙুলগুলি ক্ষণিকের জন্য হঠাৎ হাওয়ায় চাঁপার কলির মতো কাঁপুনি খেয়ে গেল। নিমেষে তার সমস্ত শরীরটা শিরশির করে উঠল ভরামেঘে বিদ্যুৎ সঞ্চারের মতো। পলকের জন্য তার চোখে পড়ল, সহসা কেমন রাঙা হয়ে উঠল মেয়েটির মুখ, তার সারা চেহারায় রক্তের প্রবাহ বহ্নির মতো ছড়িয়ে গেল। খালেদ আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না; আরেক জন্মের কোনো নিবিড় স্মৃতি অস্পষ্ট মনে পড়ার মতো কী এক অজানা বেদনায় মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ঝিরঝিরে পানির ওপর দিয়ে সুমুখে হাঁটতে লাগল।
কিন্তু জোহরা দাঁড়িয়েই রইল। কাপড়টা ঠিক করে নিয়ে চাঁদের দিকে মুখ উঁচিয়ে চাইল একবার, আবার চাইল সামনে চলমান মূর্তিটার দিকে। এর পর সে চঞ্চল হয়ে উঠল। সেই রুপালি বালুর ওপরে ফোয়ারার স্রোতে বয়ে চলা রাস্তাটায় ত্রস্ত হরিণীর মতো পা ফেলে হাঁটুপানির কাছে গিয়ে আবার দাঁড়িয়ে পড়ল। দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে পিছন থেকে শাড়িটা কুচকে এনে ডান হাতে হাঁটুর কাছে ধরা, জোছনা-উছল কালো পানির দিকে মুখ নিচু করে জোহরা দেখল, তার মূর্তিটা ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে, এই সঙ্গে ছোট ছোট ঢেউয়ে ভেঙে যাচ্ছে চাঁদের চেহারাটাও। হঠাৎ মুখ তুলে সে ডাকল, 'খালেদ!'
'কী!'_কিছুদূর থেকে খালেদ সাড়া দিল।
'আমাকে ফেলেই চলে যাচ্ছ।'_স্বপ্নের স্বরে যেন জোহরা বলল, 'আমি চলতে পারছি না। দ্যাখো, দ্যাখো! পানিটা কী সুন্দর!'
খালেদ ফিরে এল। বলল, 'আপনার কী হয়েছে বলুন তো, চলুন তাড়াতাড়ি। অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে।'
'ও তাই তো। অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে!' পানি ঠেলে কিছু দূর এগিয়ে আবার থমকে দাঁড়াল জোহরা। ঝিলিমিলি ঢেউয়ের দিকে চেয়ে বলল, 'দেখছ, কী সুন্দর পানি! এমন পানিতে মরতেও সুখ।'
কোনো জবাব দিল না খালেদ, মুখ নিচু করে চুপচাপ এগোতে লাগল।
ওপারে কোথায় একটা পাখি ডেকে যাচ্ছে_'বৌ কথা কও।'
নদী পেরিয়ে এসে চপচপ পানি থেকে পা দুটো ঝাড়া দিয়ে নতুন জুতোজোড়াটা পরার সময় জোহরার মনে হলো তার বুকের ভিতরে কিছু নেই, বিবাগী হাওয়ার মতো কিসের এক রিক্ত হাহাকার গুমরে গুমরে মরছে। নিজের কথা ভাবতেই সে আঁতকে উঠল, তার শরীরটা ঝিম ধরে অবশ হয়ে এল।
খালেদ আস্তে আস্তে হাঁটছিল। পিছন থেকে সে একটা কাতর-স্বর শুনতে পেল_'একটু দাঁড়াও!'
'আবার কী হলো আপনার!'
'কী জানি কিছু বুঝতে পারছি না! আমার চোখ দিয়ে এমন পানি পড়ছে কেন?' জোহরা ব্যাকুলভাবে এগিয়ে গিয়ে খালেদের চোখের সামনে নিজের চোখজোড়া বিস্ফারিত করে দাঁড়াল, চাঁদের আলোয় দেখা গেল, তার টলটলে দুটো চোখ দিয়ে মুক্তোর মতো অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে পড়ছে।
খালেদ আবার উচ্চারণ করল, 'কী হলো আপনার?'
'তুমি কিচ্ছু জানো না, কিচ্ছু বোঝো না!' কাপড়ের খুঁট দিয়ে চোখ দুটো মুছে জোহরা অপ্রকৃতিস্থের মতো বলল, 'সাজুকে দাও আমার কাছে। চলো শিগগির। লোকজন নেই, আমার বড্ড ভয় করছে।'
ওরা যখন মুখোমুখি হয়েছিল, তার কিছু আগে থেকে কিঞ্চিৎ হাওয়া বইতে শুরু করেছিল, আর যখন চুপচাপ চলতে শুরু করল, তখন একখণ্ড ঈষৎ কালো মেঘ দক্ষিণ থেকে ধীরে ধীরে ভেসে আসতে লাগল। খড়ম পায়ে উঠোনে পায়চারী করছিলেন হাজি কলিমুল্লাহ, আকাশের দিকে চেয়ে তিনি চমকে উঠলেন। তাহলে তাঁর আন্দাজই ঠিক?
'জৈগুন! ও জৈগুন!' তিনি থমকে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলেন, 'দেখে যা, আমরা যা ভাবছি তাই ঠিক। আসমানে সাজ দেখা দিয়েছে।'
জৈগুন চৌকাঠের কাছে এসে মুখ বাড়িয়ে বলল, 'তবু তো আপনি বলছেন, আরো পরখ করতে। আমার মনে কোনো সুবা-সন্দে নেই। বাতাসী যা ছিনাল।'
আকাশে চলমান মেঘটার দিকে চেয়ে আবার পায়চারী করতে লাগলেন হাজি কলিমুল্লাহ, এর বিচারটা কী হবে তিনি তার কিনারা করতে পারছেন না।
আধঘণ্টা পরে জোহরা যখন এল, শুয়ে শুয়ে তার সঙ্গে আলাপ করতেও বারবার তাল কেটে যেতে লাগল, অনেক রাত পর্যন্ত চোখে ঘুম এল না!
মনস্থির করে পরদিন সকালে তিনি গিয়ে উঠলেন বাতাসীর বাড়িতে, পুবপাড়ার আমবাগানের ওধারে। বাঁশের চালার নিচটায় পাকালের ধারে বসে ও খুদের জাউ রাঁধছিল, হাজি সাহেবের সাড়া পেয়ে একটা চৌকি হাতে উঠানে এল। এমন গণ্যমান্য লোক, সাতজন্মে একবার এসেছেন ওর এখানে, কী দিয়ে মেহমানদারি করবে, সে ঠাহর করতে পারল না।
মাথায় কাপড় টেনে ও কী বলছিল সেদিকে হাজির মোটেই নজর ছিল না, তিনি গোপনে আড়চোখে হরিদ্রাভ লাবণ্য-স্নিগ্ধ ওর দেহটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলেন।
এদিকে বাড়ির নাশতা-পর্বের তদারক শেষ হওয়ার পর জোহরা গুম হয়ে বসেছিল তার শোবার ঘরে চৌকির কিনারায়।
বিয়ে হওয়ার পর থেকে কিসের যেন এক আশ্চর্য মায়ায় বিনা কাজের সময়টুকু সে এখানটায় বসেই কাটিয়ে দেয়। এ কিসের জাদু? কিসের মন্ত্রণা? জোহরা তা বুঝতে পারে না। বাড়ির চেহারা বোধ হয় অনেকদিন থেকেই অদলবদল হয়েছে, কিন্তু এ কামরাটায় কোনো পরিবর্তন নেই, দিনে দিনে নতুন জিনিস যোগ হয়েছে মাত্র। আগেকার গিনি্নদের হাতের ছাপ অনেক কিছুতেই এখনও টাটকা হয়েই আছে, অন্ধকারে বসে থাকলে তাদের ঠোঁটের ফিসফিস আলাপও যেন সে শুনতে পায়। তখুনি ওর মনে হয়, এ ঘরে ঢোকবার কোনো অধিকার তার নেই, এখানকার সব দখল করে সে ডাকাতের কাজ করল।
কিন্তু আমার কী দোষ? আমি তো রাজি হতে চাইনি! নানা বলল, বোন কাঁদিসনে, দু-একটা বছর সবুর কর, বুড়োটা মরল বলে। তখন বেশ জোয়ান দেখে একটা বর জুটিয়ে দেব। এখন সম্পত্তিটা হাত করে নে।'
জোহরা আপন মনে আওড়াল, 'ছাই সম্পত্তি!'
দগদগে ঘার ওপর দিয়ে গরম বাতাস বইতে থাকলে যেমন করে জ্বলে, ওর বুকের ভিতরটা তেমনি করে জ্বলতে লাগল। দম যেন ক্রমেই বন্ধ হয়ে আসছে। একসময় সে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল। ওর চোখের দুটো তারায় জ্বলজ্বল করতে লাগল একটা দুর্বিনীত বন্যতা!
মগজটা গিজগিজ করছিল, এলোচুলে ঝাঁকড়া মাথাটা একবার ঝাড়া দিয়ে জোহরা বাইরে চলে এল। চোখ তুলে চাইতেই ওর দৃষ্টি পড়ল কুয়োর ধারে মেহেদি গাছটার দিকে, ভিজে মাটির রসে তাতে ঘন হয়ে কচিপাতা দেখা দিয়েছে।
কদিন সংকল্প করেও সে মেহেদি গাছটা কাটতে পারেনি। কিন্তু আজকে ডান হাতটা শিরশির করতে লাগল। ত্রস্ত পায়ে সে চলে গেল রান্নাঘরের ভিতরে। সেখান থেকে ধারালো বঁটিটা এনে একেক কোপে একেকটি ডাল কেটে ফেলতে লাগল।
'আহা হা, করে কী গিনি্নমা'_জৈগুন দৌড়ে এল। বলল, 'গাছটা অনেক দিনের, মানুষের কত কাজে লাগে। কর্তা শুনলে ভীষণ রাগ করবেন।'
'তুই এখান থেকে যা তো। কে রাগ করবেন না করবেন, তোর চাইতে আমি ভালো বুঝি। আমার ইচ্ছা হয়েছে, আমি কাটবই।'
'আমি কাম করে খাই, আমার কী? আপনার ভালোর জন্যই বলছিলাম।'
'আশ্চর্য!' জোহরা মুখ তুলে চাইল। বলল, 'আমার ভালো-মন্দের চিন্তা তোকে করতে হবে? দুনিয়াতে আর লোক নেই।'
কর্তার প্রিয় গিনি্নকে আর ঘাঁটাতে সাহস করল না জৈগুন, মুখ কালো করে সে নিজের কাজে চলে গেল।
কেমন করে দুপুর হলো, কেমন করে এল বিকেল, আর কেমন করেই বা রাত্রি এসে পৃথিবীর মুখ ঢেকে দিল, জোহরা কিছুই বলতে পারবে না। তার হৃদয়ের একটা অংশ কে যেন ঝকঝকে ধারালো ছুরি দিয়ে কেটে নিয়ে গেছে, প্রতিদিনের উচ্ছল ঢেউ সেখানে লাগে না, সেখানে তুষের আগুনের মতো শুধু একটি জ্বালা।
এশার নামাজের পর বিছানায় শুয়ে হাজি কলিমুল্লাহ বললেন, 'যা ভেবেছিলাম, বাতাসীই কুকাম করেছে।'
'কেমন করে জানলেন?'_জোহরা শুধাল।
'এসব জানতে কি আর খুব বুদ্ধি লাগে? তারে ঠিকমতো ঘা দিলাম, আর তা বেজে উঠল। ব্যস্ আর ভাবনা নেই। বিচারটা করতে পারলে বৃষ্টি হবেই। হাজি একটুখানি নীরব থেকে বললেন, 'আগামী শুক্রবার রাত বারোটার পর বিচার বসাব। দেখা যাক কী হয়।'
জোহরা চুপচাপ শুয়ে বাইরের দিকে কান পেতে রইল। আমের বোলের গন্ধ এমন মাতাল কেন? রাত কেন এমন কালো, অন্ধকার? সূর্য যদি আর না উঠত, তাহলেই ছিল ভালো, সবার চোখের আড়ালে চিরদিনের জন্য সে হারিয়ে যেত, যেখানে কেউ নেই, কেউ থাকবে না।
কপালে কোমল হাতের ছোঁয়া পেয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই নাক ডাকতে শুরু করলেন হাজি কলিমুল্লাহ। ওই শব্দটুকু বাদ দিলে, জোহরার মনে হলো, তার পাশে শুয়ে আছে একটা মৃতলোক, বুক থেকে পা পর্যন্ত সাদা কাপড়ে ঢাকা। সে লোমশ হাতটা ছাড়িয়ে কিছুক্ষণ চুপ হয়ে রইল। এরপর আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল। অতি সন্তর্পণে দরজার খিলটা খুলে উঠানের একপাশে আমগাছতলায় এল।
'সারা দিন কোথায় ছিলে তুমি?' খালেদ চুপি চুপি বাড়ির ভিতরে ঢুকতেই সাঁ করে তার সামনে গেল জোহরা, চাপা-গলায় বলল, 'না খেয়ে থাকতে খুব ভালো লাগে, না?'
কথা বলার চেষ্টাও না করে খালেদ থ হয়ে রইল। হঠাৎ ডান হাতটা তুলে ওর গালে একটা চড় মেরে ক্ষিপ্তের মতো জোহরা বলল, 'আমি আর এত কষ্ট সইত পারব না। বাড়ি থেকে চলে যাও, চলে যাও তুমি!'
কাপড় দিয়ে মুখটা ঢেকে ও প্রায় দৌড়ে উঠে গেল বারান্দায়, ঘরের ভিতরে গিয়ে খিল এঁটে দিল।
খালেদ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগল। তার দুই চোখ থেকে ঝরঝর করে পানি পড়ছে, কণ্ঠরোধ হয়ে আসছে। ভোরবেলায় অন্যেরা ঘুম থেকে ওঠার আগেই সে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল, নদীর ধারে ধারে জমির আলের ওপর দিয়ে মিছিমিছি সে হেঁটে বেড়াল, এরপর চলে গেল বন্দরে, তার বড় দুই ভাই যেখানে কজ করেন, সেই গদিতে; কিন্তু কোথাও মন টিকল না। শেষ পর্যন্ত কি যেন এক অজানা আকর্ষণে বাড়ির দিকে রওনা হয়েছিল।
শুক্রবার রাত বারোটা বেজে গেলে একে একে সবাই গিয়ে হাজির হলো মৌলানা মহীউদ্দিনের বৈঠকখানায়। এর আগেই কানাঘুষার মারফতে ব্যাপারটা সারা গ্রামে জানাজানি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সবার তো আর বিচারের ক্ষমতা নেই। আজকের মজলিশ শুধু গ্রামের আলেমমণ্ডলী ও মাতব্বরদের নিয়ে। দরজা-জানালা বন্ধ করার পর আসামিদের মাঝখানটায় বসিয়ে তাঁরা আলোচনা শুরু করলেন।
তিন দিন তিন রাত্রি হাদিস-কিতাব ঘেঁটে একটা ফতোয়া তৈরি করেছিলেন হাজি কলিমুল্লাহ। মৌলানার অনুমতি নিয়ে তিনি তা পড়ে শোনালেন।
বাতাসী অনেক আগে থেকেই বিনিয়ে বিনিয়ে গুনগুন করছিল, এবার ডুকরে কেঁদে উঠল। বিলাপ করে বলতে লাগল, 'ও মা গো, এ-ও আমার কপালে ছিল গো! আঁতুড়ঘরে কেন মুখে নুন দিয়ে মেরে ফেললে না গো!'
'এই বেটি কান্না থামা!' হাজি ধমক দিয়ে উঠলেন। বললেন,_'সে সময় বুঝি খুব ফুর্তি লেগেছিল?'
মৌলানা মহীউদ্দিনকে বেশ চিন্তিত মনে হলো। তাঁর সৌম্য মুখমণ্ডলে বেদনাতুর গাম্ভীর্যের কান্তি। ধীরে ধীরে মুখ তুলে শান্ত গলায় তিনি জিজ্ঞেস করলেন,_'কি গো, তোমার কিছু কওয়ার আছে?'
'কী কইব বাবা, আপনারা তো গরিবের কথা বিশ্বাস করেন না। আমরা তো মানুষ নই, কুকুর-বেড়াল! আমাদের আবার ইজ্জত কী! বাতাসী চোখ-মুখে বলল,_'না হলে এমন বদনাম আপনারা আমার ওপর ফেলতে পারতেন!'
'কিন্তু এসব কথা তো আর আসমান থেকে পড়ে না!' হাজি কলিমুল্লাহ বললেন,_'অন্য কারো নামে তো ওঠেনি?'
'সে আমার কপালের দোষ। না হলে, ও বেঁচে থাকতেই আমি কতবার বমি করেছি, প্রতিরোজ পোড়ামাটি আর তেঁতুল না খেয়ে থাকতে পারিনি_এসব জিনিস কারো চোখে পড়ত না!'
একটা ময়লা কাঁথা গায়ে জড়িয়ে বসে বসে কোঁকাচ্ছিল বাতাসীর মামাতো ভাই রহিমদ্দি। তাকে সওয়াল করলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল শুধু।
বিচারের আলোচনা যখন এগিয়ে চলছিল, তখন দক্ষিণ দিক থেকে পালে পালে কালো মেঘ এসে সমস্ত আকাশ ছেয়ে ফেলেছিল। চাঁদ বারেবারে আড়ালে পড়ছে, গাছপালা ও খামারে-নদীতে আলোছায়ায় লুকোচুরি।
একসময় বাতাস বন্ধ হয়ে গেল, অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল সারাটা প্রকৃতি! ঘরবাড়ি কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে মাঝে মাঝে গুরু গুরু আওয়াজ উঠল, সঙ্গে সঙ্গে চমকাল বিদ্যুৎ। ঘরের ভেতর সবাই ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল।
ঠিক এমনি সময় হাজি সাহেবের বাড়িটার পিছনটায় আমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছিল একটি মানুষের ছায়ামূর্তি। পা টিপে টিপে খোলা জানালার কাছে এসে অনেকক্ষণ সন্ধানী দৃষ্টিতে চেয়ে রইল, ঘরের ভেতরে আলো নেই; নাম-না-জানা অরণ্যের ভেতর কোনো প্রেতপুরীর মতো সমস্ত বাড়িটা রুদ্ধ-নিশ্বাসে ঝিম ধরে আছে।
জানালা থেকে সরে এসে মূর্তিটা ভিটির ধার ঘেঁষে চলতে শুরু করল, রান্নাঘরের পাশ দিয়ে ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। একেকবার বিজলি চমকায় আর সে যেন শিউরে ওঠে গভীর আতঙ্কে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বাতাস বইতে শুরু করল, মেঘে মেঘে সংঘাতে, গর্জনে চারদিক তোলপাড় হতে লাগল। দরজাটা হয়তো ভেজানো ছিল, আচমকা দমকা হাওয়ায় তা সশব্দে খুলে গেল। মানুষটা ত্রস্তপদে এসে উঠল বারান্দায়। এদিক-ওদিক খানিক চেয়ে একসময় মরিয়া হয়েই যেন ঘরে ঢুকে পড়ল। ওপরে-নিচে কেবল শব্দ, শব্দ আর শব্দ। জোর বাতাসের তোড়ে একেকবার মোচড় খেয়ে ওঠে করগেটের চালগুলি, কাঠের বেড়ায় অবিরত ধুপধাপ আওয়াজ।
খাটের কাছে এসে ইতস্তত করতে লাগল মানুষটা, কী করবে যেন ঠিক করে উঠতে পারছে না। শরীরে রোমগুলি কাঁটা দিয়ে উঠছে, ঢিবঢিব করছে হৃৎপিণ্ড, চিনচিন করে মস্তিষ্কে রক্ত উঠে চোখ দুটো ঝাপসা করে দিচ্ছে। তার ভাবনা, কোথায় এলো সে? এ কি জন্ম, না মৃত্যু? এ কি সব হারানোর হাহাকার, না মিলনের উন্মত্ত রংরাগ? কান পেতে সে যেন শুনল, চুরির রিনিঝিনি, একটি গভীর শান্ত নিশ্বাস, কাপড়ের মৃদু খসখস। ঘ্রাণ আসছে, এ কী আমের বোলের, না চুলের গন্ধ? না, না, এখানে নয়। এ তো সে চায় না, চাইতে পারে না।
এক পা-দু পা করে সে পিছিয়ে যাচ্ছিল, এমন সময় অনুভব করল, একটা সুপুষ্ট নম্র মসৃণ হাত অন্ধকার থেকে উঠে এসে গানের কলির মতো পরম আশ্বাসে তার হাতকে আকর্ষণ করল।
তখন সমস্ত আকাশে মেঘেদের হুড়োহুড়ি লুটোপুটি লেগে গেছে, মন্দ্র-গর্জনে একেকবার কেঁপে কেঁপে উঠছে সারা পৃথিবী। একটানা ঝড়ের তীব্র বেগে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে গাছপালা, মত্ত হয়ে কে যেন লেগেছে লুণ্ঠনের উচ্ছৃঙ্খল তৎপরতায়। স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল মন্থন করে যেন এক মহাপ্রলয়ের উচ্ছ্বসিত শব্দের ভয়ংকর-সুন্দর রাগিণী।
এভাবে কতক্ষণ ঝড় চলল হয়তো কেউ বলতে পারবে না। বাতাস যখন কমতে লাগল, তখন অযুত মুক্তাবিন্দুর মতো নামল বৃষ্টি।
ধারালো হাওয়ার সঙ্গে প্রথম যখন বৃষ্টি নামল, তখন তাতে রইল শুধু নবজাতকের বিক্ষোভ, ঘরবাড়ির ওপর দিয়ে শুধু ঝরঝর ঝাপটা দিয়ে গেল। কিন্তু বেশিক্ষণ এ রইল না। ধ্রুপদ সংগীতের বিলম্বিত লয়ের মতো বাতাস যতই কমতে লাগল, বর্ষণে ততই এল নিবিড়তা। এরপর শুধু ঝমঝম শব্দ।
এভাবে কতক্ষণ কেটে গেল জানা নেই। একসময় খোলা দরজা পার হওয়ার পর উঠোনে নেমে বৃষ্টির মধ্য দিয়েই টলতে টলতে উত্তর-ভিটির ঘরের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল মানুষটা। তার পেছনে পেছনে এসে জোহরা এলোমেলো কাপড়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল। তার শরীর ভিজে যেতে লাগল বৃষ্টির ছাটে।
খানিকক্ষণ পরে একটা ছাতা মাথায় ঘাড় নিচু করে ধুঁকতে ধুঁকতে বাড়িতে ঢুকলেন হাজি কলিমুল্লাহ। হঠাৎ তাঁকে দেখতে পেয়ে জোহরা বলে উঠল,_'অত দেরি যে! আর ইদিকে আমার বড্ড ডর লাগছে।'
'কী আর করি বলো, আপদ চুকিয়ে এলাম!' ছাতাটা বেড়ায় ঠেস দিয়ে রেখে হাজি বললেন,_'সে একটা পাঁড়-হারামজাদী, শেষ পর্যন্ত কিছুতেই দোষ স্বীকার করল না। কিন্তু বাতাসীর মতো মেয়েলোকের ফাই-ফুই বুঝি আমি ধরতে পারি না? দুটোকে দিলাম পঞ্চাশ জুতো করে, তার ওপর কালকে গাঁ ছেড়ে চলে যাবে। দেখলে আল্লাহর রহমত? সঙ্গে সঙ্গে বিষ্টি নামল!'
'হ্যাঁ, তাই তো, বড় তাজ্জব ব্যাপার!' কথাটা শেষ করে ঝমঝম বৃষ্টির মধ্যে বারান্দা থেকে উঠোনে নেমে গেল জোহরা, তার অঙ্গভঙ্গি রহস্যময়।
হাজি হৈ হৈ করে উঠলেন, বললেন,_'আরে, আরে করছ কী? তুমি পাগল হলে নাকি? এত রাত্রে ভিজছ, সর্দি করবে যে।'
'না, সর্দি আমার কোনোকালেই করে না।' জোহরা বারান্দার কাছে এলো। চোখের ওপর থেকে একরাশ চুল ডান হাতে সরিয়ে ফোটা-ফুলের মতো উজ্জ্বল মুখটা তুলে মধুর হাসি-ওপচানো ঠোঁটে বলল_'আপনি জানেন না? বছরের পয়লা বিষ্টি, ভিজলে খুব ভালো। এতে যে ফসল ফলবে।'

 

No comments:

Post a Comment